আধুনিক ভারতে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য মানবতাবিরোধী ঘটনা কোনটা, এই কথাটি আলোচনা করলে অবশ্যই মনে আসে দেশভাগের কথা। এদেশে ধর্ম ও রাজনীতি একত্রিত হয়ে মানুষের কত ক্ষতি করেছে তা সারা বিশ্বের কাছে নজির। কিন্তু ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার যে রাজনীতি তা গত একশো বছরে গড়ে উঠলেও ধর্মীয় গোঁড়ামি বা রেষারেষির ইতিহাস নতুন নয়। অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গে এইজন্যই গান্ধীজি সংযুক্ত করেছিলেন খিলাফতের দাবি। কিন্তু সেই দাবির পাশে যে নেতৃত্ব দাঁড়িয়েছিলেন তাঁরা অবশ্যই যথেষ্ট প্রগতিশীল ছিলেন না। এক অর্থে তাঁরা প্রতিক্রিয়াশীল ছিলেন।
এই বিষয়টি সর্বপ্রথম নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করেন সুভাষচন্দ্র বসু। আজ থেকে ঠিক একশো বছর আগের একটি ঘটনার উল্লেখ করে সুভাষচন্দ্র (Subhas Chandra Bose) তাঁর The Indian Struggle গ্রন্থে লিখছেন, ‘‘In March 1924, Mustapha Kemal Pasha took the extraordinary step of abolishing the Khalifate altogether. Those Moslems who had been drawn towards the Indian National Congress owing to the desire to secure support for the Khilafat campaign, no longer felt any urge to remain friendly towards the Congress” (114-115).
এখানে সুভাষচন্দ্র নির্দিষ্ট ধর্মীয় চাহিদাভিত্তিক রাজনীতির সঙ্গে বৃহত্তর মানবিক দাবিগুলোর যে একটি আপাতবিরোধ রয়েছে তার উল্লেখ করেছেন এবং বলতে চেয়েছেন যে মানুষের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সবাইকে নিয়ে চলার নীতিতে বিশ্বাসী কিন্তু ধর্মীয় গোঁড়ামির সঙ্গে অনেক সময় ব্যক্তিগত স্বার্থ জড়িত থাকে যা হয়তো সাদা চোখে দেখা যায় না।
আমরা জানি যে সুভাষচন্দ্র (Subhas Chandra Bose) স্বামী বিবেকানন্দের ভাবশিষ্য ছিলেন। বিবেকানন্দের সামাজিক চিন্তা ও কর্ম অত্যন্ত মূল্যবান হলেও তিনি কোনও অর্থেই রাজনৈতিক নেতা ছিলেন না। একইসঙ্গে বিবেকানন্দ ছিলেন সেই ধর্মগুরু ও চিন্তাবিদ যিনি অন্য ধর্ম বা আরও নির্দিষ্টভাবে বললে ইসলাম ধর্মের ইতিবাচক দিকগুলির প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। সুভাষচন্দ্রের রাজনৈতিক গুরু ছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ। তিনি পারিবারিক সূত্রে ব্রাহ্ম হলেও হিন্দু ধর্মের আচার পালন করতেন। তাঁর রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহ আজও দেউলটিতে শরৎচন্দ্রের বাসভবনে নিত্যপূজা পায়। তাঁর সম্পাদিত পত্রিকাটির নামও ছিল ‘নারায়ণ’। এ-হেন দেশবন্ধু আজ থেকে ঠিক একশো বছর আগে দুটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন যা তাঁর গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের রাজনীতির সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ।
এই ২০২৪-এ দাঁড়িয়ে আমরা যখন একটি মন্দির প্রতিষ্ঠাকে কেন্দ্র করে দেশ জুড়ে প্রবল আতিশয্য এবং মহন্ত ও রাজনীতিবিদদের একত্রিত হতে দেখছি তখন একথা উল্লেখযোগ্য যে ১৯২৪ সালে এক ব্যাভিচারী মহন্তের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন দেশবন্ধু। সুভাষচন্দ্র সেই ‘তারকেশ্বর সত্যাগ্রহ আন্দোলন’ সম্পর্কে লিখেছেন, ‘‘Notices were served on the Mohunt calling upon him to mend his ways but as these attempts were of no avail, in April 1924, the Deshabandhu launched a movement for taking peaceful possession of the temple and the attached property, with a view to placing them under the administration of a public committee.”
মহন্তের মন্দিরের তহবিল তছরুপ এবং ব্যক্তিগত জীবনাচরণের অন্ধকার দিকের বিরোধিতা করে জনসাধারণকে সঙ্গে নিয়ে দেশবন্ধুর এই সত্যাগ্রহ আন্দোলন সেদিনের বঙ্গসমাজে এক ভিন্ন ধারার ‘মন্দির আন্দোলন’-এর জন্ম দিয়েছিল যার নেপথ্যে ক্রিয়াশীল ছিল গণতান্ত্রিক চেতনা। এই সত্যাগ্রহ প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী হয়েছিল। সত্যাগ্রহ আন্দোলন ভাঙতে মহন্ত ব্রিটিশ পুলিশের সাহায্য নিয়েছিলেন এবং প্রথম যে সত্যাগ্রহী কারাবরণ করেন তিনি হলেন দেশবন্ধুর পুত্র চিররঞ্জন।
একথা উল্লেখ করতে হল কারণ আজ যখন একটি মন্দিরের জন্য দেশের এক বিশেষ সম্প্রদায়ের মানুষের প্রতি দোষারোপের ঝালাপালা চলছে তখন বুঝতে হবে ‘নিজধর্ম’ রক্ষার জন্য নিজের সম্প্রদায়ের দোষগুলির বিরুদ্ধেও আমাদের উচ্চকণ্ঠ হওয়াটা অপ্রাসঙ্গিক নয়।
দেশবন্ধু নিয়ে এসেছিলেন ঐতিহাসিক বেঙ্গল প্যাক্ট। অনেকেই মনে করেন যে সেই নীতি কার্যকর হলে হয়তো বাংলা অবিভক্তই থাকত। হিন্দু মুসলিম সহাবস্থানের জন্য দেশবন্ধুর এই ভাবনা কতটা প্রাসঙ্গিক ছিল তা আমরা আজ অনুভব করতে পারি। দেশবন্ধুর অকালপ্রয়াণে সেই সম্ভাবনা অঙ্কুরে বিনষ্ট হল। সুভাষচন্দ্রের আক্ষেপ— The death of Deshabandhu on June 16th, 1925, was for India a national calamity of the first magnitude.
আরও পড়ুন- আজ বকেয়া নিয়ে কেন্দ্র-রাজ্য বৈঠক
বাংলা হারাল তার প্রথম ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক নেতাকে। কিন্তু তিনি যে ‘মৃত্যুহীন প্রাণ’ দিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর প্রধান শিষ্য সুভাষচন্দ্রকে! সুভাষচন্দ্র (Subhas Chandra Bose) যখন নেতাজি হননি, জাতীয় কংগ্রেসের নেতা ছিলেন, সর্বদাই স্মরণ করেছেন তাঁর রাজনৈতিক গুরুকে। কংগ্রেসের মধ্যে যখনই ধর্মীয় ভেদভাব লক্ষ্য করেছেন আন্তরিক ভাবে তার বিরোধিতা করেছেন। যখন তিনি নেতাজি, আইএনএ-র সর্বাধিনায়ক, তখন প্রতিষ্ঠা করেছেন তাঁর ভাবনাকে। সমমর্যাদা দিয়ে গেছেন তাঁর সহযোদ্ধাদের। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছেন মহম্মদ জামান কিয়ানী, শাহনাওয়াজ খান, জি এস ধীঁলো, লক্ষ্মী সেহগল, আবিদ হাসান প্রমুখ। এক আধুনিক, উন্নত, ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের স্বপ্ন দেখেছিলেন তাঁরা। আবিদ হাসান ছিলেন সুভাষচন্দ্রের ছায়াসঙ্গী। তাঁর এবং আজাদ হিন্দ রেডিওর মুমতাজ হুসেইনের সহায়তায় সুভাষচন্দ্র নির্মাণ করলেন আজাদ হিন্দের কওমি তরানা। ‘জয় হিন্দ’ স্লোগানের জন্ম দিলেন আবিদ হাসান। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস!
আজাদ হিন্দ ফৌজের ক্যাপ্টেন রশিদ আলির মুক্তির জন্য যে কলকাতা শহরের হিন্দু-মুসলিম একদিন রাজপথ আলোড়িত করেছিল, যে রশিদ আলি দিবস আজও আমাদের শোণিতপ্রবাহকে চঞ্চল করে তোলে তা মতলববাজদের জন্য ব্যর্থ হল। ওই সময়েই কলকাতা দেখল উদ্বাস্তু স্রোত। বাঙালির জীবনের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি। সুভাষচন্দ্র নেই, মহাত্মা বিনিদ্র রজনী যাপন করছেন। দেশ স্বাধীন হচ্ছে। দেশভাগও হচ্ছে। জাতীয় সঙ্গীতের আদলে গড়া কওমি তরানা গেয়ে ওঠা গেল না। ‘সব মিলকে’ ‘জয় হিন্দ’ বলা গেল না।
তবু স্বপ্নেরা মরে না। এসে বলে যায়, এগোতে হবে, ‘সব ভেদ আউর ফর্ক মিটাকে।’