পরিবর্তনশীল কালের স্রোত দুর্বার, বিষাক্ত ধোঁয়ায় পরিবেশের প্রাণ ওষ্ঠাগত; অগণিত প্রাণ লুপ্তপ্রায় কালের করাল গ্রাসে; অজস্র সহস্র জীবন আজ সঙ্কটে এই সভ্যতার অবিরাম স্রোতে; জীবনবায়ু অক্সিজেনের শ্বাস ফুলে উঠেছে গ্রিনহাউস গ্যাসের দাপাদাপিতে; প্রাণদায়ী সবুজ অরণ্য কাঁদছে প্রতিনিয়ত জোড়হাতে; প্রকৃতি যেন পঙ্গু ভীষণ এ-ধূসর পৃথিবীটাতে! কারণ একটাই— পরিবেশ দূষণ!!!
এই রাক্ষুসী পরিবেশ দূষণের জন্যই আজ মহাসঙ্কটে পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ অরণ্য, আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের ‘সুন্দরবন’। সাম্প্রতিক কালে কলকাতার স্বনামধন্য বোস ইনস্টিটিউটের ডিপার্টমেন্ট অব কেমিক্যাল সায়েন্সেস এবং ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি (আইআইটি), কানপুরের ডিপার্টমেন্ট অব সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর একদল গবেষক তাঁদের গবেষণাপত্রে এমনটাই দাবি করেছেন। নিকটবর্তী মানবসমাজ থেকে মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাপনের সময় উৎপাদিত পরিবেশদূষক ওই ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলে অনুবাহিত হওয়ায়, ওই নির্দিষ্ট ম্যানগ্রোভ এলাকায় উপস্থিত বায়ুমণ্ডলীয় এরোসলের অম্লতা ও জারণধর্মী ক্ষমতার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে গিয়েই তাঁরা প্রমাণ পান সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ভয়ঙ্করভাবে পরিবেশ দূষণের শিকার!
আরও পড়ুন-অরণ্যের অধিকার
বড্ড বলতে ইচ্ছে করছে, ভালবাসি চঞ্চলা স্রোতস্বিনীর প্রাণখোলা হাসি; চিত্রা হরিণ, ভালবাসি সাগরের তীর ঘেঁষে গজিয়ে ওঠা ম্যানগ্রোভে বাঘিনীর প্রসব বেদনার আর্তনাদ। ভালবাসি ভুরভুরে সিক্ত মৃত্তিকায় আলগোছে ডুবে যাওয়া বন্য পশুপাখির পায়ের ছাপ। কিন্তু ভাবতে খুব খারাপ লাগে, আজ সেই প্রাণখোলা পরিবেশ আর নেই। আজ রবীন্দ্রনাথ নেই, নেই গাছপ্রেমী বলাই। আজ জগদীশচন্দ্র নেই, নেই গাছের ডাক শোনার বালাই। আজ নজরুল নেই, নেই সাম্যের গান ভাসি। আজ বনফুল নেই, নেই মানুষ ও পশুর ভালবাসাবাসি। আজ শরৎচন্দ্র নেই, নেই সহজসরল গ্রামবাসী। আজ গ্রাম যেন শহর হয়েছে, গগনচুম্বী ইমারত মাথা উঁচু করে উঠেছে। আজ উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার, বিশ্বায়ন; কিন্তু হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন থেকে বিশ্ব উষ্ণায়ন। প্রকৃতিতে আজ বিষবাষ্পে ভরে গেছে, মানুষে মানুষে আগ্রাসনের লড়াই শুরু হয়ে গেছে। উন্নয়নের নামে আজ এ-সভ্যতা বড়ই চিন্তিত, অচিরেই কি তবে সভ্যতার শেষ? সবই কি ক্ষতিগ্রস্ত! এসবের সাক্ষী দিচ্ছে সময়; সময়ের কক্ষপথে পরিবেশ দূষণ যেন একটি আরএনএ ভাইরাস! এর প্রতিষেধক হিসেবে কোনও সঠিক অ্যান্টিবায়োটিক পাওয়া যাচ্ছে না— তবে মানুষ সব পারে, কী বলেন?
হুম্, মানুষ সব পারে! তবে দুঃখজনকভাবে এই পরিবেশ দূষণের জন্য দায়ী একমাত্র মানুষই, আর তাদের খামখেয়ালি বেহিসাবি আচরণ। পৃথিবীর বিখ্যাত ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল ‘সুন্দরবন’ আজ মানুষের খারাপ কাজের জন্যই নষ্ট হতে বসেছে। কলকাতার বোস ইনস্টিটিউটের ড. মনামি দত্ত, ড. সনৎ কে. দাস, ও ড. অভিজিৎ চ্যাটার্জি এবং আইআইটি কানপুরের ড. অভিনন্দন ঘোষ ও ড. মুকেশ শর্মা গবেষণাটি সুসম্পন্ন করেছেন। বিগত ২০১৮ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর ২২-৩০, ২০১৯ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর ২৪-৩১ এবং ২০২০ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি ১৬-২২ তারিখ— এই পরপর তিন বছর শীতের সময় ওই বিজ্ঞানীগণ বঙ্গোপসাগরের উত্তর-পূর্ব কূলে স্থল-সমুদ্র সীমান্তে ২১.৩৫ উঃ অক্ষাংশ এবং ৮৮.৩২ পূঃ দ্রাঘিমাংশে স্থিত সুন্দরবনের একটি আদিম ম্যানগ্রোভ অংশে নিবিড় পর্যবেক্ষণের পর এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন।
আরও পড়ুন-ত্রাণ বিলির নাটক গদ্দারের, চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলা পুরশুড়ায়, ক্ষুব্ধ গ্রামবাসী
বঙ্গোপসাগরের তীরে ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা এবং গঙ্গার শাখানদীর সঙ্গমস্থলে সৃষ্ট বিস্তীর্ণ বদ্বীপ অঞ্চলের নাম সুন্দরবন যা পৃথিবীর সবচেয়ে বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট হিসেবে পরিচিত। এই অঞ্চলের ক্ষেত্রফল প্রায় দশ হাজার বর্গ কিলোমিটার, তবে এর মধ্যে প্রায় ছ’হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকা বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত। ভারত সরকার এই ম্যানগ্রোভ অঞ্চলটিকে দেশের সবচেয়ে বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ সংরক্ষিত জলাভূমি হিসেবে চিহ্নিত করেছে যা পৃথিবীর মানুষের কাছে ‘আ ওয়েটল্যান্ড অব ইন্টারন্যাশনাল ইম্পর্ট্যান্স’ হিসেবে জানে। বিশ্ববিখ্যাত সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রের নিদর্শন এই সুন্দরবনে প্রায় ৪১ লক্ষ ৫০ হাজার মানুষের বসবাস। এই সুন্দরবন ওই অঞ্চলের পুরো জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ করে। তবে বিজ্ঞানীগণ যে স্থানটি পরীক্ষা-নিরীক্ষার নমুনা হিসেবে বেছে ছিলেন সেটা সুন্দরবনের কেন্দ্রীয় অঞ্চল যা মোটামুটিভাবে জনবিরল। ওই স্থানে যাতায়াতের মাধ্যম বলতে স্থানীয় প্রশাসনের পূর্ণ সম্মতিতে চালিত লোকাল বোট সার্ভিস। ওই নির্দিষ্ট ম্যানগ্রোভ এলাকা থেকে জনপদ প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে এবং কলকাতা শহর প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।
সুন্দরবন হল নোনতা ম্যানগ্রোভের বদ্বীপ, কর্দমাক্ত সমতল এবং অসংখ্য জোয়ার-জলপথের সঙ্গমস্থল। এটি বিপদাপন্ন রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের গুরুত্বপূর্ণ বাসস্থান; সঙ্গে অগণিত ফ্লোরা ও ফনার নিরাপদ আশ্রয়স্থল। এখানেই দেখা যায় অসংখ্য পরিযায়ী পাখি, চিত্রা হরিণ, নানা প্রজাতির সাপ, কুমির প্রভৃতি। এছাড়াও ওই অঞ্চলে বসবাসরত মানুষদের চাষবাস এবং জীবিকা নির্বাহের অন্যতম মাধ্যম হয়ে উঠেছে এই ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট। সুন্দরবন সাইক্লোনজনিত বন্যার হাত থেকে ওই এলাকার লক্ষ লক্ষ মানুষের বাসস্থানগুলোকে আগলে রাখে। ইউনেস্কো সুন্দরবনকে ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’-এর মর্যাদা দিলেও; ২০২০ খ্রিস্টাব্দে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার অ্যান্ড ন্যাচারাল রিসোর্সেস-এর রেড লিস্ট অব ইকোসিস্টেমস ফ্রেমওয়ার্ক অনুযায়ী এটি বিপদাপন্ন হিসেবে পরিগণিত হয়। তার উপর এ-বছর প্রকাশিত গবেষণাপত্র ওই ম্যানগ্রোভ বন যে সত্যিই সঙ্কটে তা আরও জোর দিয়ে জনসমক্ষে তুলে ধরে।
বিজ্ঞানীদের নিশ্চিত ধারণা, সুন্দরবনের এইরূপ প্রাকৃতিক ক্ষতিসাধনের মূল কারণ হল ওই এলাকার দূষিত বায়ু। নগর কলকাতার বুকে পরিবহণ, শিল্প এবং মানুষের দৈনন্দিন ক্রিয়াকলাপজাত ভৌত-রাসায়নিক দূষিত পদার্থ, কালি, ঝুল, ভুসি ও নানা ধরনের ছোট বড় আকারের কার্বন কণা অনুবাহিত হয়ে এসে ওই ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রের অসম্ভব ক্ষতিসাধন করছে। এছাড়াও নিকটবর্তী নিম্ন, মধ্য ও পশ্চিম ইন্দো-গাঙ্গেয় সমভূমি অঞ্চল থেকে আগত দূষিত পদার্থ সুন্দরবন অঞ্চলের বায়ুকে যথেষ্ট দূষিত করে তুলছে। ওইসব এলাকায় ব্যবহৃত বোটের পুরাতন মোটর থেকে আগত বিষাক্ত ভারী ধাতু বাতাসে মিশছে; আর্থিকভাবে দুর্বল মানুষজনের জ্বালানি হিসেবে কাঠ, ঘুঁটে, পাটকাঠি, আবর্জনা, লতাপাতা পোড়ানোর ফলে উৎপন্ন ছাই উড়ে এসে বাতাসে মিশছে; পরিবহণে ব্যবহৃত বোট, ভেসেল, কিংবা ট্রলার ও ল্যাম্পে ডিজেল ও কেরোসিনের ব্যবহার; এইসব কারণে ওই ম্যানগ্রোভ অরণ্যের বাতাসে ‘পিএম ১০’ আকারের দূষিত কণার পরিমাণ বাড়ছে। ফলস্বরূপ ওই এলাকার বিস্তীর্ণ আদিম উচ্চ গুণমানের পরিবেশ, তথা বাস্তুতন্ত্রের জৈবভূরাসায়নিক পরিবর্তন দেখা দিচ্ছে যা ওই বনাঞ্চলে উপস্থিত গাছপালা, পশুপাখি, কীটপতঙ্গ, অণুজীব এমনকী মানুষজন সকলের জন্যই ক্ষতিকর। দুঃখের বিষয় সুন্দরবন ক্ষতিগ্রস্ত হলে আমাদের রাজ্য, তথা গোটা ভারতবর্ষের জলবায়ুর উপর একটি গভীর প্রভাব পড়বে।
নিবিড় পর্যবেক্ষণের পর দেখা গেছে, সুন্দরবনের ওই নির্দিষ্ট এলাকার পরিমণ্ডলে স্থিত বায়ুর মধ্যে উপস্থিত ‘পিএম ১০’ আকারের কণা, অ-সামুদ্রিক লবণজাত সালফেট আয়ন এবং জলে দ্রাব্য জৈবিক কার্বনের গড় ঘনত্ব যথেষ্ট বেশি। বিজ্ঞানীদের ধারণা, এইগুলো স্থানীয় জনপদ ও কলকাতা শহরে ব্যবহৃত কঠিন পদার্থ জ্বালানি হিসেবে পোড়ানোর জন্যই ওই এলাকার বাতাসে মিশেছে। ফলত ওই অঞ্চলের বায়ুতে উপস্থিত স্বাভাবিক এরোসলের প্রকৃতির পরিবর্তন ঘটছে, যা যে কোনও পরিবেশে বিন্যস্ত বিভিন্ন জীব ও তার পারিপার্শ্বিক জড় উপাদান এবং তাদের পারস্পরিক আন্তঃক্রিয়া, নির্ভরশীলতা ও মিথস্ক্রিয়া পক্ষে ক্ষতিকারক।
আরও পড়ুন-সিবিআই-ইডির পর্দাফাঁস, অনুব্রতকে জামিন দিয়ে বলল প্রতিহিংসা
এরোসল হল বাতাসে উপস্থিত কঠিন কণা, বায়ু বা অন্য গ্যাসের তরল ফোঁটার একটি সাসপেনশন যা বাতাসে ভাসমান অবস্থায় থাকে। তাপগতিবিদ্যার ‘এক্সটেন্ডেড এরোসল ইনঅর্গানিক্স মডেল’ ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হয়েছেন যে, ওই বনাঞ্চলের বাতাসে উপস্থিত এরোসল মাত্রাতিরিক্ত আম্লিক এবং উপস্থিত ‘পিএম ১০’ কণার আয়তন এবং জারণধর্মী ক্ষমতাও স্বভাবিক শহুরে বায়ুমণ্ডলীয় এরোসলের চেয়ে বিস্ময়করভাবে বেশি, এমনকী ইন্দো-গাঙ্গেয় সমভূমির চেয়েও। এরোসলের এইরকম প্রকৃতি পরিবর্তনের পেছনে রয়েছে শক্ত জ্বালানি ব্যবহারের ফলে আগত সালফেট আয়ন এবং অম্ল ও জল উভয়েই দ্রবণীয় তামা ও ম্যাঙ্গানিজের মতো রূপান্তর ধাতুর উপস্থিতি। এইসব সালফেট আয়ন এবং রূপান্তর ধাতু বাতাসে উপস্থিত অন্যান্য কার্বণ কণার চেয়েও বেশি হারে পরিবেশে উপস্থিত এরোসলকে আম্লিক এবং জারণধর্মী করে তুলছে, ফলে এরোসলের যে সহজাত কার্যকলাপ তা বিঘ্নিত হচ্ছে, সর্বোপরি পরিবেশে অসাম্য তৈরি হচ্ছে।
স্বাভাবিকভাবেই যে কোনও এলাকার বায়ুমণ্ডলে উপস্থিত এরোসল আম্লিক প্রকৃতির হয়ে থাকে। এটি আসলে এরোসলের একটি মূল শারীরিক-রাসায়নিক ধর্ম, যা ওই অঞ্চলের বায়ুমণ্ডলীয় কিছু প্রাকৃতিক ঘটনাকে প্রভাবিত এবং ত্বরান্বিত করে। এরোসল পরিবেশে গৌণ জৈবিক এরোসল গঠনে সহায়তা করে, আকাশে মেঘ ঘনীভূত হতে সাহায্য করে, সামুদ্রিক লবণ থেকে পরিবেশে ক্লোরিনকে মুক্ত হতে সাহায্য করে, স্থলজ বাস্তুতন্ত্রে কিংবা সামুদ্রিক পরিবেশে পুষ্টি উপাদান বয়ে নিয়ে যায়, এছাড়াও বিশেষ করে বিক্রিয়া ধর্মী অক্সিজেনপূর্ণ পার-অক্সাইড যৌগ, সুপার-অক্সাইড অ্যানায়ন এবং হাইড্রক্সিল মূলক উৎপাদনে অংশ নেয়। গবেষণায় দেখা গেছে বায়ুদূষণের কারণে পরিবেশে এইধরনের বিক্রিয়া ধর্মী অ্যানায়ন বা মূলকের উৎপাদন এবং সঞ্চিত হওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। এর মাত্রা যদি কোনও জীবন্ত জীবের ধারণ ক্ষমতার বাইরে চলে যায় তাহলে সেই জীবের ‘সেল বার্ন’ বা কোষ নষ্ট হয়ে যায় এবং ডিএনএ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এরোসলের বর্ধিত আম্লিকতা তার জারণ ক্ষমতাকে বাড়িয়ে তোলে, ফলে প্রাণীদেহের প্রোটিন ও লিপিড এবং উদ্ভিদ দেহের কোষ, ডিএনএ, কোষপর্দার তারল্য, ব্যাপ্তিযোগ্যতা, বিভিন্ন মাইটোকন্ড্রিয়ার প্রক্রিয়ায় বিপত্তি, অ্যাডিনোসিন ট্রাইফসফেটের উৎপাদন বন্ধ এবং সর্বোপরি অ্যা-পপটোসিস, নেক্রোসিস বা কলাবিনষ্টি হতে পারে। সুন্দরবনের বাস্তুতন্ত্রও এভাবেই ধ্বংস হচ্ছে প্রতিদিন!
আরও পড়ুন-নাবালিকাকে অপহরণ চলন্ত বাসেই গণধর্ষণ
পৃথিবীর ক্রান্তীয় এবং উপক্রান্তীয় জলবায়ু অক্ষাংশে সচরাচর সামুদ্রিক জোয়ার যেখানে আসে, সেইসব জল-স্থল সীমান্তে ম্যানগ্রোভ জাতীয় উৎপাদনশীল জলাভূমি গড়ে ওঠে। বিজ্ঞানের পরিভাষায় কেউ বলে ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট, কেউ ম্যানগ্রোভ সোয়াম্পস, কেউ বলে ম্যানগ্রোভ থিকেটস, তো কেউ আবার শুধুই মঙ্গলস। একসময় পৃথিবীর ক্রান্তীয় সমুদ্রতট এলাকার প্রায় তিন- চতুর্থাংশ জুড়েই ছিল ম্যানগ্রোভ অরণ্য, যার অধিকাংশই ছিল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া মহাদেশে বিশাল বৈচিত্র্যের সঙ্গে। বর্তমানে পৃথিবীর প্রায় ১১৮টি দেশে মোটামুটিভাবে ৮০টি প্রজাতির ম্যানগ্রোভ দেখা যায়। পৃথিবীর মধ্যে এদের সবচেয়ে বেশি দেখা যায় ৫°উঃ- ৫°দঃ অক্ষাংশের মধ্যবর্তী অঞ্চলে। মোট ম্যানগ্রোভ ফরেস্টের প্রায় ৭৫% রয়েছে পৃথিবীর মাত্র ১৫টি দেশে। ২০১৮ খ্রিস্টাব্দের দ্য গ্লোবাল ম্যানগ্রোভ ওয়াচ ইনিশিয়েটিভের সমীক্ষা অনুযায়ী, ২০১০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত গোটা বিশ্বে মোট ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের ক্ষেত্রফল ছিল ১,৩৭,৬০০ বর্গ কিলোমিটার, এর মধ্যে এশিয়া মহাদেশে সর্বাধিক ৩৮.৭%। আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবন একাই ১০০০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে রয়েছে। ম্যানগ্রোভ ফরেস্টে ছোট ছোট ঝোপঝাড় থেকে শুরু করে ৬০ মিটার লম্বা দানব বৃক্ষও দেখা যায় যা ইকুয়েডর অঞ্চলে রয়েছে। জোয়ারের জলে পুষ্ট এবং পলিমাটিতে গজিয়ে ওঠা এই অদ্বিতীয় ইকোসিস্টেম একটি বিস্তীর্ণ এলাকার জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ করে, সমুদ্রের তটরেখা স্থিতিশীল করে, ভূমিক্ষয় রোধ করে, বায়ুর উষ্ণ স্রোত, জোয়ারের প্লাবন, ঢেউ এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে মোকাবিলা করে পরিবেশ এবং জনজীবনকে রক্ষা করে। পরিবেশের তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত এবং ঋতু পরিবর্তন ও তার বৈচিত্র্য রক্ষা করতে ম্যানগ্রোভ অরণ্যের জুড়ি মেলা ভার। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আমরা আমাদের ব্যক্তিস্বার্থকে ঊর্ধ্বে রেখে প্রতিনিয়ত পরিবেশের ক্ষতি করে চলেছি। তবে এর মাশুল আমাদেরকই গুনতে হচ্ছে। সেই বিখ্যাত ক্রি ভবিষ্যদ্বাণীর কথা বারবার মনে পড়ছে, যখন সমস্ত গাছ কাটা হয়ে যাবে, সমস্ত প্রাণীদের শিকার করা হবে, যখন সব জায়গার জল দূষিত হয়ে যাবে, যখন মুক্তবায়ু শ্বাস নেওয়ার উপযুক্ত থাকবে না, কেবল তখনই কি আমরা বুঝতে পারব যে টাকা খাওয়া যায় না?! ওরে ও অবুঝ বাঁচাও সবুজ।