যেকোনও জনজাতির সংস্কৃতির সঙ্গে বিবাহ নামক সামাজিক রীতি অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত। ভারতের বিবাহপ্রথার প্রবর্তক ঋষি উদ্দালক-পুত্র শ্বেতকেতু।
এ-নিয়েও একটি সুন্দর পৌরাণিক কাহিনি রয়েছে।
একদিন এক ব্রাহ্মণ এসে নিজের মাকে হাতে ধরে নিভৃতে নিয়ে যেতে উদ্যত দেখে ভীষণ ক্রুদ্ধ হলেন শ্বেতকেতু।
পিতাকে নালিশ জানাতেই উত্তর এল—
‘মা তাতো কোপং কার্যীকসত্ত্বমেব ধর্মঃ সনাতনঃ
অনাবৃতা হি সর্বেষাং বর্ণনামঙ্গনা ভুবি।’ (মহাভারত আদিপর্ব)
অর্থাৎ সকল নারীই অনাবৃতা আর এটি সনাতন ধর্মের নিয়ম। সুতরাং এতে রাগ করার কিছুই নেই।
মন অত্যন্ত খারাপ হল শ্বেতকেতুর। বিষয়টা কিছুতেই মেনে নিতে পারলেন না।
উত্তরকালে তাই নিলেন এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। স্বামীর বর্তমানে কোনও পরপুরুষ নারীকে ভোগ করতে পারবে না এবং সেই পত্নী হবে পতিভোগ্যা ও একব্রতা।
এইভাবে ধর্ম সংস্কার করে নারীকে এক নতুন মর্যাদায় ভূষিত করলেন।
‘মর্যাদা স্থাপিত বলাৎ।’
এইভাবেই বিবাহপ্রথা শুরু।
আরও পড়ুন-কথা রাখলেন মুখ্যমন্ত্রী, নিয়োগপত্র পেলেন দুর্ঘটনায় মৃত কর্মীর ছেলে
অশ্বলায়ন গৃহসূত্রে আট রকমের বিবাহ প্রথার উল্লেখ আছে।
ব্রাহ্ম, দৈব, আর্য, প্রাজাপত্য, গান্ধর্ব, আসুর, রাক্ষস এবং পৈশাচ।
বিবাহের মূলে এক নারী ও এক পুরুষ। পুরুষটির নাম বর। বরণ করে নেওয়া হয় বলে সে বর। আর নারীটির নাম বধূ। বহন করে আনা হয় বলে তাঁর নাম বধূ।
বিবাহের মাধ্যমে কন্যা হয় কনে এবং তারপর কনে থেকে বধূ।
তৈরিত্তীয় সংহিতায় বলা হয়েছে বধূ লাভ না করা পর্যন্ত পুরুষ হচ্ছে অসম্পূর্ণ। বিবাহের পর নববধূ পতিগৃহে এলে ঋকবেদে তাকে আশীর্বাদ করে বলা হয়েছে—
‘সম্রাজ্ঞী শ্বশুরে ভব সম্রাজ্ঞী শ্বশ্রাং ভব।
নন্দান্দরি সম্রাজ্ঞী ভব সম্রাজ্ঞী অধি দেবৃসু।’
অর্থাৎ শ্বশুর শাশুড়ি ননদ দেবর সবার সম্রাজ্ঞী হয়ো তুমি।
আসলে বৈদিক যুগে জয়ের জন্য, বংশের ধারা অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য এবং ধন-সম্পদ রক্ষার জন্য বহু পুত্রসন্তানের দরকার ছিল। নারী না থাকলে সেটা ফলপ্রসূ হবে কী করে? তাই নারীকে ধনসম্পদের চেয়েও অমূল্য হিসেবে রক্ষা করা উচিত— এ-কথাই বলা হয়েছে সমস্ত বর্ণের।
‘সর্বেষাং বর্ণানাং বধূ রক্ষাতমা ধনাৎ।’
এইভাবেই বিবাহপ্রথা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে বারবার।
পরবর্তীকালে বৈদিক বিবাহ রীতি যথেষ্ট মান্যতা পেয়েছে। উপনিষদের মন্ত্র ও গানে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হয় বর ও কনে। সাধারণত এই বিয়েতে কোনও জাত বিচার কিংবা ধর্মের কঠোর অনুশাসন লক্ষ্য করা যায় না। শুধু থাকে পরম মঙ্গলময়ের প্রতি আত্মনিবেদন। বর-কনে উপনিষদের মন্ত্র উচ্চারণের মাধ্যমে প্রদীপ জ্বালিয়ে স্বস্তিবচন বা কল্যাণবাণী পাঠ করে। উপস্থিত অতিথিবর্গরা ও বলেন— ‘শুভ পরিণয় কর্মকল্যাণকর হোক।’
আরও পড়ুন-পালাবদলের গয়নাগাটি
স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পৈত্রী নন্দিনী ওরফে পুপের বিয়ে দিয়েছিলেন বৈদিক নিয়মে। পৌরোহিত্য করেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। সঙ্গে ক্ষিতিমোহন সেন। সেই বিয়ের ধারা আজও বহমান শান্তিনিকেতনে।
সূচনা পর্বে উপস্থিত সকলেই একযোগে গেয়ে উঠেছিলেন ‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে।’
উপনিষদের মন্ত্র আউড়ে বলা হয়েছিল ‘আমাদের উভয়ের ভাগ্য উভয়ের চিত্ত ও উভয়ের ব্রত একযোগে যুক্ত হয়ে অগ্রসর হোক।’
পাশাপাশি গান ছিল— ‘আমি তোমারও সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ সুরের বাঁধনে।’
গানের সঙ্গে সঙ্গে আচার্য নবদম্পতির দুটি হাত ফুলের মালা দিয়ে বেঁধে দিলেন। আংটি বদলের পর গাওয়া হয়েছিল ‘ওহে সুন্দর মম গৃহে আজি পরমোৎসব…’ সিঁদুর দানের সময় ‘তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা…’।
সপ্তপদী গমনে ছিল পুষ্প আলপনার সজ্জিত সাতটি প্রদীপকে একে একে পার করলেন নবদম্পতি। গাওয়া হয়েছিল ‘সুমঙ্গলী বধূ সঞ্চিত রেখো প্রাণে স্নেহ মধু…’। শুভ পরিণয় সম্পন্ন হতেই পুষ্পবৃষ্টি করলেন আমন্ত্রিতরা গাওয়া হলো ‘আকাশ ভরা সূর্য তারা…’।
এতক্ষণ ধরে জানা গেল বিবাহ প্রথা ও তার নানান দিক।
এবার আরও একটা উল্লেখযোগ্য দিক নিয়ে আলোচনা করব যেটা এখন অনেকটাই লুপ্তপ্রায়। সেটা হল বিয়ের গান। শ্রী আচারের সঙ্গে সঙ্গে একটা সময় পর্যন্ত বিয়েতে গানের খুবই প্রচলন ছিল। অন্তঃপুরে মহিলাদের মুখে মুখে তৈরি হত এই গান এবং পরম্পরা অনুযায়ী সেটা শিখে নিত অন্যেরা। ক্রমশ প্রজন্মবাহী হয়ে উঠেছিল বিয়ের গান। আসুন জেনে নেওয়া যাক সে-সম্পর্কে।
‘সাজো সুন্দরী কন্যা
সুন্দরী কন্যা সাজো
বিয়ার সাজেরে
নবীন যুবতী কন্যা
বড় ভালো লাগে রে।’
আরও পড়ুন-বাইরের দরজা
একটা সময় পর্যন্ত বাঙালি বিয়েতে গানের অগ্রাধিকার ছিল। বিভিন্ন স্ত্রী আচারের সঙ্গে সঙ্গে তাল মিলিয়ে আত্মীয়স্বজন পাড়াপড়শি গান গাইত। খুব সুন্দর তাতে অর্থ থাকত।
বিয়ের অনুষ্ঠানের আনন্দ তাতে বেড়ে যেত কয়েক গুণ। বিয়ের গান শুরু হয় পাকা কথা অথবা পাটিপত্র, আশীর্বাদ অনুষ্ঠান থেকে।
এছাড়াও হলুদকোটা, জল সইতে যাওয়া, শ্রীমঙ্গল, সোহাগ জল, বরস্নান, কন্যাস্নান, বরণডালা সাজানো, বর বিদায়, মেয়েকে সাজানো, বরকে বরণ করা, কনেকে বরের কাছে নিয়ে যাওয়া, বাসর জাগা-সহ যত রকম লৌকিক আচার রয়েছে বিয়েকে ঘিরে প্রত্যেকটার ওপরেই গান ছিল। গান গেয়ে গেয়ে স্ত্রী আচারগুলো পালন করা হত। সাধারণত অন্তঃপুরের মহিলারাই বিয়েতে নাচ-গান করত।
হিন্দু বিয়েতে মেয়েলি আচার অনুষ্ঠানের একটা প্রধান অঙ্গ ছিল মঙ্গল গান।
সে-সময়ে জল সইতে যাওয়ার একটি সুন্দর গান ছিল। কনে বা বরের আত্মীয়স্বজন অথবা পাড়াপড়শি এই গান গাইত।
‘পিতলের কলসি তোরে লইয়া যাব যমুনায়
যমুনার জল কালো, পিতলের কলসি ভালো।’
বিনোদনের আয়োজন উপকরণ সে-সময় আর অন্য কিছু সেভাবে ছিল না। তাই মানুষজন নিজেরাই বিনোদনের উপায় তৈরি করে নিয়েছিলেন। তবে পরিবার ভেদে এবং অঞ্চল ভেদে গ্রামবাংলার এই বিয়ের গান বৈচিত্রময় ছিল। কথা ও শব্দের প্রয়োগও ছিল আলাদা।
বিয়ের গানের সঙ্গে একটি জাতি বা সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি, সাহিত্য, ইতিহাস সম্পর্কিত পরিচয় উঠে আসত। এক-একটি পরিবারের নিয়মকানুন একেক রকম। শুধু তাই নয় সাহিত্যের ইতিহাস যদি খোঁজা যায় তাতে দেখা যাচ্ছে চর্যাপদের সময় থেকেই এই মেয়েলি গীত বিয়ের লোকাচারের সঙ্গে যুক্ত। কেননা চর্যাপদে কাহ্নপাদ আর ডম্বিকে ঘিরে বিয়ের গানের উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে সঠিক সময়ের সেভাবে উল্লেখ নেই।
‘নানা আচার নানা গান’ এমন বলাই যায়।
বিয়ের বিভিন্ন আচার, রীতিনীতি, মেয়ের বাপের বাড়ি ছেড়ে যাওয়া, নতুন সংসার, শাশুড়ি-ননদের সঙ্গে সম্পর্ক, স্বামী সোহাগ, আদি রসাত্মক— নানান সব বিষয় নিয়েই গান রয়েছে। অর্থাৎ আশীর্বাদ থেকে শুরু করে দ্বিরাগমন অবধি প্রতিটা আচার দিয়ে বিয়ের গান বাঁধা হত।
‘এলাম সই তোদের বাড়ি মালা দিতে
মালা দিতে লো সজনি বর দেখিতে
আমিও রসের মালিনী
রসের খেলা কতই জানি।’
বর দেখতে আসা নিয়ে ঠাকুমা-দিদিমার এই ধরনের গান খুবই প্রচলিত ছিল।
আরও পড়ুন-বাঙালির বিয়ের ভোজবাদ
আবার নতুন বউ শ্বশুরবাড়িতে গেলে যখন প্রাথমিক পরিচয়ের আসর বসে সেখানে উপস্থিত মহিলাদের নিয়ে সমবেত নাচ-গান হাসি-ঠাট্টা চলতেই থাকে। শুধু যে আত্মীয়স্বজন পাড়াপড়শি গাইবেন তা নয়, নতুন বউকেও বলা হত নাচ বা গান শোনানোর জন্য। এই বউ-নাচেরই এক বিখ্যাত গান ‘সোহাগ চাঁদ বদনী ধ্বনি নাচো তো দেখি, বালা নাচো তো দেখি’…
একটা সময় পর্যন্ত বিয়েতে নরসুন্দর অথবা নাপিতের ভূমিকা ছিল অপরিহার্য। বিয়ের আসরের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করতে হত পয়ার ছন্দের পাঁচালীর সুরে।
‘শুনুন শুনুন মহাশয় করি নিবেদন
রাম সীতার বিবাহ কথা করুন শ্রবণ
প্রজাপতির নির্বন্ধ কহেন সর্বলোকে
কন্যাদান মহাফল সর্বশাস্ত্রে লেখে।’
এই ধরনের গানে বিষয়গুলোর বিশেষত্ব হচ্ছে মহাকাব্য পুরাণের অনুসঙ্গ। রামায়ণ মহাভারতের মতো ধ্রুপদী সাহিত্য ছাড়াও কুরআনের অন্তর্গত পদ্মপুরাণের বেহুলা লক্ষিন্দরের প্রসঙ্গ বিয়ের গান হিসেবে এসেছে।
বর কনে রূপের বর্ণনার ক্ষেত্রে কুরআনের যে চরিত্রগুলি উঠে আসে তার মধ্যে উমা-মহাদেব রাম-সীতা, অভিমন্যু-উত্তরা, সাবিত্রী-সত্যবান, রুক্ষ্মিণী-শ্রীকৃষ্ণ অন্যতম। কোনও কোনও গানে শ্রীচৈতন্যের প্রসঙ্গও পাওয়া যায়। পৌরাণিক চরিত্র থাকলেও গানগুলো লোকো মানুষের নিজস্ব ঢঙে রচিত তাতে কোনও সন্দেহ নেই। এবং বিভিন্ন আচারের মধ্যে নানা সুন্দর কল্পনা প্রবণতা ধরা পড়ে।
যেমন ভাত কাপড়ের অনুষ্ঠান নিয়ে গান
‘কি আনন্দ অযোধ্যাতে,
জানকীরে অন্নবস্ত্র দিতা রঘুনাতে
স্বর্ণথালে শালির অন্ন পরমান্ন সাথে
কটরাতে পুঞ্জি পুঞ্জি ব্যঞ্জন থালাতে
ভাজা বড়া লুচি পুরি অন্নের চারিধারে
পিষ্টক আদি মিষ্টি দ্রব্য দিলা সারে সারে
সবে বলে ওরে বাছা শুনে বচন,
অন্নবস্ত্র দিয়া বধয় করি তায় পালন।’
বাসি বিয়ে আর সাতপাক নিয়ে রয়েছে পুরাণকে ঘিরে নানান ধরনের গান।
দেখ না দেখ না আরে দেখ নয়ন ভরিয়া
অভিমুন্যায়ে সাত পাক দেইন উত্তরারে লইয়া,
চারিগুলি বাঁশের ছিপি চারিদিকে গাড়িয়া,
তারে যে বন্দনা কইলা আওয়া সুতা দিয়া।
কবুলির গোপর দিয়া ভূমির গমিলা,
উত্তম শাইলের গুড়ি দিয়া মন্ডুলি সাজাইলা।
চারিগুলি মঙ্গলঘট চার স্থানে থুইয়া,
আম্রপত্র গঙ্গাজলে ঘাটবন্ধন কইলা।
আওয়া দুধ কুইলপথ কলায় সূর্যবন্দন কইলা
সূর্য অর্ঘ্য দিয়া সাতপাক আরম্ভিলা।
বর-কনে বাড়িতে পৌঁছানোর পর গাওয়া হয়।
‘কি আনন্দ হইল আজি অযোধ্যা নগর।
বধূ লইয়া আইলা রামধন পুরবী ভেতর।।
মুগের পত্রে শাশুড়িয়ে দধিরে রাখিয়া।
বধুর কোমল পদে দধিরে ঢালিয়া।।
মাঝঘরে কৌশল্যা রানি শীতল পাটি পাতিলা।
তার উপরে বৈইছেন রামধন সীতা সঙ্গে লইয়া।।
ঘৃতের দোশী সামনে রাখি বধুর মুখ দেখিলা।
ধান্য দূর্বা দিয়া পরে আর্ঘন আর্ঘিলা।।’
ইতিহাস পরিবর্তনের পথে চলে। কালের নিয়মে এই উত্তর আধুনিক জেটযুগে দাঁড়িয়ে বিয়ের গান কিছুটা মান্যতা হারিয়েছে। যদিও গ্রামবাংলায় কিছু কিছু পরিবারে হয়তো এখন ওই রীতি আছে। সেটুকু যদি ধরে রাখা যায় তাহলে মন্দ হয় না।