সেপসিস দিবস

সমীক্ষা বলছে বিশ্ব জুড়ে পাঁচজনের মধ্যে একজনের মৃত্যু সেপসিসের কারণে ঘটে। যার পরিসংখ্যান ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি। সেই কারণে জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি করতে প্রতিবছর ১৩ সেপ্টেম্বর পালিত হয় ‘বিশ্ব সেপসিস দিবস’। সেপসিস কী? এর প্রতিরোধ কী? লিখছেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী

Must read

প্রতি কয়েক সেকেন্ডে কারও না কারও মৃত্যু ঘটছে সেপসিসে। ১৯৫টি দেশের মেডিক্যাল রেকর্ডের ভিত্তিতে ল্যানসেটে প্রকাশিত একটি সমীক্ষায় দেখা যায় যে বছরে ৪ কোটি ৯০ লাখ মানুষ সেপসিসে আক্রান্ত হয়। কাজেই ‘বিশ্ব সেপসিস দিবস’ এক বিশ্বজনীন সচেতনতামূলক কর্মসূচি। গ্লোবাল সেপসিস জোটের উদ্যোগে ২০১২ সাল থেকে এই দিবস পালন শুরু হয়। প্রতিবছর ১৩ সেপ্টেম্বর সেপসিসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে এবং যাতে সময়ে ব্যবস্থা নেওয়া যায় সেই বিষয়ে জনগণকে সচেতন করতে এই দিনটি পালন করা হয়।

আরও পড়ুন-বিধায়ক তহবিলের অর্থানুকূল্যে অ্যাম্বুল্যান্স উদ্বোধনে চিরঞ্জিত

সেপসিস কী
সেপসিস আসলে এক গুপ্তঘাতক। আমরা প্রায়শই শুনি যে একটা কোনও বড় রোগের লড়াই করতে করতে একটা সময় সেপ্টিসেমিয়া হয়ে রোগী মারা গেছে। আসলে ব্যাকটেরিয়াল, ফাঙ্গাল, ভাইরাল, প্যারাসাইটিকাল ইত্যাদি শরীরের যে কোনও অঙ্গের সংক্রমণ বা ইনফেকশনই সেপসিসে পরিণত হতে পারে। তবে সাধারণত ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণের ক্ষেত্রেই সেপ্টিসেমিয়ার কথা শোনা যায়। ভাইরাসঘটিত সংক্রমণের ক্ষেত্রে নয়। ল্যাটিন ‘এমিয়া’ শব্দটির অর্থ রক্ত। অর্থাৎ ফুসফুস, কিডনি, খাদ্যনালি বা অন্য যে কোনও অঙ্গের সংক্রমণ যখন রক্তে প্রবেশ করে, তখন তাকে বলা হয় সেপ্টিসেমিয়া। যেমন ধরে নেওয়া যায় কোনও ব্যক্তির সিভিয়র নিউমোনিয়া হয়েছে। নিউমোনিয়া অর্থাৎ ফুসফুসের সংক্রমণ। এই ফুসফুসের সংক্রমণ হঠাৎ করে যদি রক্তে প্রবেশ করে, তখন সেটা সেপ্টিসেমিয়া হয়ে যায়। এই সেপটিসেমিয়ার ফলে শরীরে প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। ক্রিয়া এবং বিক্রিয়ায় দেহের অন্যান্য অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অনেক সময়ই এর জেরে একাধিক অঙ্গ অকেজো হয়ে যায় এবং মৃত্যু পর্যন্ত ঘটে। এই অবস্থাকে বলা হয় সেপসিস। মানুষের রোগ প্রতিরোধ শক্তি অতিরিক্ত কাজ করার ফলে সেপসিস হতে পারে। এই রোগ প্রতিরোধ শক্তি কেবল সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করার পরিবর্তে শরীরের অন্য অঙ্গগুলোকেও আক্রমণ শুরু করে। কোনও একটা পর্যায়ে মানুষের অঙ্গ অকেজো হয়ে যায়। এমনকী বেঁচে থাকা ব্যক্তির দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হয়।

আরও পড়ুন-আবারও বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু

যখন-তখন সেপসিস হয় না
আমাদের শরীরে রোজ একাধিক ব্যাকটেরিয়া প্রবেশ করে। সেইসব ব্যাকটেরিয়া কোনও ক্ষতি করতে পারে না। কারণ আমাদের শরীরে তৈরি হয় এক ধরনের প্রোটিন উৎসেচক বা কেমোকাইন যেটি ব্যাকটেরিয়ার সঙ্গে কেমিক্যাল রি-অ্যাকশন বা রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটিয়ে তাদের মেরে ফেলে। কিন্তু যদি কোনও ব্যাকটেরিয়া খুব ক্ষতিকারক ও শক্তিশালী হয় তাহলেই বিপদ। তখন তা শরীরে প্রবেশ করামাত্র আমাদের রোগ প্রতিরোধ শক্তি লড়াই শুরু করে এবং একটা সময়ে গিয়ে শরীরের প্রতিরোধ ব্যবস্থা পরাজিত হয়। এই সময়ই সেপসিস রোগের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। প্রতিটা অঙ্গ, প্রত্যঙ্গকে ধরতে শুরু করে। অর্থাৎ ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ ছড়ানোর ক্ষমতা এবং ব্যক্তির রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতার মধ্যে যুদ্ধ চলে এবং যার ক্ষমতা বেশি সে জেতে। যদি কোনও শক্তিশালী ইনফেক্টিভ অর্গানিজ়ম শরীরে প্রবেশ করে, তখন রোগের তীব্রতা বাড়বে।
সেপসিস কাদের হতে পারে
সেপসিস রোধের প্রথম শর্ত রোগ-প্রতিরোধ শক্তি বৃদ্ধি। যেসব ব্যক্তির স্বাভাবিক রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, তাঁদের সেপসিসে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বেশি। যেমন, ডায়াবেটিক রোগী, এইচআইভি পজ়িটিভ ব্যক্তি, ক্যানসারে আক্রান্ত রোগী, কিডনির রোগী, এই মুহূর্তে কোভিড-আক্রান্ত হয়েছিলেন যাঁরা, অতিরিক্ত মদ্যপান করেন এমন ব্যক্তির সেপসিস হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা ভাল হলেও যদি কোনও শক্তিশালী ইনফেক্টিভ অর্গানিজ়ম শরীরে প্রবেশ করে, তখন রোগের তীব্রতা বাড়বে। সবচেয়ে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে শিশুরা।
পাঁচ বছরের কম বয়সি ১০ জন শিশুর মধ্যে ৪ জনের সেপসিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
সেপসিসের লক্ষণ
প্রাপ্তবয়স্কদের
যে অঙ্গে সংক্রমণ হচ্ছে, সেই অঙ্গজনিত উপসর্গই প্রথমে চোখে পড়ে। যেমন, নিউমোনিয়া হলে কাশি-সর্দি, জ্বরের মতো লক্ষণ দেখা যাবে। পাকস্থলীতে হলে হজমের সমস্যা, বমি, পেটে ব্যথা হতে পারে।
এছাড়া অস্পষ্ট কথা।
চরম কাঁপুনি বা পেশিতে ব্যথা।
সারাদিনে কোনও প্রস্রাব না হওয়া।
মারাত্মক শ্বাসকষ্ট।
দ্রুত হৃদ্স্পন্দন এবং শরীরের তাপমাত্রা অনেক বা কম হওয়া।
ত্বকের রং একেক জায়গায় একেক রকম বা ছোপ পড়ে।
রক্তচাপ অস্বাভাবিক পরিমাণে কমে যাওয়া।
খিঁচুনি হয় রোগীর।
রক্তে শ্বেতকণিকার পরিমাণ বেড়ে যায় সেই সঙ্গে রক্তে শর্করার পরিমাণ বেড়ে বা কমে যায়।
অ্যালবুমিনের পরিমাণ কমে যায়। এগুলো পরীক্ষা করলে ধরা পড়ে।

আরও পড়ুন-এবার আমরা তৈরি, হুঁশিয়ারি মিরাজের, চেন্নাইয়ে ভারত-বাংলাদেশ

নিওনেটাল সেপসিস
শরীরের অস্বাভাবিক তাপমাত্রা খুব বেশি বা কম।
সেপটিকে নবজাতকের ত্বক ও চোখ হলুদ হতে পারে।
অস্বাভাবিক ঘুম, অস্থিরতা, বিরক্তি।
শিশুর শরীর স্পর্শ করলে অস্বাভাবিক ঠাণ্ডা অনুভূত হয়।
খুব দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস, গর্জন বা অ্যাপনিয়া।
হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়ে, খিঁচুনি। হৃদরোগ হতে পারে হঠাৎ।
বমি, পেট ফুলে যাওয়া।
রক্তের বিভিন্ন উপাদান পরীক্ষা করে চিকিৎসকেরা নিশ্চিত হন যে, রোগটা সেপসিস কি না। তবে সেই রিপোর্ট আসার আগেই কোনও রকম অস্বাভাবিকতা দেখা গেলে রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করানো প্রয়োজন। সেপসিসের চিকিৎসা বাড়িতে কখনওই সম্ভব নয়।
চিকিৎসা
ইন্ট্রাভেনাস ফ্লুইড বা আইভি খুব জরুরি যাতে শরীরে ইলেকট্রোলাইট ব্যালেন্স ঠিক থাকে এবং হাইড্রেশন ঠিক থাকে।
দেখতে হবে রক্তে ঠিকঠাক অক্সিজেন সরবরাহ হচ্ছে কি না?
সেপসিস রোগীকে স্টেরয়েড দেওয়া হবে কি না, তা নির্ভর করছে রোগীর সার্বিক পরিস্থিতির উপরে।
রক্তে আসার আগে থেকেই প্রথম যে অঙ্গ থেকে সংক্রমণ ছড়ায়, সেই অঙ্গের জন্য অ্যান্টিবায়োটিক চালু করে দেওয়া হয়।
অ্যান্টিবায়োটিক দীর্ঘদিন ধরে চললে সঙ্গে অ্যান্টিফাঙ্গাল ওষুধ দেওয়া হয়।
সিভিয়র হলে ভেন্টিলেশনে দেওয়া জরুরি।
ছোট শিশুর ক্ষেত্রে নিজে খেতে পারবে না তাই বিশেষ উপায়ে ফিডিং-এর ব্যবস্থা করতে হবে।
বয়স্ক রোগীর বেডসোর হওয়ার আশঙ্কা বাড়ে। তাই বিশেষ ধরনের রিপল ম্যাট্রেসে রোগীকে শোয়ানো হয়।
নড়াচড়া কম থাকায় ডিপ ভেন থ্রম্বোসিস প্রতিরোধের জন্য বিশেষ ধরনের স্টকিংস পরানো হয় রোগীকে।
প্রয়োজন-বিশেষে রোগীকে রক্ত পাতলা করার ওষুধ দেওয়া হয়। নজরদারি খুব জরুরি।

Latest article