গির্জা, চার্চের দেশে মা কালীর আরাধনা! শুনলে বা জানলে অবাক হতে হয় না? দেবীর গায়ের রংও আবার কালো। দক্ষিণ ফ্রান্সের কামার্গে শহরে রোমানিরা মে মাসের একটি নির্দিষ্ট দিনে এই দেবীর পুজোয় মেতে ওঠেন। এক অপার বিশ্বাস এই দেবীর প্রতি রোমানিদের। স্বদেশ ছেড়ে বিদেশের মাটিতে কালীমায়ের বসতের পেছনে কী কাহিনি? বঙ্গের কালীঠাকুরের সঙ্গেও নাকি এই দেবীর অদ্ভুত সাদৃশ্য রয়েছে। দেখা যাক ইতিহাস কী বলছে?
সারা দ্য ব্ল্যাক। দক্ষিণ ফ্রান্সের কামার্গে অবস্থিত সেন্ট-মেরিস-দ্য-লা-মের গ্রামে প্রতিবছর একটি অনন্য ধর্মীয় উৎসব উদযাপিত হয়। এই উৎসবে হাজার হাজার রোমানি সম্প্রদায়ের মানুষ একত্রিত হন। যেখানে তাঁরা সেন্ট সারালা কালী নামে পরিচিত তাঁদের পবিত্র দেবী মা বা তাঁদের রক্ষাকর্ত্রীর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এই উৎসবটি শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় আচার নয়। এটি রোমানি জনগোষ্ঠীর ইতিহাস সংস্কৃতি এবং আত্মপরিচয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক।
আরও পড়ুন-কালীকথা
সেন্টা সারা লা কালীর প্রতি রোমানদের এই গভীর ভক্তি এবং বিশ্বাসের পেছনে এক ইতিহাস রয়েছে। রোমান জনগোষ্ঠী বহু শতাব্দী ধরে বৈষম্য ও নিপীড়নের শিকার হয়েছে। তাদের দীর্ঘকালীন সংগ্রাম ও জীবনধারার মধ্যে সারালা কালী তাদের কাছে আশ্রয়দাত্রী ও বরাভয়দাত্রী হিসেবে প্রতীয়মান হয়েছেন। তাঁরা জন্ম-যাযাবর। বারবার আক্রমণের লক্ষ্যে তাঁরা। ইউরোপ এবং ছড়িয়ে থাকা উপনিবেশে রোমানিরা দাস প্রথার শিকার।
আজও তাঁদের নিজস্ব কোনও দেশ নেই। আধুনিক ইউরোপে রোমানিদের প্রতি বৈষম্যমূলক মনোভাব এখনও রয়েছে। বহু যুগ ধরে অবজ্ঞা অপমান মিশে রয়েছে তাঁদের শরীরে।
কামার্গের সেন্ট মেরিস দ্য লা মের দেবী সারা রোমানদের মানসিক আশ্রয়। তাই এই দেবীর উৎসবে মন থেকে মেতে ওঠেন রোমানরা। বঙ্গের দশভুজা আরাধনায় আমাদের প্রবাসের আত্মজনেরা যেমন ঘরে ফেরার জন্য আকুল হয় তেমনি রোমানরাও সারার উৎসবে যোগদানের জন্য উন্মুখ হয়ে থাকেন।
সেন্ট সারা লা কালী রোমান জনগোষ্ঠীর জীবনে গুরুত্বপূর্ণই শুধু নয়, এর বিশ্বাস এদের গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। অকূলের কূল তিনি। অনাথের নাথ।
সারা-লা-কালী— সারা দ্য ব্ল্যাক
এঁকে নিয়ে অনেক মতামত এবং মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ বলে যে, তিনি একজন দাসী ছিলেন, যিনি খ্রিস্টের পরিবারের সেবা করতেন। কেউ কেউ বলেন যে, তিনি ছিলেন তাঁর কন্যা। যাকে গোপনে মেরি ম্যাগডালিন গর্ভে ধারণ করেছিলেন।
অন্যান্য কিংবদন্তি তাঁকে কালো চামড়ার হিন্দু দেবী কালীর সাথে যুক্ত করে। তাঁর মন্দির দক্ষিণ ফরাসি সমুদ্রতীরবর্তী শহর সেন্ট-মেরিস-দ্য-লা-মেরে-তে অবস্থিত।
জনশ্রুতি এই যে, যিশুর মৃত্যুর পর লাজারুস তার দুই বোন মার্থা ও মেরি, ম্যাক্সিমিন, মেরি সালো মে এবং মেরি জ্যাকব নৌকো করে এসে পৌঁছায় কামার্ক উপকূলবর্তী গ্রামে। পরে এই তিন মেয়ের নামে গ্রামের নাম হয় সেন্ট মেরিস দ্য লা মের।
জনশ্রুতিতে এও আছে যে, নৌকায় ছিল এক মিশরীয় দাসী যার নাম সারা। মিশর দেশের পুরনো শহর বারানিসের বাসিন্দা সারার গায়ের রং ছিল কালো। বারানিস অঞ্চলের লোকজনের আদি উৎস নাকি ভারতের মালাবার কোস্ট। এই সারাতেই পরবর্তীকালে রোমানির আছেন সারা বলে মানতে শুরু করে। ১৪৩৮ সালে প্রথম সারা কালীর সঙ্গে রোমানিদের জড়িয়ে থাকার উল্লেখ পাওয়া যায়।
এই সারাতেই পরবর্তীকালে রোমানির আছেন সারা বলে মানতে শুরু করে।
১৪৩৮ সালে প্রথম সারা কালীর সঙ্গে রোমানিদের জড়িয়ে থাকার উল্লেখ পাওয়া যায়।
সমুদ্রের শহর সেন্ট মেরিস— যেখানে রোন নদী ভূমধ্যসাগরের সাথে মিলিত হয়। প্রতি বছর মে মাসের শেষের দিকে, হাজার হাজার রোমানি তীর্থযাত্রী একটি নির্দিষ্ট রীতিতে তাঁকে শ্রদ্ধা ও উপাসনা করতে শহরে আসেন। তাঁর মূর্তিকে নতুন পোশাক পরিয়ে সমুদ্রে নিয়ে যাওয়া হয়।
রোমানি শরণার্থী এবং নতুন অভিবাসীরা তাঁকে বাস্তুচ্যুত, হতাশ, বিক্ষুব্ধ, ভ্রমণকারী (যাযাবর) এবং অভাবীদের রক্ষাকর্তা হিসেবে পুজো করে থাকেন। তবে, রোমানি ক্যাথলিকদের মধ্যে সারা-লা-কালীর জনপ্রিয়তা, শ্রদ্ধা থাকা সত্ত্বেও, রোমান ক্যাথলিক চার্চ তাকে সন্ত বলে মনে করে না। ঐতিহ্যবাহী তান্ত্রিক উপাসনার বাইরে বেরিয়ে সারা পূজিতা হন খ্রিস্টান ধারার সম্পূর্ণ বিপরীতে।
‘দ্য ব্ল্যাক ম্যাডোনা’র লেখক মার্টিনা পেটকোভার মতে, এর কারণ হল রোমানরা— যারা তাঁর বেশিরভাগ উপাসক— ভলক্যান এবং ইউরোপে এমন এক সময়ে এসেছিলেন যখন সমগ্র মহাদেশে খ্রিস্ট ধর্মের মতবাদে চারপাশে আবদ্ধ ছিল।
আরও পড়ুন-ছোট ব্যোমকেশ
‘‘ঈশ্বর একজন পুরুষ ছিলেন এবং তাঁর একটি পুত্র ছিলেন যিনি মানবতাকে তাঁদের পাপ থেকে রক্ষা করেছিলেন’ মার্টিনা তাঁর বইতে বলেছেন। ঐশ্বরিক প্রতীকের কোনও স্থান ছিল না।
যিশু খ্রিস্টের মা হওয়া সত্ত্বেও, মেরিকে ১৯৩৩ সাল পর্যন্ত ক্যাথলিক চার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে সন্ত ঘোষণা করেনি। কিন্তু প্রাচীন ধর্মতে, দেবতাদের পাশাপাশি দেবীদের অস্তিত্ব ছিল। এবং এই দেবীদের প্রায়শই কালো হিসাবে চিত্রিত করা হত।”
কালী ছিলেন এই প্রাচীন দেবীদের একজন। চতুর্থ শতাব্দীতে যখন যাযাবর রোমানিরা উত্তর-পশ্চিম ভারত থেকে ইউরোপে চলে এসেছিল, তখনও তারা কিছু ধরনের শক্তিবাদ বা হিন্দু দেবীর পুজো অনুশীলন করত।
একজন শাস্তিদাতা, ক্রুদ্ধ পুরুষ দেবতা যিনি আপনাকে বলতেন কে কার চেয়ে শ্রেষ্ঠ এবং অন্ধভাবে কর্তৃত্ব অনুসরণ করতে। তার পরিবর্তে তাদের বিশ্বাস —অনেক পৌত্তলিক ঐতিহ্য এবং প্রাচীন বিশ্বাসের মতো যেখানে মানুষের চেতনায় দেবীদের স্থান ছিল। রোমানিদের নিজস্ব কর্তৃত্ব, অন্তর্দৃষ্টি এবং প্রজ্ঞা তাদেরকে উৎসাহিত করেছিল।
ঈশ্বরের সঙ্গে তাদের সংযোগ সরাসরি ছিল। ঈশ্বরের পক্ষে কথা বলার দাবিকারী মধ্যস্থতাকারী ছাড়া।
পূর্ব ইউরোপে, খ্রিস্টানরা রোমানিদের তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে ‘শয়তান-উপাসক’ হিসেবে নির্যাতন করত। রোমানিরা সারা-লা-কালী তৈরি করেনি বরং গোঁড়া ইউরোপীয় ক্যাথলিক খ্রিস্টান সমাজের মধ্যে আত্মীকরণ এবং খাপ খাইয়ে নেওয়ার সংগ্রামে, তারা তাদের মাতৃদেবীকে সেন্ট সারার অস্পষ্ট ব্যক্তিত্বের সঙ্গে যুক্ত করেছিল।
রোমানদের জন্য, সারা-লা-কালী স্থিতিস্থাপকতার মূর্ত প্রতীক হয়ে ওঠে।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, হিন্দু দেবী হিসেবে তাঁর উৎপত্তি স্পষ্ট দৃষ্টির আড়ালে চলে যায়। এমনকী সারা নামটিও তৃতীয় শতাব্দীর হিন্দু ধর্মগ্রন্থ দুর্গাসপ্তশতীতে দুর্গা এবং কালীর মতো দেবীদের সাঙ্গে সম্পর্কিত বলে উল্লেখ পাওয়া যায়।
আজ, সেন্ট সারা দ্য ব্ল্যাক— যিনি বঞ্চিতদের রক্ষক— বিশেষ করে যারা ভ্রমণে বাস করেন, (যাযাবর) তাদের সুরক্ষার জন্য, যারা বিশ্বব্যাপী অভিবাসী এবং বাস্তুচ্যুত মানুষের সংগ্রামের প্রতিধ্বনি। সেন্ট-মেরিস-দ্য-লা-মেরের বার্ষিক উৎসবে সেই বিশ্বাস এবং পরিচয়ের একটি শক্তিশালী প্রমাণ। তীর্থযাত্রীরা যখন তাঁর মূর্তি সমুদ্রে বহন করে, তখন তাদের ধর্মীয় শোভাযাত্রা কেবল মেরিদের আগমনের প্রতীক নয়, বরং রোমানি জনগণের এবং তাদের কালো চামড়ার দেবীর যাত্রারও প্রতীক— ভূমি অতিক্রম করা, তাদের সংস্কৃতি সংরক্ষণ করা এবং তাদের দেখাশোনা করা মাতৃরূপকে সম্মান করা। ভারতীয় উৎসব সম্পর্কে অনেক গবেষণা এবং ঐতিহাসিক প্রমাণ রয়েছে। ইতিহাসবিদেরা মনে করেন রোমানিরা প্রাচীন ভারত থেকে পশ্চিমে যাত্রা করেছিলেন এবং তাদের সঙ্গে ভারতের অনেক ধর্মীয় বিশ্বাস এবং আচার অনুষ্ঠান বহন করেছিলেন।
মা কালী যেহেতু ভারতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দেবী তাঁর শক্তি ও উপাসনার ধারা সম্ভবত রোমানিদের মধ্যে প্রবেশ করেছিল এবং ক্রমে তা সারা লা কালী রূপে রূপান্তরিত হয়। এই রূপান্তরটি ধর্মীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহাসিক বিবর্তনের একটি চিহ্ন হিসেবে দেখা যেতে পারে। সারা এবং বঙ্গের কালীর সঙ্গে বেশ কিছু সাদৃশ্যের কথা ইতিহাসবিদরা বলে থাকেন।
রক্ষাকারী দেবী মা
মা কালী হলেন শত্রু বিনাশকারী ধ্বংসের মাধ্যমে সৃষ্টির প্রতীক ও সর্বোপরি ভক্তদের তিনি অভয়াদাত্রী মা। তেমনি সেন্ট সারা লা কালী ও রোমানি জনগণের অশুভ শক্তির বিনাশ করে শুভ শক্তির জয়গান তিনি। রোমানি সম্প্রদায়ের এমনই বিশ্বাস যখন তারা বারবার নিপীড়ন ও বৈষম্যের শিকার হয়েছেন তখন তারা এই দেবীর কাছে প্রার্থনা করেই বরাভয় লাভ করেছেন এবং তাঁদের শত্রুদের বিনাশ করেন এই দেবী মা। চরম প্রতিকূলতার বিরুদ্ধেও মা রক্ষা করেছেন তাঁদের। হিন্দু ধর্মে আমাদের যেমন বিশ্বাস, মা কালী যেমন তাঁর ভক্তদের জন্য সমস্ত বিপদ থেকে মুক্ত করেন, সঙ্কটহারিণী তিনি। রোমানিদের জীবনের প্রতিটি দুঃসময়ে সারা লা কালী বিপত্তারিণী হয়ে সমস্ত বিপদ থেকে ভক্তদের দূরে রাখেন এমনটাই বিশ্বাস।
মা কালী এবং সেন্ট সারা লা কালীর কালো রঙে তাদের মধ্যে সবচেয়ে লক্ষণীয় সাদৃশ্য। কালো রঙটি সাধারণত মহাকাশ বা শূন্যতার প্রতি যা থেকে সমস্ত কিছু উদ্ভূত এবং যা সমস্ত কিছু ধারণ করে। মা কালীকে এই কালো রংয়ে চিত্রিত করা হয় কারণ তিনি সমস্ত কিছুকে ধারণ করেন একইভাবে সেন্ট সারা লা কালীকে কালো রঙের কারণে ‘কালো সারাহ’ বলা হয়। যা কিনা তাঁর শক্তি এবং প্রতিরক্ষা শক্তিকে নির্দেশ করে।
আরও পড়ুন-স্বজনহারাদের অর্থসাহায্য ও নিয়োগপত্র, দুর্যোগে ভাল কাজ করা সরকারি কর্মীদের পুরস্কার
তান্ত্রিক ও আধ্যাত্মিক মিল
তন্ত্রশাস্ত্রে, মা কালী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দেবী। তন্ত্রসাধনায় দেবীর ধ্বংস ও পুনর্জন্মের শক্তি বিশেষভাবে আরাধনা করা হয়। দেবীর পুজোয় জপ, ধ্যান এবং বিভিন্ন তান্ত্রিক আচার অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। সেন্ট সারা লা কালীর প্রতি রোমানি ভক্তদের উপাসনা এবং তাদের পবিত্র যাত্রাটি এক ধরনের আধ্যাত্মিক সাধনার অংশ। যা তাদের ঐতিহ্য বিশ্বাস এবং সংগ্রামের প্রকাশ। রোমানি উৎসবে দেবীর মূর্তিকে সমুদ্রের জলে নিয়ে যাওয়া এবং জলস্পর্শ করানো এক ধরনের পুনর্জন্ম এবং শুদ্ধীকরণের প্রতীক। এটি মা কালীর ধ্বংস এবং পুনর্জন্মের চক্রের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ।
মাতৃত্বের প্রতীক
মা কালী এবং সেন্ট সারা লা কালী উভয়েই মাতৃত্বের প্রতীক। মা কালীকে যেমন শত্রু বিনাশকারী হলেও স্নেহময়ী মা হিসেবে দেখা হয়। যিনি করুণার প্রতিমূর্তি। দয়াময়ী মা। সেন্ট সারা লা কালী ও রোমানি জনগোষ্ঠীর কাছে এক স্নেহময়ী মা। ভক্তের দুঃখে বিপদে পাশে দাঁড়ান। রক্ষা করেন।
এই মাতৃস্বরূপা দেবীকে এই কারণে ভক্তরা নিবেদন করেন অন্তরের শ্রদ্ধা ও ভক্তি। ঐতিহাসিকদের কাছে ফ্রান্সের কামার্গের গির্জায় এই ব্ল্যাকমেডোনা লাতিন আমেরিকা, ক্যারিবিয়ান, আফ্রিকা এবং পূর্ব ইউরোপের অন্যান্য ব্ল্যাক ম্যাডানাদের মতোই এক নারীবাদী দেবী। সারা লা কালী বিভিন্ন ঐতিহ্যের মিশ্রণ হিন্দু দেবী কালী সৃষ্টির এবং ধ্বংসের এক শক্তিশালী যোদ্ধার আধুনিক রূপ সারা। একইসঙ্গে সে মাতৃময়ী ব্ল্যাক ম্যাডোনা। সারার মধ্যেই রোমানিরা খুঁজে পায় শক্তি এবং আশ্রয়ের সহাবস্থান।