সাসপেন্স থ্রিলার দেখতে বসার মজাটাই আলাদা। কারণ থ্রিলার ছবি দেখতে বসলেই দর্শক হিসেবে অসংখ্য প্রশ্নের মুখোমুখি হবেন আপনি আর মনে হবে ইস্ যদি এই রহস্যের সমাধান করতে পারতাম! আবার কখনও কখনও নিজেকে ওই গোয়েন্দাটি, ওই তদন্তকারী পুলিশ অফিসারটিও মনে হবে। মনে হবে যেন আপনিই রহস্যের সমাধান করছেন! রহস্যের শেষ পাতাটির জন্য অপেক্ষা করতে থাকবেন আর মনে হবে যেন এ-রহস্য গল্পের শেষ না হয়।
বলিউড, টলিউডে এখন থ্রিলারের ট্রেন্ড। ছবি থেকে ওয়েব সিরিজ— সর্বত্র সাসপেন্স থ্রিলার, মার্ডার মিস্ট্রি, রাজনৈতিক অপহরণ, হরর এই সবেরই ভিড়। এখন ভাল ছবি মানে বেশিরভাগ থ্রিলারধর্মী অ্যাকশনপ্যাক ড্রামা। আর সাসপেন্স থ্রিলার, হরর এই ঘরানার ছবির জন্য বেশ পরিচিত হলেন পরিচালক অরিন্দম ভট্টাচার্য। তিনি পুরস্কারপ্রাপ্তও। ২০১৬ থেকে ফ্ল্যাট নম্বর ৬০৯, অন্তর্ধান, শিবপুর ইত্যাদি একাধিক ছবি পরিচালনা করেছেন। প্রতিটাই হিট। তাঁর পরিচালিত ‘শিবপুর’ বাংলা ছবির যে এতদিনকার হার্ডকোর অ্যাকশন ছবির ছকটা ভেঙেছে। বাংলার দর্শকদের কাছে বলিউডি ঘরানার কাঠ কাঠ আন্ডারওয়ার্ল্ড এবং রাজনৈতিক থ্রিলার ছবির ফিল এনে দিয়েছিল ‘শিবপুর’। ভায়োলেন্সে বেশ পরিণত হয়েছিল তখন বাঙালি। পরিচালকের সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ‘দুর্গাপুর জংশন’ও তেমন ধরনেরই একটা ছবি। তফাত হল ‘শিবপুর’-এর মতো সংগঠিত ক্রাইমের প্রেক্ষাপট এখানে নয়, রয়েছে একক খুনের ঘটনা।
মার্কিন মুলুকের একটি নির্মম সত্য ঘটনা অবলম্বনে তৈরি এই ছবির পটভূমিকা হল ছোট্ট শহর দুর্গাপুর। ছবির বিষয়বস্তু দুর্গাপুরের বুকে ঘটে যাওয়া একের পর এক চাঞ্চল্যকর মৃত্যু। হঠাৎ করে বয়স্ক পুরুষদের মৃত্যু বাড়তে থাকে। যে ভিটামিনের বিষক্রিয়ায় মৃত্যু সেই ওষুধ ডাক্তারের প্রেসক্রিপশনেই বলা রয়েছে।
তদন্ত শুরু হয় এবং উঠে আসে সত্য— এগুলো স্বাভাবিক মৃত্যু নয় প্রতিটাই খুন। সেই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হচ্ছে আবার বহুল ব্যবহৃত একটি ওষুধকে জাল করে। ভিটামিনের শিশিতে সায়ানাইড ব্যবহার করে। পুলিশ প্রথমদিকে কোনও সূত্র খুঁজে না পেলেও, ধীরে ধীরে রহস্য ঘনীভূত হতে থাকে। কেন এমন মর্মান্তিক মৃত্যু? খুনি আসলে কে? এরকম একটা ছোট্ট শহরে এমন ভয়ঙ্কর খুনের মোটিফ কী? কী করে কিনারা হবে এই রহস্যের?
সেই খুনের রহস্য উদঘাটন করে সত্যিটা জনগণের দরবারে পৌঁছে দিতে আসেন সাংবাদিক উষসী। তদন্তের পাশে পান দুঁদে পুলিশ অফিসার সৌম্যকে। ছবিতে রাফ অ্যান্ড টাফ পুলিশ অফিসার সৌম্যর চরিত্রে অভিনয় করেছেন বিক্রম চট্টোপাধ্যায়। তার নির্মেদ, কঠিন চেহারা, স্ক্রিন প্রেজেন্স অনবদ্য। খুব যথোপযুক্ত এই চরিত্রায়ণ।
সৌম্যর চরিত্র সম্পর্কে বিক্রম বললেন, ‘আমার কাছে এটা একেবারেই অন্যরকম চরিত্র। আমি চেষ্টা করি আমার অভিনীত প্রত্যেকটা চরিত্রের মধ্যে যেন কিছু একটা নতুনত্ব রাখা যায়। সেটা শব্দচয়নে হোক বা লুক-এ বা শরীরী ভাষায়। ‘শেষ পাতা’ থেকে শুরু করে ‘পারিয়া’, ‘সূর্য’… প্রত্যেকটা ছবিতেই ইমেজ ভেঙে বেরনোর চেষ্টা করেছি। ‘দুর্গাপুর জংশন’-এও (Durgapur Junction) সেই চেষ্টাই ছিল। এখানে আমার যে চরিত্র, সে কথায়-কথায় গালমন্দ করে। মুখ চলার আগে তার হাত চলে। খুব ইন্টারেস্টিং। দর্শকরা ক্লান্ত হবে না ছবিটা দেখলে এটা বলতে পারি। আর ভেবলিদির (স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়) সঙ্গে আমার সম্পর্ক বরাবর খুব ভাল ফলে সেই সমীকরণটা ছবিতে খুব কাজে এসছে। আমরা শুধু অভিনয় করিনি। চিত্রনাট্য থেকে শুরু করে অনেক খুঁটিনাটি বিষয় একসঙ্গে আলোচনা করে করেছি। ফলে কাজটা আরও নিখুঁত হয়েছে।’
আরও পড়ুন- জয় জওয়ান! জয় ভারত!!
সাংবাদিকের চরিত্রে স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায় এক কথায় দুর্দান্ত। তাঁর অভিনয় ভীষণ সাবলীল এবং ধারালো। এমন চরিত্র পেয়ে তিনি খুশি। তিনি বললেন, ‘১৫ বছর পর একজন সাংবাদিকের চরিত্রে অভিনয় করলাম। ছবিতে আমি ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্ট। আমার আগের প্রজেক্টগুলোর মতো এখানে আমি আর অসহায় মা নই। সন্তানের মৃত্যু বা অন্তর্ধানের শোকাহত নয় সাংবাদিক উষসী। এই উষসী অনেক দিক থেকেই আমার মতো— সে দুবার চিন্তা না করেই তার মনের কথা বলে ফেলে। সৌম্য এবং উষসীর মধ্যে সমীকরণও দর্শক উপভোগ করবেন আশা করি।’
এই ছবিতে বিক্রম এবং স্বস্তিকার বেশ কিছু সংলাপ রয়েছে যা মনে রাখার মতো। সহকারী পুলিশ অফিসার গৌরীর চরিত্রে একাবলী খান্না খুব স্বচ্ছন্দ্য এবং সহজ। চরিত্রের সঙ্গে মিলেমিশে গেছেন। এছাড়া এই ছবিতে রয়েছেন শ্রীময়ী মজুমদার, রাজদীপ সরকার, প্রদীপ ধর প্রমুখ। শ্রীময়ী এবং রাজদীপ দুজনেই খুব ভাল অভিনয় করেছেন। প্রদীপ ধরের কমেডি রহস্যের মাঝে বেশ জমাটি।
নব্বইয়ের দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক স্টেটে ভিটামিনের সঙ্গে সায়ানাইড মিশিয়ে একের পর এক খুন করা হতে থাকে। ‘দুর্গাপুর জংশন’ (Durgapur Junction) ছবিতে এই ঘটনারই ছায়া দেখতে পাবেন দর্শক। এছাড়া ছবিতে রয়েছে কিছু প্রাসঙ্গিক বিষয় যেমন ‘চাইল্ডহুড ট্রমা’ এবং ‘ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স’ ইত্যাদি। বিভিন্ন বলিষ্ঠ উপাদানের মাধ্যমে আকর্ষণীয় এবং উপভোগ্য হয়ে উঠেছে এই থ্রিলার ছবি।
ছবির ক্যামেরার দায়িত্ব সামলেছেন প্রসেনজিৎ চৌধুরী। ছবির সিনেমাটোগ্রাফি অসাধারণ। সম্পাদনায় রয়েছেন সুজয় দত্ত রায়। ছবির সুর দিয়েছেন সৌম ও শ্রী। সিজিআই এবং ভিএফএক্স সামলেছেন শুভায়ন চন্দ্র। রূপম ইসলামের গাওয়া এই ছবির ‘সায়ানাইড’ গানটি ইতিমধ্যেই বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। এই গানটা লিখেছেন সৈকত চট্টোপাধ্যায়, কৌস্তুভ কেসি আর রৌনক চক্রবর্তী।