সদ্য ঘুরে এলাম ভুবনেশ্বর পরিচয় লিটারেচর ফেস্টে। ভারতের নানা প্রান্ত থেকে একশো বারোজন ভিন্ন ভাষার কবি এসেছিলেন মাতৃভাষায় কবিতা পড়ার জন্য। মরাঠি কবিতা পড়লেন রচনা। নিজের পদবি ব্যবহার করেন না। অনেকেরই কবিতার বিষয় ছিল জগন্নাথ, রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু তাঁর কবিতা শুনে আমি বিস্মিত হলাম। কবিতার নাম মা। এবং গানের মতো করে সেখানে তিনি মা সারদার কথা বললেন। প্রথমে আমি ভেবেছিলাম হয়তো তাঁর এই সারদা মা জব্বলপুরের মা শারদা বা দুর্গা। কিন্তু পরমুহূর্তেই সেই ভুল ভাঙল যখন তিনি বললেন, অনেকটা— ‘বৈকুণ্ঠ হতে লক্ষ্মী এল পৃথিবীর এই মাটিতে / জয়রামবাটীতে, জয়রামবাটীতে…” এই রকম কথায় ও সুরে।
অনুষ্ঠান শেষ হতেই ধরলাম তাঁকে। এই গান বা মায়ের কথা তুমি জানলে কী করে?
তিনি আমার হাত ধরে অনেকক্ষণ মাথায় রেখে প্রণাম করে বললেন, মা কি শুধু তোমাদের বাঙালিদেরই! মা আমারও, আমাদের মতো বহু মেয়ের মা তিনি। তিনি না থাকলে আমার… কথাটা শেষ হল না। অন্য আরেকজন এসে যাওয়ায়।
পরে রচনা আমাকে জানিয়েছিলেন, মা সারদা ‘সতেরও মা অসতেরও মা’। তাই তাঁর মতো পাপীকেও তিনি আশ্রয় দিয়েছেন। এবং বুঝিয়ে দিয়েছেন শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা।
বড়ো আশ্চর্য হয়েছিলাম সেদিন। আমাদের ‘মা’ এই অহংকার চূর্ণ করে দিয়ে জয়রামবাটীর মেয়ে, কামার পুকুরের রামকৃষ্ণ জায়া সারদা দেশ বিদেশের বিভিন্ন প্রান্তে অজস্র মানুষের ‘মা’ হয়ে উঠেছেন। তিনি সর্বজনীন, আর শুধু আমাদের নন। মনে পড়ে, জয়রামবাটিতে দুর্ভিক্ষের সময় ক্ষুধার্তদের গরম খিচুড়ি বিতরণ করার সময় মা গরিব মানুষদের পাশে বসে হাত পাখায় বাতাস করে দিয়েছেন। ওই মানুষগুলো তখন মায়ের পরম স্নেহ পেয়ে আনন্দে মত্ত হয়ে উঠেছিল। অভাব, জ্বালা, যন্ত্রণা ভুলে সকলেই একাত্ম হয়েছিল সেদিন। এই মা কেমন ছিলেন? অপার মাতৃস্নেহ নিয়ে তিনি সবার মা। যাঁকে নিত্য সেবা না করলেও তিনি নীরবে সন্তানদের মঙ্গল প্রার্থনায় মগ্ন থাকেন।
আরও পড়ুন-বিজেপি রাজ্যে বৌমার গোপনাঙ্গে লঙ্কার গুঁড়ো, গরম লোহার রড ঢুকিয়ে নির্যাতন
বিবেকানন্দ বলছেন, কালীরূপে যে মাকে আমরা আরাধনা করি, তাঁর মূর্ত রূপ মা সারদা। যে রমণী মাঠে চাষ করেন, সংসার চালান নিঁখুত দক্ষতায়, জাতের বিচার না করে সকলের জন্য যাঁর অবারিত দ্বার, যিনি বলছেন, মেয়েদের শিক্ষা ছাড়া অন্য কোনও পথ নেই, আবার শেখাচ্ছেন কম পুঁজিতেও জীবন চালিয়ে নতুন কিছু করা সম্ভব। তিনি আমাদের প্রতিদিনের মা। প্রয়োজনে শাসন করছেন, আবার ভালোও বাসছেন অপরিসীম মমতায়। তিনি সর্বভুজা।
একবার এক ভক্ত মাকে প্রশ্ন করলেন, মা, আপনি কি সাক্ষাৎ মা কালী? চমকে উঠলেন মা। এটা ওটা নানা কথা বলে প্রসঙ্গ পাল্টাতে চাইলেন। ও দিকে ভক্ত নাছোড়। মা শেষ পর্যন্ত বললেন, ‘ওই, লোকে বলে কালী’! এ কথা বলেই দ্রুত প্রসঙ্গান্তরে চলে গেলেন। সেই কালী যাকে বিবেকানন্দ বলছেন, ব্যক্তি, সমাজ, দেশ, সমগ্র বিশ্ব তথা সবকিছুই ‘বিরাট মহামায়া’। তাঁকে ঘিরেই ভূমি থেকে ভূমায় উত্তরণ। তিনিই মা সারদা। তিনি ভক্তকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে যেতে সাহায্য করেন। এই আলো জ্ঞানের আলো, শিক্ষার আলো। রাসসুন্দরীদেবী তাঁর ‘আমার জীবন’ গ্রন্থে লিখেছেন, “সেকালে মেয়েছেলের বিদ্যাশিক্ষা ভারী মন্দ-কর্ম বলিয়া লোকের মনে বিশ্বাস ছিল।” রবীন্দ্রনাথের লেখাতেও উঠে আসছে সেই একই সুর—
“নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার
কেন নাহি দিবে অধিকার
হে বিধাতা?
নত করি মাথা
পথপ্রান্তে কেন রব জাগি
ক্লান্তধৈর্য প্রত্যাশার পূরণের লাগি
দৈবাগত দিনে।”
আরও পড়ুন-উদ্ধার দেহ, আটক বান্ধবী
অদ্ভুতভাবে সারদাদেবী কিন্তু এই ভাগ্য বিশ্বাসী নন। তিনি মনে করছেন, স্ত্রীশিক্ষার বিস্তার না ঘটলে স্ত্রীজাতি নিজেদের সমস্যার সমাধান করতে পারবে না। তিনি নিজে লিখতে পারতেন না, কিন্তু পড়তে পারতেন ভালভাবেই। রাধু, মাকু প্রমুখ ভাইঝিদের তিনি নিজে লেখাপড়া শিখিয়েছিলেন। বিবাহিতা রাধুকে তিনি উদ্বোধনের কাছে একটি স্কুলে পর্যন্ত ভর্তি করে দেন। গৌরীমা বা নিবেদিতার স্কুল নিয়ে তাঁর আগ্রহের শেষ ছিল না। স্কুল হলে মেয়েরা পড়াশোনা শিখবে, শিখবে হাতের কাজও,যা দিয়ে পরবর্তীকালে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে মেয়েরা। কারণ তিনি বিশ্বাস করছেন স্বাবলম্বীতা ছাড়া মেয়েদের স্বাধীনতা কখনও আসবে না।
নিজের কম বয়সে বিয়ে হলেও তিনি বাল্যবিবাহ প্রথার বিরোধী ছিলেন। মেয়েদের কম বয়সে বিয়ে হওয়াকে তিনি যন্ত্রণার কারণ বলে দুঃখপ্রকাশ করতেন। তিনি একবার বলেছিলেন, “আহা, তারা (দু মাদ্রাজি কুড়ি-বাইশ বছর বয়সি তরুণী) কেমন সব কাজকর্ম শিখেছে! আর আমাদের!এখানে পোড়া দেশের লোকে কি আট বছরের হতে না হতেই বলে, ‘পরগোত্র করে দাও, পরগোত্র করে দাও!”
শুধু শিক্ষার অধিকার বা বাল্যবিবাহ রোধ নয়— সঠিক প্রেক্ষিতে মেয়েদের ব্রহ্মচর্য ও সন্ন্যাস গ্রহণ এবং শাস্ত্রপাঠ ও পূজার্চনার অধিকারের কথাও জানিয়েছেন তিনি। ঋগ্বৈদিক যুগ এবং পরবর্তী সময়ে ‘ব্রহ্মবাদিন’ নামে এক শ্রেণির স্ত্রীজাতির কথা জানা যায়, যাঁরা সন্ন্যাস জীবন যাপন করতেন এবং ধর্ম ও দর্শনচর্চা করতেন। মহীশূরের নারায়ণ আয়েঙ্গারের কন্যা ব্রহ্মচারিণী হতে চাইলে সারদাদেবী, স্বামী সারদানন্দকে দিয়ে এই মর্মে চিঠি লিখিয়েছিলেন যে, মেয়েদেরও সেই অধিকার আছে। এই প্রসঙ্গে বৌদ্ধ সঙ্ঘের কথাও উল্লেখ করেছিলেন তিনি। গৌতমী প্রজাপতির নেতৃত্বে প্রথম মহিলাদের জন্য সংঘ গড়ে তোলেন বুদ্ধ।
আসলে নারীর সার্বিক উন্নতি ও বিকাশ সব সময়ই সারদাদেবীর ভাবনায় ছিল। নারীর স্বাধীনতা আদায়ে পুরুষের প্রয়োজন নেই। সে নিজে তার অধিকার আদায় করে নিতে শিখুক— এটাই তাঁর অন্যতম বক্তব্য ছিল। আর সে কারণেই বারেবারে চেয়েছেন নারীরা শিক্ষিত হোক। শিক্ষা না পেলে আত্মশক্তি বাড়ে না। সারদাদেবী নিজে স্ত্রী-মঠ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে উৎসাহী ছিলেন এবং বলতেন, স্ত্রী-মঠে নারীরাই হবে প্রধান ও পরিচালক। সারদাদেবী এক ভক্তকে বলেন, “সন্তানদের অনেককে তো দেখি নিজেদের ভুলত্রুটি অপরাধের ইয়ত্তা নেই, তবু তারা চায় বউ-ঝিরা তাদের কাছে নত হয়ে থাকুক। এই অন্যায়ের ফলে যে দিন আসছে, মেয়েরা আর পৃথিবীর মতো সইবে না।” (দুর্গাপুরীদেবীর ‘সারদা-রামকৃষ্ণ’ গ্রন্থ) যে সারদাদেবী সহ্যের কথা বলতেন, সেই তিনিই অন্যায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধের কথা বলে গিয়েছেন। অলসতা বা কর্মবিমুখতা তাঁর একেবারেই অপছন্দ ছিল। তিনি বলছেন, কাজ করতে হবে বইকি। কর্ম করতে করতে কর্মের বন্ধন কাটে। তবে নিষ্কামভাব কাটে। একদণ্ডও কাজ ছেড়ে থাকা উচিত নয়। মায়ের আদরের খুকী নিবেদিতা চিঠিতে লিখছেন, ‘আদরিনী মাগো, আজ সকালে খুব ভোরে গীর্জায় গিয়েছিলাম সারার জন্য প্রার্থনা করতে। সেখানে সবাই মেরির কথা ভাবছিল। হঠাৎ মনে পড়ে গেল তোমার কথা।’ কেন মনে পড়ল তাঁর মা সারদার কথা? তার ব্যাখ্যা তিনি নিজেই দিচ্ছেন, “তিনি অনাড়ম্বর সহজতম সাজে পরম শক্তিময়ী মহত্তমা এক নারী” যিনি তাঁর সন্তানদের বলছেন, “জানবে কেউ না থাক, তোমার একজন মা আছেন। আমি মা থাকতে ভয় কি?”
আরও পড়ুন-মৌসুনি দ্বীপের কটেজে আগুন
আজ যখন সারা বিশ্ব অশান্ত, সবাই সবার দোষ ধরে নিজের দায়িত্ব অন্যের ওপর চাপিয়ে দায় সারছি, তখন তাই তাঁর কথা আরও বেশি করে মনে পড়ে, “ভাঙতে সবাই পারে, গড়তে পারে ক-জন? নিন্দা-ঠাট্টা করতে পারে সব্বাই, কিন্তু কী করে যে তাকে ভাল করতে হবে, তা বলতে পারে ক’জনে?”
আর ঠিক এখানেই তিনি প্রকৃত মা। নিবিড় যত্নে গড়ে তোলেন এই সংসার সমুদ্র, দিশাহীন জাহাজ যাঁর কূলে ভীত যাত্রী নিয়ে নিশ্চিন্তে ভিড়তে পারে। আর তিনি দশ হাত দিয়ে সন্তানদের আগলে রাখার প্রচেষ্টায় টেনে নেন নিজের কাছে। এমন মায়ের প্রয়োজন তাই ফুরায় না, বরং দিনের পর দিন বাড়তেই থাকে। এই মাকে তাঁর জন্মদিনে নতমস্তকে জানাই প্রণাম।