১ মে, ২০১০। নরেন্দ্র মোদির লেখা একটি বইপ্রকাশ হয়েছে সদ্য। বইটির নাম—‘সামাজিক সমরস্তা’ অর্থাৎ ‘সামাজিক সৌহার্দ্য’। বইপ্রকাশের অনুষ্ঠানে মোদিজি বলে বসলেন— “দলিতরা হল শিশুর মতো, নিজেদের ভালোমন্দ বুঝতে পারে না। তাদের উন্নতি এবং সামাজিক অস্পৃশ্যতা দূর করার জন্য হিন্দু আধ্যাত্মিক গুরুদের ব্যাপক প্রচারের প্রয়োজন আছে। [দ্র. RSS : A Primer, Hindu Nationalist Agenda Against Indian Constitution, Ram Puniyani, UP, 2019] ওই দিন রাজ্যসভায় বিজেপি-বিরোধী সাংসদেরা ব্যাপক হইচই বাধিয়ে দিলেন মোদিজির বক্তব্যের বিরোধিতা করে। তাঁদের অভিযোগ ছিল, এই মন্তব্য আসলে বর্ণবাদী সংঘের চোখ দিয়ে দলিতসমাজকে অপমান করা।
আরও পড়ুন-এবার গাইডরা ঘুরিয়ে দেখাবেন দিঘার জগন্নাথধাম
প্রথমেই জানতে হবে ‘সামাজিক সমরস্তা’ জিনিসটা কী? এটি আরএসএস-প্রভাবিত একটি প্ল্যাটফর্ম— ‘সামাজিক সমরস্তা মঞ্চ’। এই মঞ্চ গোটা ভারত জুড়ে সূক্ষ্ম জালের মতো ছড়ানো আছে। এমনিতেই প্রায় অর্ধশত গণ-সংগঠন বিভিন্ন নামে কাজ করে সংঘ পরিবারের মতাদর্শ ছড়ানোর কাজে। তাদের কেউ কেউ নিছক সামাজিক আন্দোলনের কাজ করে, কেউ কেউ আবার সশস্ত্র শক্তি প্রদর্শনের পথে হাঁটে, যেমন বজরং দল, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ। এই বিশেষ সংগঠনটি আরএসএস-এর হয়ে কাজ করে চলেছে দীর্ঘদিন ধরে। এদের উদ্দেশ্য খুবই পরিষ্কার— ভারতীয় সমাজের দলিত-পিছড়েবর্গকে নিজেদের উচ্চবর্ণবাদী রাজনীতির ফোল্ডে নিয়ে এসে কো-অপ্ট করা। দলিত রাজনীতি যাতে শ্রেণি-রাজনীতির দিকে না চলে যায়, যাতে সমাজের ৮০ ভাগ মানুষ রুটি-রুজির সংগ্রামে বিদ্রোহে ফেটে না পড়ে, যাতে ভাতের লড়াই জাতের লড়াইয়ের সঙ্গে যুক্ত না হয়ে যায়, সেই সম্ভাব্য বিপদকে আগে থেকেই বিপথগামী করে নিজেদের বর্ণগত এবং শ্রেণিগত আধিপত্য অক্ষুণ্ণ রাখা। বাবাসাহেব আম্বেদকার তাঁর বিখ্যাত বই ‘অ্যানিহিলেশন অফ কাস্ট’-এ (১৯৩৬) বলেছিলেন, “বিভিন্ন মানুষের অবস্থা এবং ঐতিহাসিক কাল অনুযায়ীও সুখ পরিবর্তিত হয়। তাই যদি হয় তাহলে মানবসম্প্রদায় কীভাবে শাশ্বত কালের আইনের বিধানকে টিকিয়ে রাখবে অথচ তার কোনো খিঁচুনি হবে না বা সে কোনোভাবেই পঙ্গু হয়ে যাবে না? সুতরাং আমার বলতে কোনও দ্বিধা নেই— এমন ধর্মের বিনাশ সাধনের জন্য কাজ করায় কোনও অধর্ম হয় না” [বি আর আম্বেদকর, নির্বাচিত রচনা সংকলন, সম্পাদনা, কপিলকৃষ্ণ ঠাকুর, কলকাতা, ২০১৮, পৃ.১০০] আম্বেদকারের বর্ণগত উন্নয়নের লড়াইয়ের ঠিক বিপরীত অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে সংঘ পরিবারের দর্শন, যারা বর্ণের লড়াইকে রাজনৈতিক হয়ে উঠতে বাধা দেয়, তাদের জাতিগত সংরক্ষণের মৌখিক বিরোধিতা না করলেও এ-ধরনের যেকোনও দলিত-উন্নয়নের এরা মন থেকে বিরোধী। আম্বেদকার বলেছিলেন, প্রাচীনকাল থেকে আজ অব্দি কোনও শাশ্বত ও অপরিবর্তনীয় ধর্ম থাকা সম্ভব নয়। আর হিন্দুত্ববাদের ধারক-বাহক বাবাজি, ধর্মগুরুরা গোটা উত্তরভারত, মধ্যভারত, পশ্চিম থেকে পূর্বভারত জুড়ে আসর এবং জলসায় বসে সেই অপরিবর্তনীয় শাশ্বত ধর্মীয় বিধানগুলোকেই ভারতের আনপড়, অশিক্ষিত, কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষের সামনে প্রচার করে বোঝায় কেন বিদ্যমান জাতিবর্ণ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলা উচিত নয়। দুর্ভাগ্যের বিষয় অসংখ্য উচ্চবর্ণীয়, শিক্ষিত মানুষও এইসব আসরের নিয়মিত শ্রোতা। পুঁথিগত বিদ্যা পেটে থাকলেও তাঁদের অন্তর্লোক ওই কুসংস্কার ও অন্ধ প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মবিশ্বাস দ্বারা আচ্ছন্ন। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ বাবাসাহেব আম্বেদকার কিংবা সত্যজিৎ রায় এই ২০২৫ সালে বেঁচে নেই। তাহলে আজীবন বর্ণহিদুত্বের বিরুদ্ধে লড়াই চালানো আম্বেদকার অথবা ‘দেবী’, ‘কাপুরুষ ও মহাপুরুষ’-এর মতো সিনেমা বানানোর অপরাধে মোদিজির ভারতে এই দুজনেরই ঠাঁই হত তিহার জেলে। এদের উপর হয়তো ‘সনাতন ধর্মকে অপমান করেছেন’— জাতীয় ট্যাগ লাগানো হত আর পার কমেন্ট দু’টাকা পারিশ্রমিক পাওয়া গোমূর্খ অন্ধভক্তের দল সোশ্যাল মিডিয়ায় এই দুজনের বাপ-বাপান্ত করে ছাড়ত। বেশিদিন আগের কথা নয়, সংঘ পরিবারেরই এক তাত্ত্বিক অরুণ শৌরি আম্বেদকারকে হেয় করার উদ্দেশ্যে একটি বই লেখেন— ‘Worshipping False Gods’। মনেপ্রাণে ব্রাহ্মণ্যবাদী অথচ মুখে সামাজিক সৌহার্দ্যের কথা বলে ঘুরপথে কয়েক হাজার বছরের সামাজিক শোষণ টিকিয়ে রাখার কারবারিরা আজও সংঘের ছত্রছায়ায় কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
আরও পড়ুন-বাংলার বকেয়া না দিলে ফের মেগা ধরনা দিল্লিতে, হুঁশিয়ারি অভিষেকের
২৬ জানুয়ারি, ১৯৫০ যেদিন ভারতীয় স্বাধীন রাষ্ট্রের সংবিধান যাত্রা শুরু করে, ঠিক তার পরেই আরএসএস-এর মুখপত্র ‘অর্গানাইজার’-এ একটি নিবন্ধ লেখেন হিন্দুত্ববাদী হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারক শঙ্কর শুভ্র আইয়ার। তিনি ‘মনুস্মৃতি’র মতো পবিত্র গ্রন্থকে ভারতীয় সংবিধানের ভিত্তি হিসেবে না মানার জন্য আম্বেদকারের তীব্র সমালোচনা করেছিলেন। [দ্র. Manu Rules Our Haters, Organiser, 6th February, 1950, pp.7]। এর ঠিক আগেই ওই একই ‘অর্গানাইজার’ পত্রিকা লিখেছিল ‘মনুস্মৃতি’কে স্বীকৃতি না দিয়ে ভারতীয় সংবিধান-প্রণেতা গর্হিত অন্যায় করেছেন। [Organiser, 30th November, 1949]। আরএসএস-এর প্রধান আপত্তি ছিল ভারত রাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিক-ধর্মনিরপেক্ষ-সার্বভৌম ও সকলের জন্য সমানাধিকারবিশিষ্ট একটি দেশ হিসেবে ঘোষণা করা নিয়ে। কিন্তু আসল খেলা আরও অনেক গভীরে। সাভারকার-গোলওয়ালকার সরাসরি বর্ণবাদী সমাজব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার কথা বলেননি। সূক্ষ্ম বাস্তব রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অধিকারী সঙ্ঘের এই দুই প্রধান তাত্ত্বিকই বলেছিলেন, তাঁরা ‘অস্পৃশ্যতা’র বিরোধী। সাভারকার তো রীতিমতো ‘অস্পৃশ্যতাবিরোধী অনুষ্ঠানে’ অংশগ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু ‘হিন্দু মহাসভা’কে এর সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত করেননি তিনি। ২০ জুন, ১৯৪১-এর বক্তৃতায় স্পষ্ট বলেছিলেন সাভারকার, তিনি হিন্দু মন্দিরে অস্পৃশ্য সমাজের প্রবেশাধিকার নিয়ে আন্দোলনে ‘হিন্দু মহাসভা’কে যুক্ত করে ‘সনাতনী হিন্দুদের’ মনে আঘাত করবেন না— “I gurantee that the Hindu Mahasabha shall never force any legislations regarding the entry of untouchables in the ancient temples or compel by law any sacred ancient and moral usage or custom prevailing in those temples. In general the Mahasabha will not back up any Legislations to thrust the reforming views on our Sanatani brothers so far as personal law is concerned” [A. S. Bhide (ed.) Vinayak Damodar Savarkar’s Whirlwind Propaganda: Extracts from the President’s Diary of his propagandist Tours Interviews from December 1937 to October 1941, Bombay, 1941]

