শহর কলকাতার আনাচে কানাচে ফুটেছে নানা রঙের ফুল। গানের ফুল। শীতের হিমেল হাওয়ায় ভাসছে সুরের গুঁড়ো। মন মাতাল করা পুরোনো-নতুন গানের সুর। পরস্পরের মধ্যে কথা হচ্ছে গানে গানে। সুরে সুরে মন বিনিময়। কানের আরাম। প্রাণের আরাম। এত কিছুর কারণ, এই মুহূর্তে মহানগরে চলছে ‘বাংলা সঙ্গীত মেলা’।
২০২৫-এর ১ জানুয়ারি। ইংরেজি নতুন বছরের প্রথম দিন। রবীন্দ্র সদন প্রাঙ্গণে আয়োজিত হয়েছে বর্ণময় অনুষ্ঠান। উপলক্ষ বাংলা সঙ্গীত মেলার কার্টেন রেইজার। এককথায় উদ্বোধন। পরিবেশিত হয়েছে বাউল গান, শ্রীখোল বাদন, ধামসা মাদল সহযোগে আদিবাসী নৃত্য। শেষে পুরুলিয়ার ছৌ-নাচ। অংশ নেন বিভিন্ন জেলার লোকশিল্পীরা।
আরও পড়ুন-মুড়িগঙ্গায় বিরল নীল তিমি, আগলে রেখে সাগরে ফেরাল বন দফতর
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন রাজ্যের মন্ত্রী ইন্দ্রনীল সেন, সংস্কৃতি অধিকর্তা কৌশিক বসাক। এ ছাড়াও ছিলেন শিবাজী চট্টোপাধ্যায়, অরুন্ধতী হোম চৌধুরী, স্বপন সেন, সৈকত মিত্র, পরিমল ভট্টাচার্য, শান্তনু রায়চৌধুরী প্রমুখ সঙ্গীতশিল্পী। কণ্ঠসঙ্গীত শিল্পীদের পাশাপাশি ছিলেন যন্ত্রসঙ্গীত শিল্পী, বাচিক শিল্পীরাও। ভিড় জমিয়েছিলেন সাধারণ মানুষও।
রবীন্দ্র সদনে সাংবাদিক সম্মেলনে মন্ত্রী ইন্দ্রনীল সেন বলেন, বাংলা উৎসবের পীঠস্থান৷ যে যাই বলুক বাংলার মানুষের মন উৎসবেই রয়েছে৷ তার প্রমাণ দুর্গাপুজো। মানুষ বাংলার উৎসব সংস্কৃতির প্রতি তাঁদের সর্বাত্মক সমর্থন জানিয়েছেন। সঙ্গীত মেলা বাংলার উৎসব সংস্কৃতির একটা জরুরি অঙ্গ৷ অনেকেই বলেছিলেন, এই বছর নাকি সঙ্গীত মেলা হবে না৷ কিন্তু, সেই সব জল্পনা উড়িয়ে সঙ্গীত মেলা যথারীতি হচ্ছে। এরপর কলকাতার পাশাপাশি ৪টি জেলায় অনুষ্ঠিত হবে।
২ জানুয়ারি থেকে বাংলা সঙ্গীত মেলার অনুষ্ঠান চলছে রবীন্দ্র সদন প্রেক্ষাগৃহ, শিশির মঞ্চ, মহাজাতি সদন, হেদুয়া পার্ক, মধুসূদন মুক্তমঞ্চ, একতারা মুক্তমঞ্চ, দেশপ্রিয় পার্ক, ঋষি অরবিন্দ পার্ক নেতাজি নগর, মোহরকুঞ্জ, রাজ্য সঙ্গীত আকাদেমি মুক্তমঞ্চ এবং রবীন্দ্র সদন প্রাঙ্গণে। ১১টি মঞ্চে প্রায় ৫ হাজার শিল্পী অংশগ্রহণ করছেন। প্রবীণ শিল্পীদের পাশাপাশি আছেন নবীন শিল্পীরা। উজাড় করছেন গানের ডালি। বিভিন্ন ধরনের বাংলা গান। প্রতিটি কেন্দ্রেই উপচে পড়ছে নানা বয়সি শ্রোতার ভিড়। নন্দন-রবীন্দ্র সদন প্রাঙ্গণ সেজেছে অন্য সাজে। রয়েছে বই, পিঠেপুলি, হস্তশিল্পসামগ্রীর স্টল।
আরও পড়ুন-বীরভূমের দেউচা-পাঁচামি নিয়ে বৈঠক করলেন মুখ্যসচিব ও ডিজি
বৃহস্পতিবার ভরে উঠেছিল রবীন্দ্র সদন প্রেক্ষাগৃহ। বাংলা সঙ্গীত মেলায় গান শোনাতে এসে নিজের ভাললাগার কথা জানান রাজ্যের মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়। তিনি দুটি গান শোনান। মাতিয়ে দেন নচিকেতা চক্রবর্তী। শোনান ‘যখন সময় থমকে দাঁড়ায়’ এবং ‘যদিও জানি দুঃসহ এ রাত্রি’ গান দুটি। আয়োজনের প্রশংসা শোনা গেল তাঁর মুখেও। বর্ষীয়সী দুই শিল্পী বিভা সেনগুপ্ত এবং স্বপ্না ঘোষাল। নিজেদের গান পরিবেশনের পাশাপাশি শুনলেন নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের গান। কাউকে কাউকে কাছে ডেকে আলাদাভাবে কথা বললেন। বাংলা সঙ্গীত মেলার জন্য সারা বছর অপেক্ষায় থাকেন ইন্দ্রাণী সেন। জানালেন সেই কথা। শোনালেন দুটি নজরুলগীতি। রঞ্জন প্রসাদ, স্বপন বসু, শম্পা কুণ্ডু, অর্জুন চক্রবর্তীর পরিবেশনাও ছিল মনে রাখার মতো।
একতারা মুক্তমঞ্চে ছিল বাংলা ব্যান্ড ভূমি-র গান। তাঁদের অনুষ্ঠান ঘিরে উন্মাদনা চোখে পড়ে। ভিড় দেখা যায় রবীন্দ্র সদন প্রাঙ্গণ মুক্তমঞ্চেও। অন্যান্য প্রেক্ষাগৃহ এবং মুক্তমঞ্চেও দর্শক সমাগম ছিল উল্লেখ করার মতো। প্রতিটি মঞ্চে দর্শক-শ্রোতার ভিড় ছিল শুক্রবারও। প্রবীণ এবং নবীন শিল্পীরা জয় করে নেন শ্রোতাদের মন।
বাংলা সঙ্গীত মেলা উপলক্ষে আয়োজিত হয়েছে বিশেষ প্রদর্শনী ‘শতবর্ষের শ্রদ্ধাঞ্জলি : উৎপলা সেন, সুচিত্রা মিত্র, ছবি বন্দ্যোপাধ্যায়, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়’৷ গগনেন্দ্র প্রদর্শশালা সেজে উঠেছে এই চার কিংবদন্তি শিল্পীর কথায় আর ছবিতে। মুখ্যত আধুনিক গানের শিল্পী উৎপলা সেন। স্বনামধন্য সুধীরলাল চক্রবর্তীর প্রিয় শিষ্যা। উৎপলার দরদি কণ্ঠে স্মরণীয় ‘একহাতে মোর পূজার থালা’, ‘ময়ূরপঙ্খী ভেসে যায়’ বা ‘প্রান্তরের গান আমার’। সুচিত্রা মিত্র প্রধানত রবীন্দ্রনাথের গানের মানুষ। তাঁর দীপ্ত গায়নে স্মৃতিধার্য হয়ে থাকবে ‘কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি’, ‘সার্থক জনম আমার’ বা ‘যদি তোর ডাক শুনে’। ছবি বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে স্বামী লোকেশ্বরানন্দ ঠিকই বলেছিলেন যে, ছবি প্রথমে সাধিকা, পরে গায়িকা। এই শিল্পী কীর্তন গানে অপ্রতিম, আবার তাঁর কান্তগীতিও হৃদয়-ছোঁয়া। এসবের পাশাপাশি মনে থাকবে ‘রাইকমল’ ছবিতে তাঁর ভক্তিনম্র গানগুলো। কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্বক্ষেত্র রবীন্দ্রসংগীত। ছোটবেলা থেকেই শান্তিনিকেতনে বড় হয়ে ওঠা, রবীন্দ্রসান্নিধ্যধন্য কণিকার লাবণ্যময় গলায় স্মরণযোগ্য হয়ে থাকে ‘আনন্দধারা বহিছে ভুবনে’, ‘বাজে করুণ সুরে’ বা ‘ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে’। শতবর্ষে উপনীত এই চার শিল্পীর কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপনই এই প্রদর্শনীর মূল লক্ষ্য। গবেষণা ও বিন্যাস স্বপন সোমের। খোলা থাকছে দুপুর ২টো থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। ঘুরে দেখছেন বহু মানুষ।
আরও পড়ুন-বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানে ডুয়ার্স উৎসবের সূচনা
সব মিলিয়ে জমে উঠেছে বাংলা সঙ্গীত মেলা ২০২৪-’২৫। বছরের শুরুতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগের এক আন্তরিক আয়োজন। চলবে ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত। প্রতিদিন অনুষ্ঠান শুরু হচ্ছে বিকেল ৫টায়। প্রবেশ অবাধ।