মায়ের হাতের রান্না নিয়ে নস্টালজিয়াতে ভোগেন না এমন কেউ আছেন নাকি! মনে হয় নেই। ফেলে আসা শৈশব, কৈশোরের ঝাঁপিভরা স্মৃতির মধ্যে একটা মস্ত স্মৃতি হল মায়ের হাতের রান্না। যা হয়তো মা ছাড়া কোনওদিনই কেউ রেঁধেবেড়ে পরম যত্নে খাওয়াতে পারবে না। মা, ঠাকুমা, কাকিমা, জেঠিমাদের রন্ধনকৌশল নিয়ে আলাদা করে কিছু বলার নেই। এই নিয়ে বইয়ের সম্ভার কম নেই। ইদানীং ফুড-ব্লগিং-এর রমরমা। বহু ফুড-ব্লগাররা সেই মায়ের হাতের সুস্বাদু রান্নাকে সম্বল করে নিজের চ্যানেলের সাবস্ক্রাইবার সংখ্যায় আকাশ ছুঁয়ে ফেলছেন। তাঁদের ফলোয়ার্স মিলিয়ন ছাড়ানো। আবার অনেকেই আছেন যিনি মায়ের স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে খুলে ফেলেছেন রেস্তোরাঁ বা ক্যাফে। এমন এক নস্টালজিক বিষয় নিয়ে তৈরি বাংলা ছবি ‘রবিন্স কিচেন’।
ছবির নায়ক রবিন সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। তার স্বপ্ন সে একটা ক্যাফে খুলবে। সেই নতুন সূচনাটা সে করতে চায় তার মায়ের তৈরি করা একটি রান্না দিয়ে। যে রান্না ছোটবেলা থেকে খেয়ে এসেছে রবিন। সেই স্বাদ আজও ভুলতে পারেনি। তার ক্যাফে খোলার উদ্দেশ্য এবং আকর্ষণ হল তার মায়ের হাতের অথেনটিক রেসিপি চিকেন চিজ তন্দুরি। বারবার একটাই স্বপ্ন তার অন্তরে প্রতিধ্বনিত হত মায়ের মতোন সুস্বাদু চিজ-তন্দুরি-চিকেন বানাবে নিজের ক্যাফেতে। তার সঙ্গে থাকবে মায়ের হাতেরই হরেক মেনু। তা সবাই খাবে, আর মায়ের জয়গান করবে। রবিনের ছোটবেলাটা বিভীষকাময়। খুব স্ট্রাগল। তার বাবার ছিল মানসিক বিকৃতি। অত্যাচার করত মায়ের ওপর। একদিন হঠাৎ খুন হয়ে যায় রবিনের বাবা। কে খুনটা করে সেই রহস্য তোলা থাক। কিন্তু তারপর থেকে কঠিন হয়ে গেছিল রবিনের শৈশব। রবিনের দুই বন্ধু সোহেল আর অনুভব তার সর্বক্ষণের সঙ্গী। এরা মিলেই খোলে নতুন ক্যাফে যার নাম দেয় ‘রবিন্স কিচেন’ (Robin`s Kitchen)। একদিন সেই ক্যাফেতে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে আসে নীহারিকা। চাকরিটা পেয়ে যায় সে। কাজের পাশাপাশি রবিনের সঙ্গে বাড়তে থাকে নীহারিকার বন্ধুত্ব। ধীরে ধীরে নীহারিকার সঙ্গে তার একটা মিষ্টি প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। দুজনে মিলেমিশে রান্নায় আনে ট্যুইস্ট, সামলায় ব্যবসা। ভালই চলছিল সব এরপরেই বদলে যায় চেনা গল্পের পটভূমি, তাদের ঘিরে ধরে এক অজানা ভয়। রবিন ও নীহারিকার জীবনে দুঃস্বপ্নের মতো আসে সেখানকার এক ছাত্রনেতা অরিত্র। অরিত্র বেশ দড়। তাকে সবাই মানে, তার কথাই এখানে শেষ কথা। সে আবার শুধু নেতা নয় প্রোমোটারও! জমি বেচাকেনাও করে। সেই অরিত্রর নজর রবিনের ওই ছোট্ট ক্যাফের জমিটির উপর। ক্যাফের লাগোয়া একটা জমি অরিত্র কিনে নিতে চায়। এখান থেকেই ঝামেলার শুরু। যদিও রবিনের জমি নিতে শুরু ষড়যন্ত্র। রবিন ব্যবসা সূত্রে বাইরে গেলে নীহারিকাকে অপহরণ করে অরিত্র। রবিন ফেরার পর যখন জানতে পারে এই ঘটনা তখনই বদলে যায় খেলা, ঘুরে যায় গল্পের মোড়। কী করবে এবার রবিন? সেটাই দ্যাখার ছবিতে।
পরিচালক বাপ্পার ছবি ‘রবিন্স কিচেন’-এর (Robin`s Kitchen) বিষয়টা খুব প্রাসঙ্গিক, যাকে বলে ট্রেন্ডি। এই প্রসঙ্গে পরিচালক জানালেন, আমি সবসময়ই একটু অন্যরকম, ভিন্ন ধারার কাজ করতে পছন্দ করি। সেক্ষেত্রে ‘রবিন্স কিচেন’ও তার ব্যতিক্রম নয়। বনিদা ও প্রিয়াঙ্কারদির সঙ্গে প্রথম কাজ, খুব ভাল অভিজ্ঞতা হয়েছে। দুজনেই খুব ডেডিকেটেড, চরিত্রায়ণ থেকে অভিনয়— এত সাবলীল, আমি খুব কম অভিনেতাদের দেখেছি। আশা করি দর্শকদেরও ভাল লাগবে এই ছবি। রান্নাবান্না, পরিবেশনা, রসনার পরিতৃপ্তির সঙ্গে মা-সন্তানের সম্পর্কের অটুট অনুভূতি, প্রেম আবার তার সঙ্গে ডার্ক থ্রিলার— সবমিলিয়ে বেশ জমিয়ে দিয়েছেন পরিচালক গল্পটা।
আরও পড়ুন-যুক্তরাষ্ট্রীয় নীতির স্বার্থেই তৃণমূলের সমর্থনে ১৫টি বিরোধীদল
তিনটে মূল চরিত্রকে নিয়ে এগিয়েছে ছবির গল্প। ক্লাইম্যাক্সটা দারুণ। সেটা রহস্য। আর তা আপাতত রহস্যই থাক। কারণ, এখনও পর্যন্ত অনেকেই ছবিটা দ্যাখেননি। স্পয়লার বিষয়টা খুব বিরক্তির সেটা দিয়ে দিলেই ছবি দ্যাখার মজা চলে যায়। রবিনের চরিত্রে সুন্দর অভিনয় করেছেন অভিনেতা বনি সেনগুপ্ত। চরিত্রের সঙ্গে তাল রেখে নিজস্ব টাচ দিয়েছেন যার ফলে এই ছবিতে বনির অভিনয়-দক্ষতা বহুদিন মনে রাখবেন দর্শকরা। নীহারিকা চরিত্রে প্রিয়াঙ্কা সরকার অত্যন্ত সহজ, সাবলীল। গোটা ছবিতে তার সংলাপ খুব কম কিন্তু এত কম কথা বলেও নিজের চরিত্র এত স্বাভাবিক করে তুলেছেন, তাঁকে স্পষ্ট করে বোঝা যায় ছবিতে। নেগেটিভ রোল অর্থাৎ নেতা অরিত্রর চরিত্রে অভিনেতা শান্তনু নাথ খুব দক্ষতার সঙ্গে অভিনয় করেছেন। তাঁর সংলাপগুলো খুব চটকদার। ঠিক যেমনটা দরকার মানে লোকাল প্রভাবশালী নেতার যে রোয়াবটা থাকে তেমনই। বনি, প্রিয়াঙ্কা এবং শান্তনু ছাড়াও এই ছবিতে অন্যান্য ভূমিকায় রয়েছেন কেশব ভট্টাচার্য, সস্রীক গঙ্গোপাধ্যায়, দিব্যেন্দু মিত্র, অভিনন্দন চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ।
এতটুকু অতিরঞ্জিত বা নাটুকে নয় ছবির চিত্রনাট্য এবং সংলাপ। যে চিত্রনাট্য ও সংলাপের সম্পূর্ণ কৃতিত্ব সস্রীক গঙ্গোপাধ্যায়ের। পান্ডে মোশন পিকচার্সের ব্যানারে তৈরি এই ছবির প্রযোজক মুকেশ পান্ডে।
ছবির গানগুলো খুব সুন্দর। মনে থেকে যাবে অনেকদিন। সুর দিয়েছেন অর্ণব চক্রবর্তী। তিনি যে আনকোরা নতুন সুরকার তা কিন্তু কোথাও বোঝার উপায় নেই। রোম্যান্টিক গান না হয়েও ‘এই শহর’ গানটা দর্শকদের ভাবিয়েছে। গানের কথা লিখেছেন দেব সিকদার। ছবির গানগুলি গেয়েছেন অর্ণব নিজে, রিমি এবং মিত্রজিৎ রায় চৌধুরী। ক্যামেরায় রয়েছেন অনুজিৎ কুণ্ডু এবং সম্পাদনায় রয়েছেন সায়ন্তন নাগ। ‘রবিন্স কিচেন’-এর (Robin`s Kitchen) চিজ-তন্দুরি-চিকেনের সম্পূর্ণ স্বাদটা পেতে যেতেই হবে প্রেক্ষাগৃহে।