এখন কান পাতলেই চারিদিকে কোকিলের কুহু কুহু রব শোনা যাচ্ছে। আমগাছে মুকুল তার মিষ্টি গন্ধ চারিদিকে ছড়িয়ে দিচ্ছে। মিঠেল হাওয়ার পরশে প্রাণ-মন জুড়িয়ে যাচ্ছে। কৃষ্ণচূড়া, শিমুল তাদের লাল রঙের আবির ছড়িয়ে দিচ্ছে প্রকৃতির কোলে। আর প্রকৃতি জানান দিচ্ছে বসন্ত এসে গেছে। আমাদের ছয় ঋতুর মধ্যে বসন্তকালকে বলা হয় ঋতুরাজ। এই ঋতুরাজ আমাদের জীবনে যেমন প্রেম বয়ে আনে ঠিক তেমনি তার খামখেয়ালি ভাবের জন্য আমরা অসুস্থও হয়ে পড়ি। বসন্তকাল মানে ঠান্ডার শেষ গরমের শুরু। আর এই আবহাওয়া পরিবর্তনের সময়ই আমরা নানানভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ি। এই সময় বাতাসে প্রেমের সাথে সাথে ভাইরাস ব্যাকটেরিয়ারাও ভেসে বেড়ায়। আর এই সমস্ত ভাইরাস ব্যাকটেরিয়ার হাত থেকে বাঁচার জন্য এই সময়ে নিয়মিত আমাদের কিছু পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ করা উচিত। পুষ্টিবিদদের মতে নিয়মিত পুষ্টিকর খাবার খেলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। বসন্তকালের খাদ্য তালিকায় অবশ্য করেই নিমপাতা, সজনে ফুল, সজনেডাঁটা, সামুদ্রিক মাছ, রসুন, সবুজ শাকসবজি, লালআলু, মাসরুম ইত্যাদি রাখতে হবে।
নিমপাতা : বসন্তকালের খাদ্য তালিকায় নিমপাতা একটি অত্যন্ত উপকারী জিনিস। এই সময় নিমপাতার রস করে খাওয়া যেতে পারে। বসন্তকালে যে এলার্জি জাতীয় সংক্রমণ— হাম, পক্স, চোখের সমস্যা ইত্যাদি দেখা যায় তার থেকে দূরে রাখতে পারে এই নিমপাতা। সেক্ষেত্রে এই সময় নিম-বেগুন ভাজা প্রথম পাতে রাখা যেতেই পারে। নিমপাতার তেতো স্বাদের জন্য অনেকেই এই খাবারটি থেকে শতহস্তে দূরে থাকে। কিন্তু রোগ প্রতিরোধে নিমপাতা বহুল উপকারী একটি খাদ্যবস্তু। নিম-বেগুন করার ক্ষেত্রে প্রথমে শুকনো কড়াইয়ে নিমপাতা ভেজে নিতে হবে তারপর কুচি কুচি করে কাটা বেগুন ভেজে নিয়ে তার মধ্যে নিম পাতা দিয়ে দিতে হবে। এরপর স্বাদমতো নুন দিয়ে মিক্স করে নিলেই তৈরি নিম-বেগুন। অনেকের আবার বেগুন খেলে এলার্জি হয় সেক্ষেত্রে তারা শুধু নিমপাতা শুকনো কড়াইয়ে ভেজে তার মধ্যে সামান্য পরিমাণ ঘি দিয়ে সেটা ভাতের প্রথম পাতে খেতে পারে। এছাড়াও নিম পাতার রস খাওয়া যেতে পারে। নিমপাতায় অ্যান্টি ব্যাকটেরিয়াল এবং আন্টি ইনফ্লেমেটরি গুণ থাকে। যেটা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে তুলতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
সজনে ফুল : বসন্তকালে রোগের প্রকোপ থেকে বাঁচতে আরও একটি উপকারী খাদ্য হচ্ছে সজনে ফুল। এই সজনে ফুলে ব্যাকটেরিয়ার সঙ্গে লড়াই করার বিশেষ ক্ষমতা আছে। এই আবহাওয়া পরিবর্তনের সময় অনেকেরই ঠান্ডা লেগে বুক-গলায় সংক্রমণ হয়। এই সংক্রমণ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য সজনে ফুল অত্যন্ত উপকারী একটি খাদ্য। সজনে ফুলে ভিটামিন এ (A), বি ওয়ান (B1), বি টু (B2), বি থ্রি (B3), এবং সি (C) ছাড়াও ক্যালসিয়াম, আয়রন, ফসফরাস, ম্যাগনেসিয়াম রয়েছে। এছাড়াও এই সজনে ফুল শরীরে প্রোটিনের জোগান দেয়। আর সেই কারণেই এই সময়ে পাতে রাখা যেতে পারে সজনে ফুলের বিভিন্ন ধরনের পদ।
সজনে ডাঁটা : বসন্তকালের খাদ্য তালিকায় সজনে ডাঁটা একটি অত্যন্ত উপকারী খাদ্যবস্তু। বসন্তকালে পক্স, হামের মতো রোগের হাত থেকে বাঁচায় এই সজনে ডাঁটা। এছাড়াও সজনে ডাঁটার মধ্যে থাকা অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, ভিটামিন সি অ্যালার্জি প্রতিরোধ করে। এই বসন্ত ঋতুতে সজনে ডাঁটা দিয়ে তৈরি বিভিন্ন সুস্বাদু রেসিপি খাদ্য তালিকায় যোগ হতেই পারে।
পালংশাক : পালংশাকে আছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং খনিজ পদার্থ। যে-সমস্ত পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ সবুজ শাকসবজি পাওয়া যায় তার মধ্যে পালংশাক হচ্ছে অন্যতম। আর সেই কারণে পালংশাক শরীরকে রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সাহায্য করে। সেইজন্য বসন্তকালের খাদ্য তালিকায় পালংশাকের সুপ থেকে শুরু করে ঘন্ট— নানা ধরনের পদ রাখা যেতেই পারে।
দই : আমাদের শরীরে যে টক্সিন আছে, সেই টক্সিন যদি শরীর থেকে বের হয়ে যায় তাহলে আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে। এই টক্সিনমুক্ত করার জন্য টকদই একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ খাদ্যবস্তু। আর সেই কারণে বসন্তকালে আমাদের খাদ্য তালিকায় টকদই রাখা অত্যন্ত প্রয়োজন। এই টকদই বসন্তরোগ প্রতিরোধের জন্য অনবদ্য।
মাশরুম : মাশরুম হচ্ছে একটি পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ খাদ্যবস্তু। রক্তের শ্বেতকণিকার পরিমাণ বাড়াতেও মাশরুমের উপকারিতা লক্ষণীয়। বাথরুম হচ্ছে একটি সহজপাচ্য এবং হালকা খাবার। তাই বসন্তকালে আবহাওয়া পরিবর্তনে ইমিউনিটি বাড়ানোর জন্য খাদ্য তালিকায় অবশ্যই মাশরুমের বিভিন্ন পদ রাখা উচিত।
আরও পড়ুন- মিথ্যাচার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর, অশান্তির আগুন এবার নাগাল্যান্ডেও
রাঙা আলু : বসন্তকালে আমাদের ত্বকেও নানা রকমের সংক্রমণ দেখা যায়। আর ত্বকে ভাইরাস ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ রক্ষার এই সময় প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ (A) প্রয়োজন হয়ে থাকে। রাঙা আলুতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ থাকে। আর সেই কারণে বসন্তকালের খাদ্য তালিকায় রাঙা আলু একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় সবজি।
সামুদ্রিক মাছ : সামুদ্রিক মাছ ফুসফুসের সংক্রমণ রুখতে সাহায্য করে। আর বসন্তকালে ফুসফুসের সংক্রমণ দেখা যায়। আর এই কারণেই বসন্তকালের খাদ্য তালিকায় ইলিশ, স্যালমান, ম্যাকরেল, চিংড়ি, কাঁকড়া রাখা যেতেই পারে। এই মাছগুলোর মধ্যে রয়েছে সেলেনিয়াম ও ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড। আর এইগুলি ফুসফুসের সংক্রমণ রুখতে সাহায্য করে।
কাঁচা হলুদ : লিভারের অব্যর্থ ওষুধ হচ্ছে কাঁচা হলুদ। বসন্তকালে এই কাঁচা হলুদ সর্দি এবং চর্মরোগ থেকে দূরে রাখে। এ-ছাড়াও কাঁচা হলুদের অ্যান্টি ব্যাকটেরিয়াল উপাদান বহু রোগের হাত থেকে বাঁচাতে সক্ষম। আর সেই কারণে বসন্তকালে প্রতিদিন এক টুকরো কাঁচা হলুদ খাওয়া উপকারী।
মধু : সকালবেলায় যদি খালি পেটে মধু খাওয়া যায় তাহলে সেটি শরীরকে চাঙ্গা করতে একটি বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এছাড়াও এই মধু রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি আবহাওয়া পরিবর্তনের ফলে যে জ্বর হয়, তার হাত থেকেও শরীরকে রক্ষা করে।
ফল ও শাকসবজি : বসন্তকালের খাদ্য তালিকায় প্রচুর পরিমাণে শাকসবজি এবং ফল রাখতে হবে। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে ফল এবং সবজি।
এছাড়াও বসন্তকালের খাদ্য তালিকায় রাখতে হবে পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রোটিন। প্রতিদিনই নিয়ম করে মাছ, মাংস, মসুরির ডাল, সয়াবিন, ডিম এগুলো খাওয়া উচিত। এ-ছাড়াও রান্নায় রসুন, আদার ব্যবহার করতে হবে। এই সময় অতিরিক্ত ফাস্টফুড খাওয়া একদমই উচিত নয়। এই সময় সহজপাচ্য খাবার খেতে হবে। খাওয়ার পাশাপাশি শরীরচর্চা, পরিমিত ঘুম— এগুলোর দিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে।