সৌভাগ্যের রাত, শবে বরাত

অপার মহিমা বিজড়িত মধ্য শা’বান-এর মধ্যরাত; রাতভর জেগে চলে নিবিড় ইবাদত; মনের সমস্ত অন্ধকার ঘুচে যায় মহান আল্লাহর করুণায়; সকলের উপর বর্ষিত হয় শবে বরাতের ফজিলত। কিছুদিন আগেই পেরিয়ে এসেছি পবিত্র সেই দিন। আলোকপাত করেছেন তুহিন সাজ্জাদ সেখ

Must read

পবিত্র শবে বরাত
শবে বরাতের রাত মুক্তির রাত; আরবি মাস শা’বানের ১৫ তারিখ মাঝরাত— শব-ই-বরাতের রাত; এই রাত ক্ষমার রাত; পাপমোচনের রাত! নিজের সমস্ত ভুলত্রুটি পূর্ণ শ্রদ্ধার সঙ্গে আল্লাহ্ তা’আলার কাছে সমর্পণ করে, আগামী দিনে কোনও প্রকার কুকর্ম থেকে নিজেকে দূরে রাখার প্রতিশ্রুতি অর্থাৎ তওবা করে মহান আল্লাহর কাছে মাফ চেয়ে নেওয়ায় এই রাতের বিশেষত্ব। মুসলমানদের কাছে এই রাত বিশেষ গৌরবের এবং গুরুত্বপূর্ণ। এই রাত সাধারণ মানুষের কাছে যেন আল্লাহর আশীর্বাদ, মেহেরবানি, ক্ষমা ও করুণার বাহক। এই রাতে মানুষ তাঁর নিবিড় ইবাদতের মধ্য দিয়ে নিজ এবং নিজ মৃত আত্মীয়ের ধর্মীয় মুক্তির পথ খুঁজে পান। মনে করা হয়, এই রাতে আল্লাহ তা’আলা পৃথিবীর আকাশে নেমে আসেন এবং আল্লাহর একটি বিশেষ দিব্য-প্রকাশ হয়ে থাকে। অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ এই রাতে আল্লাহ তা’আলা এই জগতের মানুষদের যা কিছু খারাপ সেসব কিছু থেকে অব্যাহতি দিয়ে সকলকে পবিত্রতার দিকে উৎসাহিত করেন।

আরও পড়ুন-অবৈধ অভিবাসীদের ফেরত পাঠানোর নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ সম্ভব নয়

ইবাদতই শ্রেষ্ঠ আমল
ইসলাম সম্প্রীতি ও শান্তির ধর্ম। ইসলাম মানুষকে নিজের, আত্মীয়স্বজনের, সমাজের এবং নিজ মাতৃভূমি তথা এই পৃথিবীর সকলের মঙ্গলের জন্য সক্রিয় ভূমিকা পালনে এবং ত্যাগ স্বীকারে প্রেরণা জোগায়। ইসলাম আল্লাহ্ তা’আলার মনোনীত একমাত্র দ্বীন— একমাত্র পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা। তাওহিদ অর্থাৎ একত্ববাদের উপর প্রতিষ্ঠিত ইসলাম। বলা বাহুল্য মানব চরিত্রের উন্নতি সাধন, ন্যায়নীতি ও সুবিচারের উপর ভর করে শান্তি-শৃঙ্খলাপূর্ণ গতিশীল ও সুন্দর সমাজ গঠনে এবং সেই সমাজের খিদমত করতেও ইসলামের বিকল্প নেই। ইসলাম অর্থাৎ এক এবং অদ্বিতীয় আল্লাহর প্রতি জগতের মানুষের অনিঃশেষ আনুগত্য, শ্রদ্ধা, ভক্তি ও বাধ্যতা বোঝায়। তাঁর প্রতি পূর্ণ আস্থায় বিশ্ববাসীর জীবনে নেমে আসে শান্তি এবং দূরীভূত হয় অশান্তি, হিংসা, বিদ্বেষ, রাহাজানি প্রভৃতি।
নাজাসাত অর্থাৎ অপবিত্রতা ত্যাগ করে, তাহারাত অর্থাৎ পবিত্রতাকে জীবনে চলার সঙ্গী করে, নিবিড় মনোযোগের সঙ্গে ইবাদতই আল্লাহ তা’আলার প্রিয় হয়ে ওঠার সবচেয়ে বড় উপায়। সেইরকমই পবিত্র ইবাদত শবে বরাত। যদিও পবিত্র কোরআন শরিফে শবে বরাত সম্পর্কে কোনও কথা বলা নেই, তবুও এই রাত মুসলমানদের মধ্যে যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। সকলেই ১৫ই শা’বান রোজা রাখেন, অনেকেই আবার ১৪-১৫ দু’দিনই রোজা রাখেন। কেউ কেউ মৃত আত্মীয় পরিজনের কবরস্থানে গিয়ে জিয়ারাত করেন। ওই দিন সন্ধ্যায় সূর্য ডোবার পর থেকে ফজরের আজান হওয়া অবধি চলে কোরান শরিফ তেলাওয়াত, তাসবিহ্ পাঠ, দোয়া-দরুদ, ও নফল নামাজ আদায়। প্রত্যেকেই মহান আল্লাহর কাছে তাঁদের মাগফিরাতের দোয়া প্রার্থনা করেন অর্থাৎ ক্ষমা ভিক্ষা চান। আল্লাহ তা’আলাও তাঁর উম্মাহর ইবাদতে সন্তুষ্ট হয়ে এই জগতের প্রতি তৌফিক দান করেন। (আল্লাহুম্মা আমিন)
পরিচিতি
দক্ষিণ এশিয়া, মধ্য এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, ও মধ্য-পূর্বের বহু মুসলিম দেশসহ গোটা বিশ্বের আরও অনেক দেশেই অত্যন্ত আবেগের সঙ্গে শবে বরাত উদযাপন করা হয়। নানা জায়গায় নানা নামে পরিচিত— কোথাও শব-ই-বারাত, তো কোথাও চেরাগ-ই-বারাত, কোথাও আবার লাইলাতুল বারাআত, তো কোথাও বারাত
কান্দিলি, তবে রাসূল (সা.) এই রাতটিকে লাইলাতুন্ নিসফ্ মিন্ বলে চিহ্নিত করেছেন। শব একটি ফার্সি শব্দ, যার অর্থ রাত; বারাত অর্থাৎ মুক্তি; শবে বরাত মানেই মুক্তির রাত!
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ১৫ই শা’বানের মধ্যরাতে মহান আল্লাহ্ তা’আলা বিশেষ এক দয়া ও রহমতের প্রকাশ ঘটান এবং সকল মুসলমানকে ক্ষমা করেন, তবে কিছু ব্যক্তি ব্যতিক্রম— যেমন মুশরিক, যে আল্লাহর সঙ্গে শরিক করে, বিদ্বেষ পোষণকারী, আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্নকারী, ব্যভিচারী, কৃপণ, পিতা-মাতার অবাধ্য ব্যক্তি এবং যিনি মদ্যপান করেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরও বলেছেন, এই রাতে আল্লাহ্ তা’আলা তাঁর বান্দাদের জন্য রহমতের ৩০০টি দরজা খুলে দেন এবং জাহান্নাম থেকে যত মানুষকে মুক্তি দেন, তাদের সংখ্যা বনী কালব গোত্রের ভেড়ার পশমের সংখ্যার মতো বিশাল।

আরও পড়ুন-যোগীরাজ্যে সরযূর জলে ফেলা হল অযোধ্যার পুরোহিতের মৃতদেহ!

এক বিরল ইবাদতের সুযোগ
এই রাত এমন একটি সুযোগ, যা সকলেরই গ্রহণ করা উচিত। আমরা জানি না, এই বছর আমাদের নাম মৃত্যুর ফেরেশতার তালিকায় থাকবে কি না, এবং আমরা আবার এই পবিত্র রাতটি উপলব্ধি করার সুযোগ পাব কি না। তাই আমাদের উচিত তওবা (অনুশোচনা) করা এবং আল্লাহ তা’আলার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা। আমরা অত্যন্ত পাপাচারী, কিন্তু আল্লাহ তা’আলার দয়া ও রহমত অপরিসীম। যত বড় পাপীই হই না কেন, তাওবার দরজা আমাদের জন্য সর্বদা খোলা। কখনও দেরি হয় না যেন, নিজের গুনাহের জন্য অনুশোচনা করে সিজদায় লুটিয়ে পড়ার এবং লজ্জায় কাঁদার, কারণ আমরা অহংকার ও অবাধ্যতার মাধ্যমে তাঁর আদেশ লঙ্ঘন করে চলেছি। আলসেমি, গাফিলতির জন্যই আমরা আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করতে ভূলে যাই; কিন্তু আল্লাহ্ সবসময় আমাদের প্রতি করুণাময়।
এই রাতে যখন আল্লাহ তা’আলা ডাক দেন, কে আছেন যে আমার কাছে ক্ষমা চাইবেই, যাতে আমি তাঁকে ক্ষমা করে দিই? তখন চলুন, আমরা আল্লাহ্ তা’আলার দরবারে কাঁদতে কাঁদতে এইভাবে জবাব দিই: হে আল্লাহ! এই অভাগা পাপী আপনার ক্ষমা প্রার্থনা করছে। আমি আপনার দরবারে হাজির হয়েছি এবং লজ্জায় বিনীতভাবে নিজেকে আপনার সামনে নত করছি। আপনার প্রিয় রাসূল, মুহাম্মাদ মুস্তাফা (সঃ)-এর ওসিলায় ও সদকার বরকতে আমাকে ক্ষমা করুন। মনে রাখবেন, আমাদের পথের একমাত্র বাধা হল আমাদের নফ্স ও শয়তান। আল্লাহ্ তা’আলা তাঁদের ভালবাসেন, যাঁরা লজ্জায় তাঁর দরবারে কাঁদে এবং তওবা করে। তাই এই বরকতময় রাতকে ব্যর্থ হতে দেবেন না—আল্লাহর রহমতের দ্বার আমাদের জন্য সবসময় খোলা!
বিশেষ ফজিলত
পবিত্র মেশকাত শরিফে একথা বলা আছে যে, নবি করিম (সঃ) একদিন হজরত আয়েশা (রাঃ)-কে এই রাতের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছিলেন। উত্তরে আয়েশা (রাঃ) বলেছিলেন, এই রাতের বিশেষত্ব নিশ্চয়ই আল্লাহ্ ও তাঁর প্রিয় রাসূল(সঃ) জানেন। তখন রাসূল(সঃ) জানিয়েছিলেন, এই রাতে আগামী বছর শবে বরাত পর্যন্ত কারা মারা যাবেন এবং কারা জন্ম নেবেন তাঁদের নাম লেখা হয়। বছরভর সকলের সকল কাজের মূল্যায়ন করে তাঁদের যথাযথ রিজিক, অর্থাৎ জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, সম্পদ, খাদ্য ও জীবিকা নির্ধারণ করা হয়।
শা’বানের চাঁদ
ইসলামের ইতিহাসে মহান আল্লাহ তা’আলা এই পৃথিবীর মানুষদের জন্য ইবাদতকে সবচেয়ে সুন্দর আমল হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এই ইবাদতের মধ্য দিয়েই আমরা আল্লাহর অফুরন্ত নেয়ামত লাভ করব এবং আখেরাতের পরম সৌভাগ্য ও সুখময় জান্নাতের অধিকারী হব। এখন প্রতিদিনের চলার পথে আমরা গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার ব্যবহার করে থাকি, যা সূর্য ওঠা এবং অস্ত যাওয়ার উপর নির্ভরশীল। কিন্তু ইসলামিক ক্যালেন্ডার চাঁদের উপর নির্ভর করে; তাই আরবি মতে একবছর সময়কাল প্রচলিত ৩৬৫/৩৬৬ দিনের চেয়ে প্রায় ১১ দিন মতো কম হয়। তবে মহান আল্লাহ্ বারো মাসের বারো চাঁদের জন্য ইবাদত ও তার ফজিলত উম্মাহর জন্য নির্দিষ্ট করে রেখেছেন। হিজরি সনের প্রথম মাস মহররম, তারপর ছফর, রবিউল আওয়াল, রবিউচ্ছানি, জমাদিউল উলা, জমাদিউচ্ছানি এবং এর পরের মাস রজব। সপ্তম মাস রজব এবং নবম মাস রমজানের মধ্যে শা’বান মাস। এই মাস বরকত ও কল্যাণের মাস। অন্য মাসের তুলনায় এই মাসের মর্যাদা যথেষ্ট বেশি। মনে করা হয় মানবজাতির ভাগ্য নাকি এই মাসেই বণ্টিত হয়! যে পাঁচটি বিশেষ রাতের দোয়া আল্লাহর দরবারে কবুল হয় তাদের মধ্যে একটি হল এই শা’বান মাসের ১৫ তারিখ শবে বরাতের রাত।
অনেকেই মনে করেন, শবে বরাত হল রমজানের রোজার প্রস্তুতি। এই সময় সমস্ত মানুষ তাঁদের দৈনন্দিন যাপন থেকে শুরু করে নিজেদের দৈহিক ও আত্মিক শুদ্ধিকরণ করে নিজেকে রোজার জন্য প্রস্তুত করে। কেননা শা’বানের পর পবিত্র রমজানুল মুবারকের শুভ মুহূর্তে আল্লাহ তা’আলা তাঁর অমৃতবাণী আল-কোরআন এই দুনিয়ায় পাঠিয়েছিলেন। বিশ্ববাসীর সকল পঙ্কিলতা ধুয়ে মুছে সাফ করার জন্যই রমজান আসে। এই মাসেই পালিত হয় আর-একটি গুরুত্বপূর্ণ রাত— শবে কদরের রাত। দশম মাস শাওয়াল, এই মাসের প্রথমদিন অনুষ্ঠিত হয় ইদ-উল-ফিতর। এরপর জিলক্বদ মাস এবং বছরের শেষ, মুসলিম জাতির মহামিলনের মাস, হজ্জের মাস জিলহজ্জ্ব। এই মাসের ১০ তারিখ আল্লাহর উদ্দেশ্যে কুরবানি উৎসর্গ করা হয়, পালিত হয় ইদ-উল-আযহা।

আরও পড়ুন-হাসিবুলকে দেখতে হাসপাতালে অভিষেক

আড়ম্বরহীন ইবাদত
সরাসরিভাবে পবিত্র কোরআন শরিফে শবে বরাতের কথা উল্লেখ না থাকায় সালাফি, ওয়াহাবি ও বেশকিছু সম্প্রদায়ের মুসলমানরা এই পর্বটি পালন করেন না। মূলত এটি সুন্নি মুসলমানদের কাছে অত্যন্ত আবেগের; তবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কিছু দেশে সিয়া মুসলমানরা ওইদিন তাঁদের ‘১২ জন ইমামে’র মধ্যে শেষ ইমাম মুহাম্মদ আল-মেহদির জন্মদিন হিসেবে পালন করেন। তবে একথা সত্য, সর্বত্রই এই রাত ক্ষমার রাত হিসেবেই পরিচিত। আমাদের দেশ ভারতবর্ষেও সেই মুঘল আমল থেকেই চলে আসছে শবে বরাত উদযাপনের ঘটা। এইদিন মানুষেরা মনের অন্ধকার দূর করার সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতিকেও নানা আলোর রঙে সাজিয়ে তোলেন। নানারকম হালুয়া, মিষ্টি, আতপ চালের রুটি ও মাংস রান্না করে তা অন্যদের মাঝে বিলিয়ে দেয়। তবে অনেকক্ষেত্রেই এইপ্রকার ধর্ম পালনের নামে আড়ম্বর বেশি হয়ে যায়। ফলে পরিবেশ দূষণের সঙ্গে সঙ্গে ইবাদতে বিঘ্ন ঘটায়। বিদ্বজ্জনের অনেকের মত, ইবাদত সবসময় আড়ম্বরহীন হওয়া খুবই জরুরি।
সাংস্কৃতিক বৈচিত্র
বৈচিত্রময় উপমহাদেশ ভারতবর্ষ। শবে বরাতের মতোই হিন্দু ধর্মের মানুষেরা মহালয়ার দিন পিতৃপক্ষ ও তর্পণ উদযাপন করেন, তারপর আসে নবরাত্রি। ঠিক তেমনি দীপাবলির আগে ভূত চতুর্দশী পালিত হয়। খ্রিস্টান মানুষেরা প্রতিবছর ২ নভেম্বর মেনে চলেন আত্মা দিবস, দ্য সোলস্ ডে। আমেরিকার হ্যালোইন ডে, সপ্তাহব্যাপী মেক্সিকান ডে অব দ্যা ডেড এবং চিনের হাংরি ঘোস্ট মাসের কথা শবে বরাতের মাহাত্ম্যই ইঙ্গিত করে। আস্তাগফিরুল্লাহা রাব্বি মিন কুল্লি জম্বিন্ ওয়া আতুবু ইলাইহি অর্থাৎ আমি আল্লাহর কাছে সকল পাপের জন্য ক্ষমা চাই এবং তাঁর দিকে প্রত্যাবর্তন করি। এই রাত আত্মার পরিত্রাণের রাত, পরিশুদ্ধির রাত, আলোর পথে জীবনের মুক্তির রাত। আল্লাহ তা’আলা বছর বছর আমাদের এ-প্রসঙ্গে অনেক বেশি বেশি করে আমল করার তৌফিক দান করুন। আমিন।­

Latest article