বার্লিন আর বাঙালি যেন একসূত্রে গাঁথা। সালটা ১৯৮৪। ওই বছর প্রথম বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয় এক কিংবদন্তি বাঙালি পরিচালকের ছবি। যাঁর নাম সত্যজিৎ রায়। আর ছবির নাম ‘ঘরে-বাইরে’। ওই একই বছর বার্লিনের প্রতিযোগিতা বিভাগে নির্বাচিত হয়েছিল আরও একটি বাংলা ছবি ‘ভোম্বল সর্দার’। পরিচালক নৃপেন গঙ্গোপাধ্যায়। তারপর যুগ পেরিয়ে গেছে ভারতীয় চলচ্চিত্রের ভাষা, আবেদন, ভাবনা, রূপ, রং, বর্ণ সবটাই বদলেছে। পরবর্তী নতুন প্রজন্মের বহু প্রতিভাবান ভারতীয় তথা বাঙালি চলচ্চিত্র পরিচালক বার্লিনে গেছেন এবং চলচ্চিত্র উৎসবে জায়গা করে নিয়েছেন। ঠিক দু-বছর আগে ২০২৩-এ ৭৩তম বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের প্যানোরোমা বিভাগে মনোনীত ও প্রদর্শিত হয়েছে কলকাতার মেয়ে শ্রীময়ী সিংহের পরিচালিত তথ্যচিত্র ‘অ্যান্ড, টুওয়ার্ডস হ্যাপি অ্যালিস’। এর ঠিক দু-বছরের মধ্যে অর্থাৎ ২০২৫-এ আবার বার্লিন পাড়ি দিলেন আরেক বঙ্গ-তনয়া। তাঁর সহ-পরিচালিত ও সম্পাদিত ছবি প্রদর্শিত হল ৭৫তম বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে। এই চলচ্চিত্র উৎসবে নতুন সংযোজিত ‘পারস্পেকটিভ’ বিভাগে দেখানো হল বঙ্গতনয়া তনুশ্রী দাস এবং সৌম্যানন্দ সাহির যুগ্মপরিচালনার ছবি ‘শ্যাডোবক্স’ বা ‘বাক্সবন্দি’ (Shadowbox)।
ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্রে রয়েছেন অভিনেত্রী তিলোত্তমা সোম, চন্দন বিস্ত, সায়ন কর্মকার। তিলোত্তমাকে অনেকেই চেনেন, আবার অনেকে চেনেনও না। কারণ তিনি বরাবর হিন্দি ছবিতেই কাজ করেছেন। বাংলা ছবি করলেও পরিচালকেরা সকলেই বিদেশি। অভিনেত্রী হিসেবে তিলোত্তমার ওয়েব সিরিজকে হিসেবের বাইরে রাখলেও তিনি সর্বসাকুল্যে ছটি ফিচার ফিল্ম করেছেন যার মধ্যে অন্যতম অনুপ সিং পরিচালিত ‘কিসসা : দ্য টেল অফ এ লোনলি ঘোস্ট’, গৌতম ঘোষের পরিচালনায় ‘রাঘির: দ্য ওয়েফেরার্স’, মধুজা মুখার্জি পরিচালিত ‘ডিপ সিক্স’ ইত্যাদি। এছাড়া তিনি করেছেন বেশ কিছু শর্ট ফিল্মও। তাঁর অভিনীত ‘অনরারি মেনশন’, ‘দ্য মিরর’ শর্ট ফিল্ম দুটি পেয়েছে প্রশংসা। শুধু তাই নয় শর্ট ফিল্ম ‘দ্য মিরর’ যে কোনও বড় ফিচার ফিল্মকে টেক্কা দিতে পারে বলে দর্শক, সমালোচকরা মনে করেন। কাজেই অভিনেত্রী হিসেবে বাংলা ছবিতে তাঁর প্রথম কাজ ‘ডিপ সিক্স’-এ। এরপরেই দ্বিতীয়বারের জন্য যে বাংলা ছবিতে তিনি কাজ করলেন সেটাই ‘শ্যাডোবক্স’ (২০২৫)। আন্তর্জাতিক মঞ্চে ছবিটি এই নামেই পরিচিত এবং প্রশংসিত। এই দেশে ছবিটি মুক্তি পাবে ‘বাক্সবন্দি’ (Shadowbox) নামে।
এক শ্রমজীবী মহিলার গল্প ‘বাক্সবন্দি’ (Shadowbox)। তথাকথিত বিনোদনমূলক ছবি এটা নয়। এই ছবির পরতে পরতে উঠে এসেছে জীবনে প্রতিটা স্তরে জমে থাকা কষ্ট, সংগ্রাম, অশান্তি এবং অবসাদের বাস্তব চিত্র। আমরা রোজ ট্রামে, বাসে, ট্রেনে চোখ রাখলেই একশ্রেণির মেয়েকে দেখতে পাই যাঁরা সমাজের সমস্তরকম সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েও ক্লান্তিহীনভাবে জীবনসংগ্রামে শামিল হন। ভাল থাকা, ভাল খাওয়া-পরা, নিজের জন্য ন্যূনতম ভাল চিকিৎসার সুযোগটুকু পর্যন্ত পান না তাতেও তাঁদের লড়াই থেমে থাকে না। নিজেকে নিয়ে অতি-উদাসীন এমন বঞ্চিত নারীমুখ আমাদের খুব চেনা। ট্রেনের লেডিজ কপার্টমেন্ট বা বাসের লেডিজ সিটে বসে থাকা এই সব মেয়ের কাছে মাটি কামড়ে টিকে থাকার নামই জীবন। তাঁরা শ্রমিক। তাঁরা নিজেরাই জানেন না যে সমাজ তাঁদের ব্রাত্য করেছে । ‘বাক্সবন্দি’ ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্র ‘মায়া’ সেই বঞ্চিত খেটে খাওয়া নারীদেরই প্রতিনিধি।
আরও পড়ুন- লঙ্কা চা-এর প্রেমে মজে মন্ত্রী থেকে সঙ্গীতশিল্পী
ছবিটা প্রসঙ্গে পরিচালক তনুশ্রী দাস জানালেন, বাক্সবন্দি প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো এক প্রেমের গল্প। ‘মায়া’র গল্প। ভিন্ন সংস্কৃতিতে বিয়ে করে একঘরে হয়ে যাওয়া, সামাজিক অপমানকে উপেক্ষা করা এক শ্রমজীবী মহিলার দৈনন্দিন লড়াই, একা হাতে পরিবারকে সামলানোর গল্প। ৭৫তম বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের নতুন বিভাগে আমাদের ছবি মনোনীত হয়েছে, এটা ছবির সঙ্গে জড়িত সকলের কাছেই ভীষণ আনন্দ এবং সম্মানের।
শহরতলির বাসিন্দা মায়া, তার বর সুন্দর এবং স্কুলপড়ুয়া ছেলে দেবু। বাড়ির অমতে এক ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষকে বিয়ে করেছিল মায়া তাই পরিবার তাকে ত্যাগ করেছে। সংসারের যাবতীয় দায়-দায়িত্ব তো সে পালন করেই, সেই সঙ্গে সংসার টানতেও তাকে অনেকগুলো কাজ করতে হয়। গৃহপরিচারিকা থেকে শুরু করে চিকেন ফার্মের কর্মী, জামাকাপড় ইস্ত্রির কাজ— আরও অনেক কিছু। স্বামী অবসরপ্রাপ্ত সেনাকর্মী সুন্দর পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজর্ডার-এর রোগী। সে প্রতিবেশীদের কাছে প্রতিনিয়তই হাসির খোরাক। হঠাৎই একদিন নিখোঁজ হয় সুন্দর। একটি খুনের ঘটনায় তাকে সন্দেহভাজনের তালিকায় রাখে পুলিশ। এমতাবস্থায় মায়া তাকে হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকে। এরপর একদিন গোপনে বাড়ি ফেরে সে। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে নানান প্রশ্নের সম্মুখীন হয় তাদের দাম্পত্য। কী হয় এরপর?
আপাতদৃষ্টিতে সাধারণ এক মেয়ের গল্প মনে হলেও এই ছবি সামাজিক ট্যাবু, বিভিন্ন সমস্যা, সচেতনতাকে তুলে ধরেছে।
এই ছবির চিত্রনাট্যকার সৌম্যানন্দ সাহি। গল্প লিখেছেন তনুশ্রী দাস, প্রযোজক সৌম্যানন্দ সাহি, নরেন চন্দ্রভারকর, শৌনক সেন, আমন মন। সহ-প্রযোজনায় রয়েছেন আরও অনেকে। সিনেমাটোগ্রাফিও করেছেন সৌম্যানন্দ সাহি। ছবির সঙ্গীতকার বেনেডিক্ট টেলর এবং নরেন চন্দ্রভারকর। বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে এই ছবির গ্র্যান্ড প্রিমিয়ার হয়েছে ১৬ ফেব্রুয়ারি। এ ছাড়া উৎসবে তিনদিন আলাদা করে ছবিটি প্রদর্শিত হয়েছে। বার্লিন ছাড়া আগামী দিনে দেশ-বিদেশের আরও চলচ্চিত্র উৎসবে অংশ নেবে এই ছবি।