সারদামণি, নারীমুক্তির দিশা প্রদায়িনী

গত বৃহস্পতিবার চলে গেল তাঁর জন্মতিথি। তিনি কেবল শ্রীরামকৃষ্ণের পত্নী নন, নন শুধু সংঘজননী, তিনি জ্ঞানদায়িনী সারদা, সরস্বতী— মেয়েদের উত্তরণের অবলম্বন। লিখছেন বিতস্তা ঘোষাল

Must read

তখন আমি আমি বেশ ছোট। বাবার এক অনুগত তাঁর মেয়ের বিয়ে ঠিক করে আমাদের বাড়ি এসেছেন নিমন্ত্রণ করতে। মেয়েটি চাকরিরতা। কিন্তু বিয়ের পর তাকে চাকরি ছেড়ে দিতে হবে। কারণ শ্বশুরবাড়ির লোকেরা চান না বাড়ির বউ বাইরে কাজ করুক। বাবা ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলেন, আপনারা তা জেনেও সেখানেও মেয়ের বিয়ে দিচ্ছেন? তাহলে মেয়েকে এতদূর পড়ালেন কেন?
ভালই মনে আছে, তিনি চলে যাওয়ার পর বাবা আমার মাকে বলেছিলেন, আজ থেকে একশো পঁচিশ বছর আগে মা সারদা বলেছিলেন মেয়েদের শিক্ষার পাশাপাশি অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতার প্রয়োজন। তিনি যেটা অতদিন আগে বুঝতে পেরেছিলেন, মেয়েদের দুর্ভাগ্য, অভিভাবকরা তা এখনও উপলব্ধি করতে পারলেন না। অথচ দেখ প্রত্যেক বাঙালির ঘরে তাঁর ছবি ঝোলানো। বলা বাহুল্য, সেই বিয়েতে আমরা কেউ যেতে পারিনি।

আরও পড়ুন-স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের পাঠ দিল জৈবহাট, সচেতন করলেন বক্তারা

পরাধীন ভারতে ১৭৩ বছর আগে জন্মেছিলেন বিবেকানন্দর জীবন্ত ঈশ্বরী মা সারদা। সেই সময় মেয়েদের পড়াশোনার চল ছিল না। স্কুল পাঠাশালাও অমিল। ফলে সারদাদেবী বিদ্যালয়ে যাওয়ার সুযোগ পাননি। ঘরের সাধারণ কাজকর্মের পাশাপাশি ছেলেবেলায় তিনি তাঁর ভাইদের দেখাশোনা করতেন, জলে নেমে পোষা গরুদের আহারের জন্য দলঘাস কাটতেন, ধানখেতে মুনিষদের জন্য মুড়ি নিয়ে যেতেন, প্রয়োজনে ধান কুড়ানোর কাজও করেছেন। মাঝে মাঝে ভাইদের সঙ্গে পাঠশালায় যেতেন। তখন কিছু অক্ষরজ্ঞান হয়েছিল মাত্র । পরবর্তী জীবনে কামারপুকুরে শ্রীরামকৃষ্ণের ভ্রাতুষ্পুত্রী লক্ষ্মীদেবী ও শ্যামপুকুরে একটি মেয়ের কাছে ভাল করে লেখাপড়া শেখেন। ছেলেবেলায় গ্রামে আয়োজিত যাত্রা ও কথকতার আসর থেকেও অনেক পৌরাণিক আখ্যান ও শ্লোক শিখেছিলেন। কিন্তু এসবই তাঁর নিজস্ব ইচ্ছায় পড়া।
তিনি নিজেই বলছেন, “কামারপুকুরে লক্ষ্মী আর আমি ‘বর্ণপরিচয় একটু একটু পড়তুম। ভাগনে (হৃদয়) বই কেড়ে নিলে; বললে ‘মেয়ে-মানুষের লেখাপড়া শিখতে নেই; শেষে কি নাটক-নভেল পড়বে।’ লক্ষ্মী তার বই ছাড়লে না, ঝিয়ারী মানুষ কিনা, জোর করে রাখলে। আমি আবার গোপনে আর একখানি এক আনা দিয়ে কিনে আনালুম। লক্ষ্মী গিয়ে পাঠশালায় পড়ে আসত, সে ঘরে এসে আবার আমায় পড়াত।’’
এই বিদ্যাৎসাহ তাঁর পরেও ছিল। তিনি বলছেন, “ভাল করে শেখা হয় দক্ষিণেশ্বরে। ঠাকুর তখন চিকিৎসার জন্য শ্যামপুকুরে। একাটি একাটি আছি। ভব মুখুজ্যেদের একটি মেয়ে আসত নাইতে। সে মধ্যে মধ্যে অনেকক্ষণ আমার কাছে থাকত। সে রোজ নাইবার সময় পাঠ দিত ও নিত। আমি তাকে শাক পাতা, বাগান হতে যা আমার এখানে দিত, তাই খুব করে দিতুম।”

আরও পড়ুন-টিকিটের মূল্য ফেরতের ব্যবস্থা

রাসসুন্দরীদেবী তাঁর ‘আমার জীবন’ গ্রন্থে লিখেছেন, “সেকালে মেয়েছেলের বিদ্যাশিক্ষা ভারী মন্দ-কর্ম বলিয়া লোকের মনে বিশ্বাস ছিল।” রবীন্দ্রনাথের লেখাতেও উঠে আসছে সেই একই সুর—“নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার/ কেন নাহি দিবে অধিকার/ হে বিধাতা?
সারদাদেবী কিন্তু এই ভাগ্য বিশ্বাসী নন। নারীর ভাগ্য বিপর্যয়ের জন্য শুধু ভাগ্য দেবতা বা ভগবানের নামে দোষ দিলে হবে না। নিজেকেই খণ্ডাতে হবে সেই বিধান। এ তাঁর গলায় বারবার উঠে এসেছে। নারীর স্বাধীনতা আদায়ে পুরুষের প্রয়োজন নেই। সে নিজে তাঁর অধিকার আদায় করে নিতে শিখুক— এটাই তাঁর অন্যতম বক্তব্য ছিল। আর সে কারণেই বারেবারে চেয়েছেন নারীরা শিক্ষিত হোক। কারণ, শিক্ষা না পেলে আত্মশক্তি বাড়ে না।
তিনি নিজে লিখতে পারতেন না, কিন্তু পড়তে পারতেন ভালভাবেই। রাধু, মাকু প্রমুখ ভাইঝিদের তিনি নিজে লেখাপড়া শিখিয়েছিলেন। বিবাহিতা রাধুকে তিনি উদ্বোধনের কাছে একটি স্কুলে পর্যন্ত ভর্তি করে দেন। গৌরী মার ‘শ্রীশ্রীসারদেশ্বরী’ বিদ্যালয় বা নিবেদিতার স্কুল নিয়ে তাঁর আগ্রহের শেষ ছিল না। স্কুল হলে মেয়েরা পড়াশোনা শিখবে, শিখবে হাতের কাজও, যা দিয়ে পরবর্তীকালে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে মেয়েরা। কারণ স্বাবলম্বিতা ছাড়া মেয়েদের স্বাধীনতা কখনও আসবে না। সেকালে মেয়েরা কেউ কেউ বালিকা বিদ্যালয়ে পড়ার অনুমতি পেত তাদের বাড়ি থেকে। কিন্তু মেমের স্কুল বলে স্নান করে বা গঙ্গা জলে শুদ্ধ হয়ে তবে বাড়ির ভেতরে ঢোকার অনুমতি মিলত। মায়ের কাছে ছুঁতমার্গের বিচার ছিল না। ইংরেজ-ভারতীয় সকলেই মায়ের সন্তান। এমনকী প্রয়োজনে ইংরেজিও শিখতে হবে মেয়েদের, এই ছিল তাঁর অভিমত।
পাঁচ কন্যাসন্তানের জননী, এক স্ত্রীভক্ত মেয়ের বিয়ে দিতে না পারায় দুঃখ প্রকাশ করলে মা বলছেন, “বে দিতে না পার, এত ভাবনা করে কী হবে? নিবেদিতার স্কুলে রেখে দিও। লেখাপড়া শিখবে, বেশ থাকবে।” এই প্রসঙ্গেই অনিবার্য হিসেবে বাল্যবিবাহর কথা আসে। পরম বিস্ময়ে লক্ষ্য করি মা ছিলেন এর তীব্র সমালোচক। নিজের যেমন জ্ঞানস্পৃহা ছিল, তেমনি ছিলেন অল্প বয়সে বিয়ের বিরুদ্ধে। নিবেদিতার স্কুলে দুটি মাদ্রাজি বয়স্ক কুমারী মেয়েকে দেখে একই সঙ্গে মা খুশি ও দুঃখিত হয়ে বলেছিলেন, “আহা,তারা কেমন সব কাজকর্ম শিখছে! আর আমাদের! এখানে পোড়া দেশের লোকে কি আটবছরের হতে না হতেই বলে, ‘পরগোত্র করে দাও, পরগোত্র করে দাও!’ আহা! রাধুর যদি বিয়ে না হত তা হলে কি এত দুঃখ-দুর্দশা হত?”
তিনি বিশ্বাস করতেন, ‘‘জ্ঞানদায়িনী, মহাবুদ্ধিমতী” হয়ে নারীরা শুধু গৃহিণী নয়, আত্মমর্যাদা সম্পন্ন ও শক্তিশালী হবে। আর এই বিশ্বাসেই ভর করে তাই চেয়েছিলেন মেয়েরা লেখাপড়া শিখে স্বনির্ভর হোক।
এই শতাব্দীতে মেয়েরা যখন মহাকাশে পাড়ি দিচ্ছে, প্রতিটি মুহূর্তে নানান প্রতিকূলতা সত্ত্বেও এগিয়ে চলেছে, তখন মনে পড়ে স্বামী বিবেকানন্দর তাঁর গুরুভাইকে লেখা এক চিঠির কথা, যেখানে তিনি লিখেছিলেন, “মা-ঠাকুরণ কী বস্তু বুঝতে পারনি, এখনও কেহই পার না, ক্রমে পারবে। ভায়া, শক্তি বিনা জগতের উদ্ধার হবে না। মা-ঠাকুরণ ভারতে পুনরায় সেই মহাশক্তি জাগাতে এসেছেন, তাঁকে অবলম্বন করে আবার সব গার্গী মৈত্রেয়ী জগতে জন্মাবে।”
এ-কথা আজ আর অবজ্ঞা করার কোনও উপায় নেই। তাঁর আলোয় আলোকিত হয়ে পথ চলছে লক্ষ লক্ষ মেয়ে নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে।

Latest article