লেখক হতে চাননি সমরেশ মজুমদার

বাংলা সাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয় লেখক সমরেশ মজুমদার। উপন্যাস লিখেছেন। পাশাপাশি লিখেছেন গল্প, নাটক, প্রবন্ধ। পেয়েছেন বেশকিছু পুরস্কার ও সম্মাননা। দীর্ঘদিন অসুস্থ ছিলেন। চলে গেলেন ৮ মে। স্মরণ করলেন অংশুমান চক্রবর্তী

Must read

গল্প লিখে কফি
প্রচলিত ধারণা, যা কিছু জনপ্রিয়, তা উৎকৃষ্ট নয়। আবার যা উৎকৃষ্ট, তা জনপ্রিয় হতে পারে না। কথাটা কিছু কিছু ক্ষেত্রে হয়তো সত্যি। কিন্তু সব ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। যেমন খাটে না সমরেশ মজুমদারের ক্ষেত্রে। তাঁর লেখা যেমন জনপ্রিয়, তেমনই উৎকৃষ্ট। একবাক্যে স্বীকার করবেন অগণিত পাঠক এবং সমালোচকরা।

আরও পড়ুন-দুই পিতা দুই প্রজন্ম, রায়বাড়ি থেকে ঠাকুরবাড়ি

যদিও তিনি একটা সময় লেখক হতে চাননি। জড়িয়ে ছিলেন নাট্যদলের সঙ্গে। লিখতেন নাটক। কীভাবে সাহিত্যিক হলেন? একটি সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, ‘‘আমি তো লেখক হতে চাইনি। আমাকে লেখক করা হয়েছে। নাটক লিখতাম। কিন্তু নাটক করার জায়গা পাওয়া যেত না। এর মধ্যে একজন আমাকে বললেন, ‘তুমি নাটকটাকে গল্প করো।’ তাই করলাম। গল্পটা ছাপা হল একটি পত্রিকায়। গল্পের সাম্মানিক হিসেবে আমাকে ১৫ টাকা পাঠানো হয়েছিল। সেই টাকা পেয়ে আমার বন্ধুদের খুব উৎসাহ। তখন কফির দাম ছিল মাত্র আট আনা। তো বন্ধুরা দু দিন ধরে কফি খেল। খেয়ে আমাকে বারবার বলতে লাগল আরও গল্প লিখতে। এভাবেই আমি লেখক হয়ে উঠলাম।”

আরও পড়ুন-মৃণাল সেন ১০০

চা-বাগানের দিনগুলো
জন্ম ১৯৪২ সালের ১০ মার্চ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আবহে। জলপাইগুড়ি জেলার গয়েরকাটা চা-বাগানে। বাবা কৃষ্ণদাস মজুমদার ও মা শ্যামলী দেবী। ঠাকুরদা ছিলেন পেশায় চা-বাগানের ম্যানেজার। তাঁর কাছেই কঠোর অনুশাসন ও নিয়মানুবর্তিতার মধ্যে মানুষ হয়েছিলেন। ঠাকুরদার প্রভাব তাঁর জীবনে ছিল সবচেয়ে বেশি। জলপাইগুড়ির হাকিমপাড়ার বাড়িতে কেটেছে বাল্য, কৈশোর ও যৌবন শুরুর সোনালি দিনগুলো। খেলাধুলার প্রতি ছিল প্রবল আকর্ষণ। মাঠ মাতাতেন স্থানীয় বালকদের সঙ্গে। চা-বাগানে থাকার সময় বাহে ও রাজবংশী সম্প্রদায়ের মানুষের সঙ্গে তৈরি হয়েছিল নিবিড় বন্ধুত্ব। ভবানী মাস্টারের পাঠশালায় তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু। তারপর বিদ্যালয়ের পাঠ জলপাইগুড়ি জেলা স্কুলে।
ছয়ের দশকে চলে আসেন কলকাতায়। স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে বাংলায় অনার্স নিয়ে বিএ পাশ করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে করেন স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ। দেখা দিয়েছিল আর্থিক অস্বচ্ছলতা। বাধ্য হয়ে সেই সময় তাঁকে বিভিন্ন মেসে থাকতে হয়েছে। থেকেছেন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের হস্টেলেও।

আরও পড়ুন-নববর্ষের সংকল্প

ট্রিলজি ও অন্যান্য লেখা
১৯৬৭ সালে তাঁর প্রথম গল্প ছাপা হয় ‘দেশ’ পত্রিকায়। পরে ‘দেশ’ পত্রিকার সম্পাদক সাগরময় ঘোষের আমন্ত্রণে লেখেন ‘দৌড়’ উপন্যাসটি। এরপর ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তাঁর বিখ্যাত ট্রিলজি ‘উত্তরাধিকার’, ‘কালবেলা’ এবং ‘কালপুরুষ’। ‘কালপুরুষ’-এর পরে ২০১৩ সালে এর চতুর্থ পর্ব ‘মৌষলকাল’ লেখেন। এছাড়াও তাঁর অন্যান্য উপন্যাসের মধ্যে ‘সাতকাহন’, ‘গর্ভধারিণী’, ‘ফেরারি’, ‘এই আমি রেণু’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। তাঁর এইসব উপন্যাসে উঠে এসেছে উত্তরবঙ্গের জল, হাওয়া, গাছপালা ও মাটির গন্ধ। পাশাপাশি ধরা পড়েছে তিস্তা, তোর্সা, করলা, আংরাভাসা নদী কিংবা জলদাপাড়া, বীরপাড়া, মালবাজার, গরুমারা ইত্যাদি বিস্তীর্ণ অঞ্চলের পাহাড়, নদী, অরণ্য, নদী, জঙ্গল, চা-বাগানের সৌন্দর্য, রহস্য ও আবেগ। বুনেছেন প্রেম, হতাশা, আধুনিক নগরজীবনের গোপন আলো-ছায়া ও ঘাত-প্রতিঘাতের কথা। চা- বাগানের মদেসিয়া সমাজ থেকে কলকাতার নিম্নবিত্ত মানুষেরা তাঁর কলমে উঠে এসেছেন রক্ত-মাংস নিয়ে। উপন্যাসের পাশাপাশি লিখেছেন ছোটগল্প ও নাটক, প্রবন্ধ। তাঁর উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিগত গদ্যের বই ‘কইতে কথা বাধে’। শিশু-কিশোরদের জন্যও লিখেছেন বহু অ্যাডভেঞ্চার জাতীয় গল্প। তাঁর গোয়েন্দা-গল্পের নায়ক ‘অর্জুন’। জনপ্রিয় চরিত্র।

আরও পড়ুন-কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্তা রুখতে নেই কোনও উপযুক্ত তদন্ত কমিটি ক্ষোভ আদালতের

পুরস্কার ও সম্মাননা
জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক মানের অনেক পুরস্কার পেয়েছেন। যেমন আনন্দ পুরস্কার, সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার, বঙ্কিম পুরস্কার, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বঙ্গবিভূষণ সম্মাননা এবং আইআইএমএস পুরস্কার। চিত্রনাট্য-লেখক হিসাবে পেয়েছেন বিএফজেএ, দিশারী এবং চলচ্চিত্র প্রসার সমিতির অ্যাওয়ার্ড।
রসিক এবং রাগী
মানুষ হিসেবে ছিলেন বড় মনের। মজা করতেন। মাঝেমধ্যে রেগেও যেতেন। দে’জ পাবলিশিং হাউস-এর কর্ণধার সুধাংশুশেখর দে বললেন, ‘‘আমার সঙ্গে প্রায় চল্লিশ বছরের সম্পর্ক। আমাদের দপ্তরে নববর্ষের আড্ডায় নিয়মিত আসতেন। খাতায় কতকিছু লিখে দিতেন। ওঁর প্রায় কুড়িটি বই প্রকাশ করেছি। লেখক-প্রকাশকের বাইরে আমাদের মধ্যে গড়ে উঠেছিল পারিবারিক সম্পর্ক। দারুণ জনপ্রিয় ছিলেন। লেখাও ছিল উৎকৃষ্ট। বইমেলায় নিয়মিত আসতেন। ভাব বিনিময় করতেন পাঠকদের সঙ্গে। বলতেন মজার মজার কথা। রসিক ছিলেন খুব। তবে বই বেরতে দেরি হলে অবশ্য রেগে যেতেন। বহু জায়গায় একসঙ্গে গেছি। কিছুদিন আগে দিঘায় যেতে চেয়েছিলেন আমার সঙ্গে। সেটা আর হল না।”

আরও পড়ুন-জিতে প্লে-অফের দৌড়ে রইল পাঞ্জাব

চলত নানারকম খেলা
পত্রভারতীর কর্ণধার ত্রিদিবকুমার চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গেও ছিল নিবিড় সম্পর্ক। তিনি জানালেন, ‘‘গত বছরদুয়েক ধরে প্রায় রোজ সকালেই ফোনে কথা হত। উনি ফোন করেছেন, আমি করতে ভুলে গেছি, অমনি প্রবল অভিমান, তোমার তো এখন অনেক বড় ব্যাপার! আমাকেই খোঁজ নিতে হবে! আবার এই ফোনালাপেই আমাদের মধ্যে চলত নানারকম খেলা! কখনও খাওয়া নিয়ে, কখনও লেখা নিয়ে, কখনও বাইরে যাওয়া নিয়ে। সমরেশদার হাত ধরেই প্রথম আমার আমেরিকা, কানাডা যাওয়া। ‘চলো, দেখবে, ওদেশে কত বাঙালি বাংলা বইয়ের জন্য মুখিয়ে আছে।’ কিন্তু দাদা, ফ্লাইটের ভাড়া? কোত্থেকে পাব? ‘আরে দাঁড়াও, সে ব্যবস্থা করছি।’ করলেনও। তারপর গিয়ে উঠলাম দাদার রক্তের সম্পর্কহীন বাংলাদেশি কন্যা শ্যামার বাড়ি। দু-দুবার। তার ওখানে একসঙ্গে দিনের পর দিন, রান্নাবান্না করে খাওয়া, উঃ, এখন মনে হয়, সব স্বপ্ন। সেখানেও কত ঘটনা, কাহিনি। প্রকাশ করেছি ওঁর বই।”

আরও পড়ুন-এখনও চুক্তি হয়নি মেসির সঙ্গে, জানাল সৌদি ক্লাব

ছিলেন স্নেহপ্রবণ
সাহিত্যিক জয়ন্ত দে বললেন, ‘‘ওঁর তিনটে লেখা ‘উত্তরাধিকার’, ‘কালবেলা’, ‘কালপুরুষ’ আমাদের নাড়িয়ে দিয়েছিল। গল্পগ্রন্থ পড়েছিলাম। নাম ‘বড় পাপ হে’। অসাধারণ বই। একটা সময় পর্যন্ত সেইভাবে আলাপ পরিচয় ছিল না। গুরুগম্ভীর মানুষ। হাঁকডাক করে কথা বলতেন। একটু ভয় পেতাম। কাছাকাছি যেতে সাহস হত না। ত্রিদিবকুমার চট্টোপাধ্যায় একদিন আমাকে ওঁর বাড়িতে নিয়ে গেলেন। তখন মানুষটাকে নতুনভাবে চিনলাম। বুঝলাম উনি খুব স্নেহপ্রবণ। আমাদের লেখা পড়তেন। প্রতিক্রিয়া জানাতেন। আমার একটি ধারাবাহিক ওঁর খুব পছন্দ হয়েছিল। যখন বই আকারে বেরোয়, ওঁকে উৎসর্গ করি। উনি ছিলেন আমাদের অভিভাবক। অনেক কিছু শিখেছি। ওঁর লেখার ভাবনা একটু অন্যরকম ছিল। অসম্ভব ভাল গদ্য লিখতেন। গল্প বলতেন দারুণ।”

আরও পড়ুন-এখনও চুক্তি হয়নি মেসির সঙ্গে, জানাল সৌদি ক্লাব

থেকে যাবে তাঁর সৃষ্টি
সিওপিডিতে ভুগছিলেন দীর্ঘদিন। অসুস্থতার কারণে কলকাতার একটি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। সেখানেই ৮ মে প্রয়াত হন সাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার। তিনি নেই। একনিষ্ঠ পাঠক হিসেবে কষ্ট হয়। তবে থেকে যাবে তাঁর সৃষ্টি। যতদিন বাংলা ভাষা থাকবে, বাংলা সাহিত্য থাকবে।

Latest article