চলতি মাসের শুরুতেই মুক্তি পেয়েছে পরিচালক কিরণ রাওয়ের ছবি ‘লাপাতা লেডিজ’। মুক্তির দিন থেকেই বেশ চর্চিত এই ছবি। ২০১১-তে মুক্তি পেয়েছিল কিরণের প্রথম ছবি ‘ধোবি ঘাট’। তার একযুগ অর্থাৎ প্রায় ১২ বছর পরে রিলিজ করল তাঁর দ্বিতীয় ছবি। এই ছবির অন্যতম প্রযোজক আমির খান। সম্পর্কে প্রাক্তন হলেও ছবির জগতে কিরণ-আমির যে একে অপরের পরিপূরক ‘লাপাতা লেডিজ’ ছবিটি তার অকাট্য প্রমাণ। হাসি ও মজার মোড়কে সুগভীর ভাবনা এবং সামাজিক বার্তাবাহী ছবি তৈরিতে আমিরের চাইতে এতটুকু পিছিয়ে নেই কিরণ ‘লাপাতা লেডিজ’ (Laapataa Ladies) সেটাই দেখাল।
যদিও দ্বিতীয় ছবি করতে অনেকটা সময় লেগে গেল কিরণের। কেন তিনি এতদিন লাপাতা ছিলেন এই প্রসঙ্গে পরিচালক বলেন, ‘ছেলেকে নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম, পাশাপাশি অনেকগুলো স্ক্রিপ্ট লিখেছিলাম। কিন্তু সন্তুষ্ট ছিলাম না। ভাল বিষয় খুঁজে পাচ্ছিলাম না কিছুতেই। তখন ২০১৮-তে আমির আমাকে এই গল্পটা শোনাল এবং সেই মুহূর্তে ডিসাইড করলাম যে এই ছবিটা আমি করব। কারণ গল্পের বিশেষত্ব, এতটাই রোমাঞ্চকর যে ভাল লেগেছিল খুব।’
কী এমন রয়েছে এই গল্পে এই প্রসঙ্গে কিরণ বললেন, ‘২০০১ সালের নির্মল প্রদেশ নামের এক গ্রামীণ এলাকার গল্প এটা। যেখানে নব্যবিবাহিতারা স্বামীর নাম মুখে আনতে পারে না। একগলা ঘোমটা টেনে রাখে। সেই গ্রামে দীপকের বিয়ে হয় ফুলের সঙ্গে। ফুলের গ্রাম এতটাই প্রত্যন্ত যে, কোনও রেল স্টেশনও নেই। মাঝপথে ট্রেন দাঁড় করিয়ে তাতে উঠে পড়াটাই দস্তুর। নববধূকে নিয়ে দীপক রওনা দেয়। ট্রেনের কামরায় আরও কয়েক জোড়া নবদম্পতি ছিল। সকলের পরনে একই রকমের সুট আর শাড়ি। এরপর নতুন বৌকে নিয়ে বাড়ি পৌঁছয় সে। কিন্তু ঘোমটা খুলতেই বিপত্তি। দেখে বৌ বদলে গিয়েছে! ফুলের বদলে কোনও এক পুষ্পারানিকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে দীপক। এবার কী হবে তার আসল বউ গেল কোথায়! এদিকে পুষ্পারানির কোনও হেলদোল নেই। কিন্তু কেন দুটো মেয়ের রোমাঞ্চকর জার্নির এটাই স্টার্টিং পয়েন্ট। আমার মনে হয়েছিল এই গল্পটাকে কেন্দ্র করে আমি অনেক পজিটিভ জিনিস দেখাতে পারি দর্শককে। মানুষকে হাসাতেও পারি কাঁদাতেও পারি।’
আরও পড়ুন: শতাব্দীর হাত ধরে কয়েকশো পরিবার বিজেপি ছেড়ে তৃণমূলে
নারীবাদের গল্প ‘লাপাতা লেডিজ’ (Laapataa Ladies)। বিষয় বেশ জোরদার সেই সঙ্গে প্রেজেন্টেশনও। আগে এমন বিষয় নিয়ে ছবি হয়নি। অনাবশ্যক ড্রামা নেই, নেই অভিনয়ের আতিশয্য। সহজ, সরল, নিটোল গ্রাম্য সংলাপে খুব চেনা আবেগকে দর্শকদের সামনে তুলে ধরেছেন পরিচালক। ছবির কড়া বার্তাও বেশ খোঁচা মেরেছে দর্শক মনে। সূক্ষ্ম মুনশিয়ানায় খুব নরম শ্লেষের সঙ্গেই চিত্রনাট্যে ঢুকেছেন পরিচালক। এই সমাজের এক বড় অংশের মেয়েরা বিনাবাক্যে আজও পুরুষের একাধিপত্যের অধীন, পরিবারে তাঁদের অধোগতি, নীরব যন্ত্রণা, ব্যঙ্গবিদ্রুপ, সেই পুরুষতান্ত্রিকতাকে মেনে নিয়ে চলা এবং সেই চাপের বিরুদ্ধে, সবরকম রীতিনীতির বিরুদ্ধে বিনম্র প্রতিবাদী হয়ে ওঠা— এটাই ছবির মূল কথা। সাম্প্রতিক হিন্দি থ্রিলার, অ্যাকশন, রোম্যান্টিক ড্রামার ভিড়ে এই ছবি যেন খোলা আকাশ।
এই গল্পটা আদতে একটা নাটক যার জনারটা বদল করেছেন কিরণ। কলকাতার ছেলে লেখক বিপ্লব গোস্বামীর গল্প থেকে কিরণ ও স্নেহা দেশাই এবং দিব্যানিধি শর্মা দক্ষতার সঙ্গে সাজিয়েছেন চিত্রনাট্য। বিহারি, ভোজপুরি আর হিন্দির মিশেলে তৈরি ছবির সংলাপগুলো চরিত্রের মুখে পড়ে অবলীলাক্রমে হয়ে উঠেছে এক একটা গুরুত্বপূর্ণ মেসেজ। চিত্রনাট্য লেখার সময় থেকেই এই শর্ত যত্ন করে পালন করেছেন কিরণ। ছবিকে কোনও প্রাদেশিক সীমানায় বেঁধে রাখতে চাননি তিনি। তাই কাস্টিং করেছেন সেইভাবেই।
আমির খান নিজেও নাকি অডিশন দিয়েছিলেন অভিনেতা রবি কিসানের করা চরিত্রটা জন্য। সেই অডিশনে সফল হলেও কিরণ তাঁকে ছবিতে কাস্ট করেননি। পরিবর্তে রবিকে কাস্ট করেন। এই প্রসঙ্গে কিরণ জানালেন, ছবিটাকে আমি খুব রিয়্যালিস্টিক করার চেষ্টা করেছিলাম। আমিরকে নিইনি তার কারণ ছবিতে যেহেতু দু-একজন ছাড়া সবাই নতুন সেক্ষেত্রে অত বড় একজন স্টার অভিনয় করলে বাকি শিল্পীদের অভিনয়-দক্ষতা হয়তো আমিরের স্টারডমে চাপা পড়ে যেতে পারত। অভিনেতা রবি কিসান ওই চরিত্রটার সঙ্গে খুব মানানসই ছিলেন, ওঁর বডি ল্যাঙ্গোয়েজ অসাধারণ। মাটির কাছাকাছি এমন পরিবেশে বড় হওয়া মানুষ ফলে আলাদা করে ওঁকে কিছু প্রমাণ করতে হয়নি।
নারীর উত্তরণ, নারীর ক্ষমতায়নের গল্প বলে এই ছবি। সেই উদ্দেশ্য কতটা সফল হবে বলে মনে হয় এই প্রশ্নের উত্তরে কিরণ বলেন, ‘আমি চেয়েছিলাম এই ছবিটা দেখে কিছুটা হলেও মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির বদল হোক বা তারা ভাবতে বাধ্য হোক। বিশেষ করে মেয়েরা। চাই এই ছবিটা মেয়েরা সব দেখুক। কারণ মেয়েদের ইচ্ছের কথা, স্বপ্নের কথা মেয়েদেরই বলতে হবে। মেয়েদেরই ভাবতে হবে। আর এই বিষয়ে পারস্পরিক যেন একটা সহযোগিতা থাকে। আমি সবার মধ্যে এই চিন্তাটাই ছড়িয়ে দিতে চাই। আশা রাখছি এই ছবি মেয়েদের সাহস জোগাবে তাঁদের অনুপ্রাণিত করবে।
ছবির বাহুল্যবর্জিত দৃশ্যগুলো যেন এক টুকরো ভারত। আনকোরা শিল্পীরাই এই ছবির বল। চরিত্রেরা জীবন্ত। পুষ্পারানি এই সমাজের নারীর প্রতিনিধি। অভিনেতা রবি কিসান ধূর্ত, ঘুষখোর থানার বড়বাবুর চরিত্রে অনবদ্য। তাঁর মুখে মুচমুচে সংলাপ প্রাণখোলা হাসির রসদ জোগায়। মনে থেকে যাওয়ার মতো আরও একটা চরিত্র হল রেল স্টেশনের চায়ের দোকানি মঞ্জু মাই যে সহজ করে বুঝিয়ে দেয় পুরুষজাতির ভাঁওতাবাজিতে কেমন করে মেয়েরা ঠকে। ছবিতে অভিনয় করেছেন স্পর্শ শ্রীবাস্তব, নীতাংশী গোয়েল ও প্রতিভা রান্তা, ছায়া কদম প্রমুখ। প্রত্যেকেই সারল্যের জোরে ভীষণ ভাবে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠেছেন।
‘লাপতা লেডিজ’ (Laapataa Ladies) সোশ্যাল স্যাটায়ার, যেখানে রাজনীতি আছে, আবার নারীবাদও আছে। সঙ্গে আছে মিষ্টি প্রেম। এ-ছবি উত্তরণের। বাধা কাটিয়ে স্বপ্নপূরণের পথে এগনোর। এমন ছবি পরিচালকের প্রতি দর্শকের প্রত্যাশা বাড়াবে বলাই বাহুল্য।