রবি-প্রসঙ্গ আজ, বার বার

ঠুনকো দেশপ্রেম নয়, মানবতাবোধ ছিল তাঁর কবিতার আশ্রয়। আর মানবিকতা দিয়ে গাঁথা সেই যে মালা, তার আশ্রয় ছিল বাংলা। কুভেন্দু কিংবা অবলাকান্ত সেকথা জানে না, বোঝে না। তাহলে ওই মালপোয়া কিংবা কাকাতুয়ারা সেই সত্য কেমনে মানবে? সদ্য চলে গেল রবীন্দ্রনাথের চলে যাওয়ার দিন। তাই ওদের সবাইকে রোববারের রোদ, বাংলা ভাষার রোদ, বাঙালির হৃদয়ের উত্তাপ চেনাতে এই বিছালাম মাদুর। আসুন, রবি ঠাকুরের দাওয়ায় বসি। তাঁর গান তো অনেক শুনলাম, গাইলাম। এবার একবার চিনতে চেষ্টা করি তাঁর মনটাকে। আহ্বান জানালেন তানিয়া রায়

Must read

“প্যাট্রিওটিজম ক্যান নট বি আওয়ার ফাইনাল স্পিরিচুয়াল শেল্টার; মাই রিফিউজ ইজ হিউম্যানিটি।” লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, ১৯০৮-এ। তখন তিনি সমালোচিত হচ্ছেন বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলন বা স্বদেশি আন্দোলন থেকে বেরিয়ে আসার কারণে। সমালোচকদের মধ্যে ছিলেন আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর স্ত্রী অবলা বসুও। তাঁকেই জবাবটা দিয়েছিলেন কবি। সাফ জানিয়েছিলেন, সস্তা দেশপ্রেম নয়, মানবতাবোধই তাঁর কাছে প্রধান বিষয়।
আজকে এমন কথা বললে নির্ঘাত তাঁকে জেলে যেতে হত, যেমনটা হয়েছিল রেভারেন্ড স্ট্যান স্বামীকে। ৮৩ বছর বয়স। অসুস্থ জেসুইট যাজক। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার ভারতীয় কারাগারে আদিবাসীদের পক্ষে ওকালতি করার প্রতিশোধ হিসেবে তাঁকে টার্গেট করে। ৬ অক্টোবর, ২০২০ তিনি গ্রেফতার হন, তারপর বারবার জামিন নাকচ করা হয়। এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে, তিনি মারা যান। ‘ওরা আমাকে পথ থেকে সরিয়ে দিতে চায়’ বলতেন সেই বৃদ্ধ মানবতাবাদী।

আরও পড়ুন-

১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১ মোদি-শাহের পুলিশ যেমন ২১ বছর বয়সি দিশা রবিকে দক্ষিণ ভারতের বেঙ্গালুরু শহর থেকে গ্রেফতার করে, ভারতের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং আঞ্চলিক যুদ্ধ শুরু করার একটি বৃহত্তর অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের সাথে যুক্ত থাকার অভিযোগে। তিনি পরিবেশকর্মী ছিলেন।
ভাবসাব দেখে মনে হয়, রবীন্দ্রনাথও রেহাই পেতেন না এই আবহে। কারণ ১৮৯৩ সালে বত্রিশ বছর বয়সে একটি কবিতায় তিনি লিখেছিলেন, ‘আমি পরানের সাথে খেলিব আজিকে/ মরণখেলা/ নিশীথবেলা।’ এই পঙক্তিতে নির্ঘাত রাতের বেলা সন্ত্রাসবাদী হানার কথা খুঁজে নিতেন অমিত শাহের দুঁদে গোয়েন্দারা!
আর অমিত মালপোয়া তো রবীন্দ্রনাথকে সেটা আগে জানতেন না। এখন রবি-কবির বিষয়ে অবগত হলেও, সম্যক জানাশোনা এখনও হয়নি। তাই সেই অমিত মালপোয়ার অমেয় অজ্ঞতার পরিমাণ কিঞ্চিৎ কমাতে জানাই, গীতাঞ্জলি নহে, সংস অফারিংস-এ তাঁর ওই সম্মানপ্রাপ্তি।
এবং কবির পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর বিয়ে করেছিলেন খুলনার ফুলতলা উপজেলার দক্ষিণডিহি গ্রামের সারদা দেবীকে। ১৮৮৩ সালে কবির মামাবাড়ির দিঘির অপর পাড়ের বেণীমাধব রায়চৌধুরীর কন্যা মৃণালিনী দেবীর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। এভাবে আত্মীয়তার নিগূঢ় বন্ধনে কবি আবদ্ধ ছিলেন বাংলাদেশের সঙ্গে। মানে, রবি ঠাকুর বাংলাদেশি। অবশ্যই বাংলাদেশি। আত্মীয় বন্ধনের সূত্রেই বাংলাদেশি।
৫২টি কবিতার বই, ৩৮টি নাটক, ১৩টি উপন্যাস, ৯৫টি ছোটগল্প, ৩৬টি প্রবন্ধ এবং ১৯১৫টি গান বাংলাদেশি ভাষার সাহিত্যকে (মাফ করবেন, শমীক ভট্টাচার্য) এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন এই কবি।
সাভারকররা যখন ব্রিটিশদের পা ধরে ক্ষমা চেয়ে ইংরেজদের দালালি করবে বলে ঠিক করে নিয়েছিলেন, তখন, যে রবীন্দ্রনাথ বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলন থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন, সেই রবীন্দ্রনাথ ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে নাইট উপাধি ফিরিয়ে দেন।
ফেনিল উচ্ছ্বাসে বিজেপির এসব অজ্ঞানতার পরিচয় বেফাঁস হলে তাদের বাংলা-বিরোধী পরিচয় আরও বেফাঁস হবে, আরও বেকায়দায় পড়বে তারা, সেজন্য বাম-বিজেপি গতকালই জনদৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিতে বিশৃঙ্খলার আয়োজন করেছিল।

আরও পড়ুন-অপারেশন সিঁদুরে ধ্বংস হয় ৬ পাক বিমান

উইলিয়াম শেক্সপিয়ার মানুষের জটিল চরিত্রকে দারুণভাবে নাটকে ফুটিয়ে তুলেছেন। শেক্সপিয়ার দেখাতে চেয়েছেন যে মানুষ সুযোগ পেলে যে-কোনও সময় কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠতে পারে। মানুষের মাঝে বিশেষ ধরনের ইগো বা অহং বোধ কাজ করে যেটা মানুষকে স্বরূপ বদলাতে তাড়িত করে। যেমনটা হয়েছে বিজেপি নেতাদের ক্ষেত্রে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাব্যেও এই অহংবাদটি দারুণভাবে চিত্রিত হয়েছে। তিনি লেখেন, ‘রথযাত্রা লোকারণ্য মহা ধুমধাম, ভক্তরা লুটায়ে করিছে প্রণাম, পথ ভাবে আমি দেব, রথ ভাবে আমি, মূর্তি ভাবে আমি দেব, হাসে অর্ন্তযামী।’
নির্যাতিতা তরুণী চিকিৎসককে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা আবেগকে সলতে হিসেবে ব্যবহার করে যে নৈরাজ্যের আরতি করার আয়োজন, সেটা দেখেও কিন্তু ওই লাইনগুলো বারবার মনে পড়ে যাচ্ছে।
এই কুভেন্দু, মালপোয়া, অলীক, ও অবলাকান্ত কি জানে, লালনের মানবতাবাদী এবং ভাববাদী দর্শন দ্বারা রবীন্দ্রনাথ ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন? ধর্মনিরপেক্ষতা ও সর্বজনীনতার দর্শন প্রচার করেছেন তিনি তাঁর ‘মুসলমানী’ গল্পে?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মানবতাবাদের শিক্ষা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে মানুষকে অনুপ্রাণিত করবে এবং বাঙালি জাতি তাকে চিরকাল মনে রাখবে। তাই বিশৃঙ্খখল উচ্ছৃঙ্খল প্রতিবেশ সৃজনে ব্যস্ত বাম-রাম অরাজকতার ভুবনে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথকেই বলি, ‘কান্ডারী গো এবার যদি পৌঁছে থাকি কূলে, হাল ছেড়ে দাও, এখন আমার হাত ধরে লও তুলে।’

Latest article