একসঙ্গে পঞ্চাশটা বসন্ত পেরনো দাম্পত্য। যে দীর্ঘ পথচলা দুভার্গ্য কিংবা সৌভাগ্যের চেয়েও অনেক বেশি অভ্যাস তার চেয়ে বেশি ভালবাসা। কখনও জীবনের চড়াইতে উঠতে গিয়ে হাঁপিয়ে ওঠা আবার কখনও উতরাইতে নামতে গিয়ে পিছলে বেসামাল হওয়া। পুরনো সমীকরণ হারিয়ে সম্পর্ক, বন্ধুত্ব আর প্রেম সবকিছুকে পিছনে ফেলে যখন তৈরি হয় নতুন রসায়ন, যেখানে পারস্পরিক নির্ভরতাই হয়তো আগামী দিনগুলোর বেঁচে থাকার একমাত্র রসদ। পরিচালক পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়ের নতুন ছবি ‘এই রাত তোমার আমার’ (ei raat tomar aamar) এমনই এক দাম্পত্যের গল্প বলে।
অমর আর জয়িতা স্বামী স্ত্রী। জয়িতার দুরারোগ্য ক্যান্সার। গুরুতর অসুস্থ স্ত্রী আর সংসারের বেশির ভাগ ঝক্কি সামলে চলা অমর। কারণ তাদের একমাত্র সন্তান জয় প্রবাসী। চাকরিসূত্রে সে স্ত্রী মীরা আর সন্তানকে নিয়ে বাইরে থাকে। বাবা-ছেলের সম্পর্কও তেমন ভাল নয়। তাই ছেলের উপর নির্ভর না করে অমর কলকাতা ছেড়ে উত্তরবঙ্গের পাহাড়ি এলাকায় একটি দোতলা বাংলোয় স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন। তিনি একাই সব সামলে নিতে চান আর সবকিছু সামলে দিনের শেষে কাবু হয়ে পড়েন। কারণ তার শরীরও খুব ভাল নয়। বয়সজনিত নানা ব্যাধি তাকেও গ্রাস করছে ধীরে। বিশেষ করে কোমরে ব্যথা। এহেন অমর আর জয়িতার পঞ্চাশতম বিবাহবার্ষিকী। একটু সেলিব্রেশন হলে ক্ষতি কি! হয়তো পরিস্থিতি খুব সুখের নয় কারণ একজন গুরুতর অসুস্থ। কিন্তু তাও একটু সাজ, একটা ভাল শাড়ি, মোমবাতি আর অতীত স্মৃতির রোমন্থন। হতেই তো পারে এমন একটা মুহূর্ত। এতগুলো দিন একসঙ্গে থাকতে থাকতে কত কী ঘটে জীবনে। কত কী নিশ্চুপে রয়ে যায় মনের গভীরে মান-অভিমান হয়ে, যা হয়তো বলা হয়ে ওঠেনি। হঠাৎ একদিন মনে হতেই পারে এবার বলার সময় এসেছে। আজ সব কথা বলা দরকার। ৫০-এর বিবাহবার্ষিকী হয় সেই স্বীকারোক্তির রাত। দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরের ভালবাসা, বঞ্চনা, নালিশ, বন্ধুত্ব, বিশ্বাস, অবিশ্বাসের পর এক বোঝাপড়ার রাত। নিজের আগল খুলে নিশ্চিন্তে বেরিয়ে আসার একটা রাতের গল্প বাংলা চলচ্চিত্র ‘এই রাত তোমার আমার’ (ei raat tomar aamar)।
আরও পড়ুন-বঙ্গবন্ধুকে অসম্মানের প্রতিবাদ করতেই গ্রেফতার হুমায়ুন আহমেদের স্ত্রী
চিরঞ্জীব বরদোলইয়ের গল্প ও হিন্দি ভাষায় লেখা মূল চিত্রনাট্যকে বাংলায় রূপান্তর এবং তা সমসাময়িক করে গড়ে তুলেছেন এই ছবির পরিচালক পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়। মেদহীন ঝরঝরে চিত্রনাট্য তৈরি করেছেন। তিনি নিজেও রয়েছেন এই ছবিতে। অমরের ছেলের জয়ের ভূমিকায়। এছাড়া রয়েছেন অভিনেত্রী শ্রুতি দাস। এই ছবির নায়ক এবং নায়িকা বাংলা ছবির জগতের দুই মহীরুহ অপর্ণা সেন এবং অঞ্জন দত্ত। ছবির শুরু থেকে শেষ শুধু তারাই। কেমন ছবি করলেন পরমব্রত? এককথায় দুরন্ত। অপর্ণা সেনকে কখনও নিজেকে প্রমাণ করবার দরকার পড়ে না এই ছবিটা আবার সেটাই বোঝাল। অঞ্জন দত্তের অভিনয় নিয়ে আলাদা করে বলার কিছু নেই। কোথাও এতটুকু অতি-আবেগ, অতি-নাটকীয়তা নেই তাঁদের অভিনয়ে। খুব সরল ছন্দে এগিয়ে নিয়ে গেছে গল্প। অনেকেই নিজের পরিবারের সঙ্গে রিলেট করতে পারবেন। পরমব্রত নিজেই বলেছেন ছবিটা করতে গিয়ে প্রতিমুহূর্তে দুই অভিনেতার সঙ্গে আলোচনা করেছেন ফলে তাঁদের মধ্যে সেই সমীকরণের ছাপ রয়েছে ছবিতে। অঞ্জন দত্ত, অপর্ণা সেন দুই তুখোড় অভিনেতা হলেও এই ছবিটা করতে গিয়ে সোহাগ সেনের কর্মশালায় যোগদান করেছিলেন শুধু বয়স্ক দম্পতির শরীরী ভাষাকে রপ্ত করতে। এর থেকেই বোঝা যায় শেখার কোনও বয়স হয় না। যোগ্য মানুষেরা শিখে চলেন বলেই তাঁরা যোগ্য। পর্দায় ম্যাজিক তৈরি করেছেন অঞ্জন দত্ত, অপর্ণা সেন জুটি। ব্যস্ততম জীবনে এই ছবি আমাদের ভাবতে বাধ্য করে এবং প্রতিমুহূর্তে ভাবায়। বয়স্ক দম্পতির পালসটা খুব সূক্ষভাবে ধরতে পেরেছেন পরিচালক। ছবিটা পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় তাঁর স্বর্গত মা-বাবাকে উৎসর্গ করেছেন। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি খুব অল্প বয়সে বাবা-মা-কে হারিয়েছি। আমার ২০ বছর বয়সে বাবা চলে যান। ৩৩ বছরে মা। আমি যৌথ পরিবারে মানুষ হইনি। বাবা-মা যে সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে আমাকে বড় করেছেন, সেটা কখনও লুকিয়ে রাখেননি। আমাকে সেই সংগ্রামের অংশ করেছেন। আমার বাবা যখন মারা যান, ওঁদের দাম্পত্য জীবনের ২৩-২৪ বছর হয়েছিল। আমার মনে হয়েছে আজ ২৭ বছর পেরলে ঠিক এমনই হত ওঁদের দাম্পত্যটা। কিছু দম্পতি থাকেন যাঁদের মধ্যের ভালবাসা বা তিক্ততা কোনওটাই এক্সট্রিম হয় না। যাঁরা মানিয়ে-গুছিয়ে থেকে যান। এটা তাঁদের প্রতি আমার ট্রিবিউট।’
ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্তের সুরারোপিত ছবির গানগুলো মনের মধ্যে রেশ রেখে যায়। এই প্রথম অঞ্জন দত্তের গলায় রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনবে দর্শক। ক্যামেরায় প্রসেনজিৎ চৌধুরী দারুণ। সম্পাদনায় সুমিত চৌধুরী নিপুণ। শুধু জীবনের প্রায় শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়ানো স্বামী- স্ত্রীর সম্পর্ক নয়, বাবা-ছেলের সর্ম্পকের রসায়ন, জেনারেশন গ্যাপ এমনকী পরকীয়ার প্রসঙ্গ এমনভাবে উঠে এসেছে যেখান থেকে এ-যুগের একটুকরো সমাজচিত্র দেখতে পাবেন দর্শক। একটা গোটা জীবনে পরকীয়া কি খুব আশ্চর্যজনক কোন ঘটনা? কিন্তু সেই পরকীয়ার কথা নিজের জীবনসঙ্গীর কাছে স্বীকার করতে সাহস লাগে। যেটা আমরা আজও কিন্তু অর্জন করতে পারিনি। সেই সাহসটা এখানে রয়েছে। গোটা ছবিতে যত্নের ছাপ খুব সুস্পষ্ট। সব সম্পর্ক নিটোল প্রেমের হয় না। সব প্রেম কিন্তু প্রেম নাও হতে পারে, মোহ হতে পারে, দায়িত্ব হতে পারে। সেই বিষয়টা এতটাই নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছেন— এখানেই পরিচালক পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়ের মুনশিয়ানার পরিচয়। তাই ছবিটা দেখতে বসে চোখ যে জলে ভিজবে সে-কথা হলপ করেই বলা যায়।