হাড়-কাঁপানো শীতের রাত। একতারা মুক্তমঞ্চে ভূমি যখন গাইতে উঠল, তখন ঘড়ির কাঁটায় ন’টা পেরিয়েছে। তা সত্ত্বেও উৎসাহে ভাটা নেই শ্রোতাদের। নেই কারও ফেরার তাড়া। নন্দন-চত্বরে গিজগিজ করছে লোক। যেন জনসমুদ্র! কতরকমের সাজ! কেউ কেউ আবার পরেছেন সান্টা-টুপি! ক্লান্তিহীন প্রত্যেকেই। গানের নেশায় বুঁদ। সময় যত গড়িয়েছে, ততই গভীরে গেছে সুরের শেকড়। তালে তালে নেচেছে শরীর, মন।
নন্দনের মূল প্রবেশ পথের পাশে, রবীন্দ্র সদনের ঠিক পিছনের খোলা মঞ্চে তার কিছুক্ষণ আগেই গান ধরেছিলেন গৌতম ঘোষ। আটের দশকে কিশোর কুমারের গাওয়া হিট গান। এনজয় করছিলেন নানা বয়সের শ্রোতা। আলো-ঝলমলে দুই মঞ্চে অন্যান্য শিল্পীর গানেও দেখা গেছে শ্রোতাদের উল্লাস, উৎসাহ। এই ছবি বড়দিনের। ২৫ ডিসেম্বরের। বাংলা সংগীত মেলার (sangeet mela)। ওইদিনই শুরু হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ আয়োজিত বাংলা গানের এই মহাপার্বণ।
আগের দিন, অর্থাৎ ২৪ ডিসেম্বর, রবীন্দ্র সদনের সামনে অনুষ্ঠিত হয়েছে বর্ণময় কার্টেন রেজার। ছিলেন রাজ্যের মন্ত্রী ইন্দ্রনীল সেন, সংস্কৃতি-অধিকর্তা কৌশিক বসাক, তথ্য-অধিকর্তা শর্মিষ্ঠা বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রত্নতত্ত্ব-অধিকর্তা অম্লান সাহা, সংগীতশিল্পী শিবাজী চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। অনুষ্ঠানে অংশ নেন লোকশিল্পীরা। পরিবেশিত হয় শ্রীখোল, আদিবাসী নৃত্য, বাউল, রায়বেঁশে, নাটুয়া এবং ছৌ। উপস্থিত প্রত্যেকেই শিল্পীদের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। অভিনন্দিত করেছেন। অথচ এই লোকশিল্পীরা একটা সময় ছিলেন উপেক্ষিত, অনালোকিত। ২০১১-এর পর রাজ্য সরকারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এসেছেন আলোয়।
কলকাতার রবীন্দ্র সদন, শিশির মঞ্চ, একতারা মুক্তমঞ্চ, বাংলা আকাদেমি সভাঘর, হেদুয়া পার্ক, মধুসূদন মুক্তমঞ্চ, দেশপ্রিয় পার্ক, যোধপুর প্রগতি সংঘের মাঠ (লর্ডসের মোড়), রবীন্দ্র-ওকাকুরা ভবন, রাজ্য সঙ্গীত আকাদেমি মুক্তমঞ্চ এবং চারুকলা ভবন সংলগ্ন মঞ্চে প্রতিদিন বিকাল ৫টা থেকে পরিবেশিত হচ্ছে বাংলা সংগীত মেলা ও বিশ্ববাংলা লোক সংস্কৃতি উৎসবের অনুষ্ঠান। রাজ্যের বিভিন্ন জেলার প্রায় পাঁচ হাজারেরও বেশি সংগীতশিল্পী, সঞ্চালক, যন্ত্রশিল্পী অংশগ্রহণ করছেন। একক পরিবেশনার পাশাপাশি বিভিন্ন মঞ্চে থাকছে বাংলা ব্যান্ডের গান।
রবীন্দ্র সদন-নন্দন প্রাঙ্গণে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলার হস্তশিল্পী ও কারিগরেরা তাঁদের রকমারি হস্তশিল্প ও রকমারি পিঠে-পুলি ও খাবারের পশরা নিয়ে হাজির থাকছেন। এছাড়া রয়েছে তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগের বিভিন্ন আকাদেমির প্রকাশিত বইয়ের স্টল।
মন্ত্রী ইন্দ্রনীল সেন বলেন, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সংগীত মেলার আয়োজনে নানাভাবে সহযোগিতা করেছেন এবং উদ্যোগ নিতে বলেছেন। এই বছর সংগীত মেলায় ৫০০ নতুন শিল্পী অংশ নিচ্ছেন। যাঁরা প্রথম সুযোগ পেলেন, আশা করি তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ আগামী দিনের তারকা হয়ে উঠবেন। এখানে বেশকিছু স্টল আছে। সেই স্টলগুলোর মাধ্যমে বেশকিছু মানুষ অর্থনৈতিকভাবে উপকৃত হবেন।
শিবাজী চট্টোপাধ্যায় বলেন, এটা সংগীতের মেলা। তবে এখানে রয়েছে শিল্পকলাও। হস্তশিল্পের সম্ভার, বই, পিঠেপুলি ইত্যাদি। সবমিলিয়ে বছর শেষে শহর উৎসবমুখর। শিল্পীদের কাছে সংগীত মেলা দুর্গাপুজোর মতো। আশা করি এই মেলা চরম উৎকর্ষে পৌঁছবে।
গগনেন্দ্র শিল্প-প্রদর্শশালায় ‘শতবর্ষে শ্রদ্ধাঞ্জলি : নচিকেতা ঘোষ, সলিল চৌধুরী ও গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার’ শীর্ষক একটি প্রদর্শনী আয়োজিত হয়েছে। স্বপন সোমের গবেষণা ও বিন্যাসে। চোখে পড়ছে দর্শকের ভিড়। প্রদর্শনীটি ঘুরে দেখেন নচিকেতা ঘোষের পুত্র সুপর্ণকান্তি ঘোষ। খোলা থাকছে প্রতিদিন দুপুর ২টো থেকে রাত্রি ৯টা পর্যন্ত।
প্রথমদিন রবীন্দ্র সদন প্রেক্ষাগৃহ ছিল প্রায় পূর্ণ। প্রবীণ-নবীন শিল্পী সমন্বয়ে নানা রঙের গানে জমে ওঠে অনুষ্ঠান। নব্বই পেরিয়েছেন বিভা সেনগুপ্ত। শোনালেন দুটি রবীন্দ্র-গান। তাঁর মার্জিত পরিবেশনা শ্রোতাদের মুগ্ধ করেছে।
তিনটি গান গাইলেন স্বাগতালক্ষ্মী দাশগুপ্ত। প্রভু যিশুর জন্মদিনে গানের মাধ্যমেই দিলেন সম্প্রীতির বার্তা, আঁকেন প্রতিবাদ। স্বপন বসু, মনোময় ভট্টাচার্য, অর্জুন চক্রবর্তী, অরিত্র দাশগুপ্ত, সাহানা বক্সী, সৌমী ভট্টাচার্য প্রমুখের পরিবেশনাও শ্রোতাদের আনন্দ দিয়েছে। নিজেদের উজাড় করেছেন নতুন শিল্পীরাও। কুড়িয়েছেন বাহবা।
প্রথমদিন অন্যান্য মঞ্চেও শ্রোতাদের উপস্থিতি ছিল উল্লেখ করার মতো। শুক্রবার, দ্বিতীয় দিনেও দেখা গেছে একই ছবি। সবমিলিয়ে বাঙালির প্রাণের মেলা বাংলা সংগীত মেলা ও বিশ্ববাংলা লোক সংস্কৃতি উৎসব দারুণভাবেই জমে উঠেছে। চলবে ১ জানুয়ারি পর্যন্ত। সুরে সুরে (sangeet mela) সাড়ম্বরে বরণ করে নেওয়া হবে নতুন বছরকে।
গানের মেলা প্রাণের মেলা
আলো-ঝলমলে মঞ্চ। প্রবীণ-নবীন শিল্পী সমন্বয়। নানা রঙের গান। প্রদর্শনী। জমে উঠেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার আয়োজিত বাংলা সংগীত মেলা। বছর শেষে শহর উৎসবমুখর। ঘুরে এসে লিখলেন অংশুমান চক্রবর্তী

