পৃথিবীর উত্তর আর দক্ষিণে দুটো খুব বড় এলাকা রয়েছে, যাদের বলে মেরু-অঞ্চল। উত্তরে সুমেরু আর দক্ষিণে কুমেরু। এই দুটো এলাকার প্রায় সবটুকু জায়গাই সারা বছর ঢাকা থাকে বরফের চাদর দিয়ে। সূর্যের যেটুকু আলো পৃথিবীতে আসে, তার অনেকটা অংশই আবার মহাকাশে ফিরে যায় এই বরফের আয়নার গায়ে প্রতিফলিত হয়ে। যে-কারণে পৃথিবীর উষ্ণতা খুব বেশি বাড়তে পারে না।
ওইসব এলাকায় মূল মেরু অঞ্চলের বরফ (Ice) ছাড়াও রয়েছে চারপাশের সামুদ্রিক বরফের বিস্তীর্ণ এলাকাও। এইসব বরফের চাদরও যত পাতলা হতে থাকবে, ওর নিচে থাকা অন্ধকার অতলস্পর্শী সমুদ্রের জল তত বেশি করে সূর্যের তাপ আর আলোকে শোষণ করবে, ফলে বাড়তে থাকবে জলের উষ্ণতা, আর গরম হতে থাকবে পৃথিবী।
দুর্গম মেরু অঞ্চলে না গিয়েও, আধুনিক উন্নত উপগ্রহ-চিত্রের সাহায্যেই এখন দেখে নেওয়া যায় ওই সব এলাকার পরিস্থিতি। আগেকার আমলের চেয়ে উপগ্রহ-চিত্র অনেকটা পরিষ্কার তথ্য জানাতে সক্ষম এখন। মেরুপ্রদেশের বরফের কতটা পরিমাণ গলছে, কোন দিকে কোথায় কতটা গলে যাওয়ার আশঙ্কা বা সেখানকার পরিবেশের উষ্ণতা কোথায় কত, সবই যন্ত্র মেপে দিতে পারে। আর সেরকমই এক পরিমাপের তালিকা প্রকাশিত হয়েছে সম্প্রতি, সেই তালিকার তথ্য সত্যিই চিন্তায় ফেলে দেওয়ার মতো। আমেরিকার ন্যাশনাল স্নো অ্যান্ড আইস ডেটা সেন্টার (NSIDC)-এর তরফে প্রকাশিত হয়েছে এই তথ্য।
গত ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিকে টানা পাঁচ দিন ধরে মাপা হয়েছিল দুই মেরু অঞ্চলের মোট বরফে ঢাকা সামুদ্রিক এলাকার ক্ষেত্রফল। সেটা দেখে জানা যাচ্ছে যে গত ২০২৩ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসের দিকে এই সামুদ্রিক বরফে ঢাকা এলাকার যে-ক্ষেত্রফল মেপে দেখা গিয়েছিল, এবারে তার চেয়েও কমে গিয়েছে। এর অর্থ, ওই বরফের পরিমাণ তো কমছেই, কমে যাচ্ছে বরফে ঢাকা জায়গাও। আগের বারের ওই পরিমাপে মোট জায়গার পরিমাণ ছিল ১.৫৯৩ কোটি বর্গ কিলোমিটার, আর এবারে সেটা কমে দাঁড়িয়েছে ১.৫৭৬ কোটি বর্গ কিলোমিটার। এখনও পর্যন্ত স্বল্প-পরিমাণ বরফের রেকর্ড এটাই।
অনেক বছর আগে থেকেই এই দুটো এলাকার দিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখছেন বিজ্ঞানীরা। পৃথিবীর গোটা শরীর জুড়ে যে-অসুখ রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়ছে পরিবেশ দূষণের কারণে, তার সবচেয়ে বড় ইঙ্গিত মেলে এই জায়গা দুটো থেকেই। মেরু অঞ্চলের বরফও যে গলে যাচ্ছে দ্রুত, সেটা অনেকদিন ধরেই মেপে যাচ্ছেন বহু বিজ্ঞানী। তাঁদের বক্তব্য, আগামী দিনে আসতে চলেছে খুব বড় বিপদ। বরফ (Ice) গলে যাওয়ার ফলে যেমন একদিকে বাড়ছে জলের উষ্ণতা, অন্যদিকে বাড়ছে জলের উচ্চতাও। সমুদ্রের উচ্চতা এইভাবে একটু একটু করে বাড়তে থাকলে অদূর ভবিষ্যতেই তলিয়ে যাবে বিশ্বের বহু সমুদ্র-উপকূলের শহর বা গ্রাম। একটা তথ্য বলছে যে ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বের প্রায় একশো কোটি মানুষের জীবন বিপন্ন হয়ে পড়বে বন্যার কবলে পড়বার ফলে। সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়তে পারে এমন শহরগুলোর তালিকায় রয়েছে ব্যাঙ্কক, আমস্টারডাম, ভিয়েতনাম, ইউরোপের লন্ডন বা কার্ডিফ, আমেরিকার নিউ অরলিয়ানস বা ফিলিপাইনস-এর ম্যানিলা-র মতো বেশ কিছু শহরের নাম। এছাড়া ঝড়, সাইক্লোন বা সুনামির মতো আরও বহু ধরনের বিপদের আশঙ্কাও তো রয়েছেই। বিশ্ব উষ্ণায়ন যে শুধু কথার কথা নয়, তার থাবা বসতে শুরু করেছে পৃথিবীর শরীরের নানা জায়গায়, এটা এখন প্রমাণিত।
বরফ গলার অতীত ইতিহাস
উত্তর মেরু অঞ্চলের বরফ যে গলছে বেশ দ্রুতগতিতেই, এটা টের পাওয়া গিয়েছিল অনেক বছর আগেই। সেই ১৯৮০ সালের গ্রীষ্মকালের দিকে এখানকার সামুদ্রিক বরফে ঢাকা এলাকার পরিমাণ ছিল সত্তর লক্ষ বর্গ কিলোমিটার, সেটাই গত দশকে এসে কমে দাঁড়ায় পঁয়তাল্লিশ লক্ষ বর্গ কিলোমিটারে, গড়ে প্রতি দশকে যার হ্রাস পাওয়ার পরিমাণ ১২ শতাংশ। তারপর থেকে এই কয়েক বছরে সেই কমে যাওয়ার পরিমাণ তো থামেইনি, বরং আরও বেড়ে চলেছে। তবে দুই মেরুর মধ্যে তুলনায় দেখা গিয়েছে যে দক্ষিণ মেরুর সামুদ্রিক বরফ-স্তর গত কয়েক বছরে আরও বেশি পরিমাণে কমে চলেছে। এতটা হ্রাস পাওয়া আগে দেখা যায়নি। দক্ষিণ মেরুর চারপাশেই রয়েছে সমুদ্র; সেই কারণে এখানে বাতাসের প্রবাহ বেশি, আর বরফের স্তরও উত্তর মেরুর চেয়ে বেশি-বেশি ভেঙে যায় বাতাসের প্রভাবে।
এমনিতে এইরকম সামুদ্রিক ভাসমান বরফের স্তর শীতকালে ঠাণ্ডায় পুরু হয় এবং পরিমাণে বেড়ে যায়, আর গরমকালে কমে যায়, বা কোথাও একেবারে থাকেই না। কিন্তু আগেকার চেয়ে এখন এই বরফ-স্তর এইভাবে কমে যাওয়াটা বিজ্ঞানীদের কপালে ভাঁজ ফেলেছে। ওঁরা এটাও দেখেছেন, আগের চেয়ে এখন বরফ জমছে অনেক দেরি করে। ওঁদের অনেকে বলছেন, ২০৫০ সালের মধ্যে এমন পরিস্থিতি আসবে, যখন উত্তর মেরুর চারপাশের সমুদ্রে আর সামুদ্রিক বরফের স্তর বলে কিছুই থাকবে না। তেমনটা ঘটবার সময় এগিয়ে আসছে দ্রুত।
সামুদ্রিক বরফের (Ice) স্তর কমে যাওয়ার অর্থ হল ওই সব এলাকার নিজস্ব যেসব প্রাণী, যেমন মেরু ভালুক (উত্তর মেরুর নিজস্ব) বা পেঙ্গুইন (দক্ষিণ মেরুর নিজস্ব), এসবেরও সংখ্যা কমে যাওয়া। পরিবেশের বাস্তুতন্ত্রের ওপর এইভাবে স্থানীয় প্রাণীদের হ্রাস পাওয়া বেশ ভালরকম খারাপ প্রভাব ফেলে। যেমন প্রভাব পড়ে সামুদ্রিক বরফ কমে যাওয়ার ফলে সমুদ্রের নোনা-ভাব কমে যাওয়ায় বা সমুদ্র স্রোতের অনিয়মিত হয়ে পড়ায়। আগামী দিনে বিশ্ব উষ্ণায়নের খুব বড় একটা কারণ এই বরফ কমে যাওয়াটা যে অনেকটাই ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে চলেছে পরিবেশ বা মানব সভ্যতার ওপর, তা নিয়ে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত। পরিবেশকে বাঁচানোর দায় শুধু তাঁদের নয়, আমাদের প্রত্যেকেরই, এটা এই দুঃসময়ে মোটেই ভুললে চলবে না।