মৃণাল সেন ভারতীয় সিনেমার আইকন। যিনি চলচ্চিত্রের প্রচলিত প্রথাকে সিনেমার প্রয়োজনেই বারবার ভেঙেছেন। ঐতিহ্যে লালিত চিরাচরিত বিশ্বাসকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন। ছাড়িয়েছেন সব সীমাবদ্ধতা। তিনি সময় পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে বদলেছেন এবং বদলে ফেলেছেন তাঁর ছবির ভাষাও। নিয়ম ভাঙার অবাধ স্বাধীনতা ছিল তাঁর। সমঝোতায় বিশ্বাস না করা, সদা আত্মবিশ্লেষণে মগ্ন এক রাজনৈতিক চলচ্চিত্রকার মৃণাল সেন। সত্যজিৎ রায়ের সমকালীন পরিচালক হয়েও তিনি ছিলেন শ্রেণি-সচেতন ও প্রগতিশীল শিল্পী৷ যিনি নিজ দেশেই একাধারে নন্দিত এবং নিন্দিত। এহেন মৃণাল সেনকে নিয়ে ছবি করা খুব সহজ কাজ নয়। আত্মস্থ না করে, না জেনে, না বুঝে তাঁকে নিয়ে ছবি করা অসম্ভব।
সম্প্রতি মুক্তি পেতে চলেছে তাঁরই বায়োপিক ‘পদাতিক’ (Padatik)। ছবির পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায়। সৃজিতের ছবির প্রতি একটা ভরসার জায়গা দর্শকমনে সবসময় রয়েছে। তাঁর পরিচালনায় তৈরি এই ক্লাসিক্যাল বায়োপিকটির ভিত যে বেশ পোক্ত তা হলফ করেই বলা যায়। গত ১৪ মে পালিত হয়েছে মৃণাল সেনের ১০১তম জন্মদিন। তাই এই ছবির মাধ্যমে শতবর্ষে কিংবদন্তি পরিচালককে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করেছেন সৃজিত।
‘পদাতিক’ (Padatik) ছবিটা জুড়ে থাকবে ব্যক্তি মৃণাল সেন এবং পরিচালক মৃণাল সেনের জীবনের অনেকটাই। ১৯৬৯ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত মৃণাল সেন নির্মিত কলকাতা ট্রিলজি সিনেমার অনেকটাই কভার করেছেন পরিচালক। একটা সময় মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ হিসেবে কাজ করতেন কলকাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার এই মেধাবী ছাত্রটি। ১৯৫৫ সালে মৃণাল সেনের ‘রাতভোর’ ছবিটি ব্যর্থ হয়। এই ছবিতে ছিলেন উত্তমকুমার। কিন্তু ব্যর্থ হলেও গল্প বলা কোনওদিন ছাড়েননি তিনি। পরের ছবি ‘নীল আকাশের নীচে’তে নিজের জাত চিনিয়েছিলেন। গোটা জীবনে পরিচালনা করেছেন বহু স্মরণীয় ছবি যার মধ্যে অন্যতম আকালের সন্ধানে, গয়া, একদিন প্রতিদিন, ইন্টারভিউ, খারিজ, ভুবন সোম ইত্যাদি। কিন্তু ১৯৬০ সালে ‘বাইশে শ্রাবণ’ ছবিটি তাঁকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এনে দেয়।
সেই মৃণাল সেনকে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে এই ছবিতে দেখিয়েছেন পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায়। ছবির মেকিং এখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সেই সম্পর্কে পরিচালক বলেন, ‘‘লকডাউনের সময় থেকেই এর রিসার্চ ওয়ার্ক শুরু হয়। প্রায় দেড় বছর মতো চলে। ‘তৃতীয় ভুবন’ এবং ‘বন্ধু’। এই দুটি বই প্রধানত— এছাড়া মৃণাল সেনের লেখা সিনেমা ও রাজনীতি বিষয়ক নানা প্রবন্ধ— এ-গুলোই আমাদের এই কাজের মূল উৎস বলা যেতে পারে।’’
‘পদাতিক’ ছবিতে মৃণাল সেনের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন বাংলাদেশের অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী। দু’জনের মুখের একটা অসম্ভব মিল রয়েছে এটা ইতিমধ্যেই ট্রেলার দেখে দর্শক বুঝে গেছেন এবং অভিনয়টাও যে বলিষ্ঠ তাও ট্রেলারেই আঁচ পাওয়া গেছে। এমন একটা চরিত্রে অভিনয় করার সুযোগ পাওয়া সত্যিই স্বপ্নের। অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী নিজেও তেমনটাই মনে করেন। এই প্রসঙ্গে তিনি সংবাদমাধ্যমে বলেন, ‘স্বপ্নেও ভাবিনি মৃণাল সেনের চরিত্রে অভিনয় করব। কাজটা যখন শুরু করি, তখন মনের মধ্যে একটা ভয়ও কাজ করছিল। একটা বড় চ্যালেঞ্জ ছিল, মৃণাল সেনকে নিজের মধ্যে ধারণ করা। এত বড় একজন ব্যক্তিত্ব! পরিচালনা ছাড়াও তাঁর ব্যক্তিগত জীবন এবং রাজনৈতিক সত্তাকে ধারণ করতে না পারলে তো চরিত্রটাই অপূর্ণ রয়ে যাবে। শুধু চেহারার মিল থাকলে হয় না, আরও অনেক কিছু লাগে। সেই প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। ওঁর ছবিগুলো আগে দেখা থাকলেও আবার নতুন করে দেখলাম। তখন মানুষটাকে নতুনভাবে চিনতে পারলাম।’
এই ছবিতে সৃজিত মৃণাল সেনের ব্যবহৃত সিনেমার সরঞ্জামগুলিও ব্যবহার করেছেন এবং ওঁর ছবির নানা ফুটেজ ব্যবহার করেই পুরো গল্পটা বলার চেষ্টা করেছেন। তাই মৃণাল সেনের বায়োপিক হিসেবে ‘পদাতিক’ নামকরণটা যথাযথ। মৃণাল সেন পরিচালিত ‘পদাতিক’ (Padatik) মুক্তি পেয়েছিল ১৯৭৩ সালে।
ছবিতে অপর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় রয়েছেন অভিনেত্রী মনামি ঘোষ। মৃণাল সেনের স্ত্রী গীতা সেনের চরিত্রে অভিনয় করেছেন মনামি। সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে এটাই মনামির প্রথম কাজ। অনেকের মতে, সৃজিতের সঙ্গে কাজ মানে একটা ব্রেক থ্রু। এই প্রশ্নের উত্তরে নায়িকা অকপটেই জানান, একদমই তাই। শুধু সেটা নয় এই ছবিটা যেরকম ভাবেই দর্শকদের কাছে আসুক না কেন, এটা আমার কেরিয়ারে একটা মাইলস্টোন হয়েই থাকবে।
আরও পড়ুন- চলতি মাস থেকেই জেলায় জেলায় শুরু হচ্ছে শিবির
এ ছাড়া এই ছবিতে মৃণাল সেনের কম বয়সের চরিত্রটিতে অভিনয় করেছেন কোরক সামন্ত। সদ্য ট্রেলার লঞ্চ হয়েছে এই বহু প্রতীক্ষিত ছবিটির। যেখানে কোরককে একটি দৃশ্যে ক্যামেরার সামনে নগ্ন দেখা গিয়েছে। দৃশ্যটি বিতর্কিত হলেও এমন বিবস্ত্র দৃশ্যে বেশ সাহসী কোরক এবং সেই সঙ্গে পরিচালকও। ছবিতে সত্যজিৎ রায়ের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন জিতু কামাল। ২ মিনিট ৫৮ সেকেন্ডের পদাতিক-এর ট্রেলারে অভিনয়, সংলাপ থেকে শুরু করে প্রতিটি ফ্রেম খুব টানটান। ফলে ছবি রিলিজের দিন থেকেই তা দর্শকমন জয় করে নেবে বলেই আশা রাখা যায়। ইতিমধ্যেই মেলবোর্ন, লন্ডন, টরন্টো, সিডনির মতো চলচ্চিত্র উৎসবে জায়গা করে নিয়েছে ‘পদাতিক’ (Padatik)। নিউ ইয়র্ক চলচ্চিত্র উৎসবে ‘সেরা স্ক্রিন প্লে’র পুরস্কারও এসেছে এই ছবির ঝুলিতে। স্বাভাবিকভাবেই দর্শকদের প্রত্যাশাও তুঙ্গে। সম্প্রতি অঞ্জন দত্তের পরিচালনায় মৃণাল সেন সম্পর্কিত ছবি ‘চালচিত্র এখন’ মুক্তি পেয়েছে। আর এবার মুক্তি পেতে চলেছে সৃজিতের পরিচালনায় তাঁর জীবনীচিত্র ‘পদাতিক’। আগামী ১৫ অগাস্ট বড়পর্দায় মুক্তি পাবে ছবিটি। ছবিটি পরের দিন অর্থাৎ ১৬ অগাস্ট বাংলাদেশেও মুক্তি পাওয়ার কথা কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরেই ছাত্রবিক্ষোভের জেরে উত্তাল বাংলাদেশ। এই অবস্থায় সেই দেশে হল-এ গিয়ে ছবি দেখার মানসিকতা হয়তো কারও নেই। তাই ছবির প্রযোজক ফিরদৌসুল হাসান জানিয়েছেন, এই পরিস্থিতির জন্য এই মুহূর্তে ঢাকায় ‘পদাতিক’-এর মুক্তি সম্ভব নয়। পরবর্তীতে ছবি মুক্তির দিন সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।