রাজ্যের রাজস্বেও কেন্দ্রীয় বঞ্চনার ছায়া

বঞ্চনার যন্ত্রণা নিয়েও রাজ্যবাসীর জীবন সুন্দর করার পথ থেকে সরে আসেনি মা-মাটি-মানুষের সরকার। দেশের সব ক’টি রাজ্যের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে সামাজিক ক্ষেত্রে ব্যয়-বরাদ্দ সর্বাধিক, অথচ কেন্দ্রের নেতিবাচক মনোভাব প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াচ্ছে রাজ্যের উন্নয়নের পথে। হাওয়ায় ভাসিয়ে দেওয়া কথা নয়, রীতিমতো তথ্য ও পরিসংখ্যান দিয়ে ব্যাখ্যায় আজ প্রথম পর্ব। লিখছেন প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির প্রাক্তন অধ্যাপক ড. দেবনারায়ণ সরকার

Must read

মহিলাদের লক্ষ্মীর ভাণ্ডার-সহ রাজ্যের অন্যান্য সামাজিক প্রকল্পগুলোতে অতিরিক্ত তহবিল বরাদ্দের মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গের অর্থ প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য ১২ ফেব্রুয়ারি বুধবার নির্বাচন-পূর্ব ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য ৩.৮৯ লক্ষ কোটি টাকার বাজেট পেশ করলেন। বিরোধীদের অভিযোগ, রাজ্যের সামাজিক প্রকল্পগুলোতে বিপুল অর্থবরাদ্দ করতে গিয়ে রাজ্যের বাজেট আয়ের তুলনায় মোট ব্যয় ক্রমশ বাড়ছে এবং রাজ্যে ঋণের স্ফীতিও ক্রমশ বাড়ছে। এর ফলে রাজ্যের আর্থিক স্বাস্থ্য ক্রমশ দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে চলেছে। বিরোধীদের বাজেট সমালোচনার জবাবি ভাষণে ২০ ফ্রেব্রুয়ারি বিধানসভা কক্ষে চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য জানালেন যে, রাজ্যের আর্থিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে বিরোধীদের অভিযোগ অনেকাংশে সত্য নয়। কেন্দ্রের আর্থিক বঞ্চনার যন্ত্রণাকে পাল্টা হাতিয়ার করলেন তিনি। তাঁর মন্তব্য, বঞ্চনার যন্ত্রণা নিয়েই মানুষের জীবনের পথ সুগম করার চেষ্টা রয়েছে বাজেটে। এটা ঘটনা যে, বিজেপি, কংগ্রেস ও আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলি যে সব রাজ্যে ক্ষমতায় রয়েছে তাদের অনেকেই লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের মতো একই রকম খয়রাতি প্রকল্প চালু করেছে যার ফলে এসব রাজ্যগুলিতেও দেনার বহর বাড়ছে। এমনকী কেন্দ্রীয় সরকার নিজেও এই একই দোষে দুষ্ট।
এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, রাজ্য ও কেন্দ্র এই খয়রাতি প্রকল্পগুলি বন্ধ করে সেই অর্থ পরিকাঠামো উন্নয়নে খরচ করলে কেন্দ্র ও রাজ্যের আর্থিক স্বাস্থ্যের আরও উন্নতি ঘটত। কিন্তু ভারতের মতো কল্যাণকামী উন্নয়নশীল দেশে এই খয়রাতির প্রকল্পগুলো রাজনৈতিক দলগুলির কেন্দ্র ও রাজ্যের গদিতে টিকে থাকার সহায়ক হলেও বর্তমান সময়ে এই প্রকল্পগুলোর প্রয়োজনীয়তা একেবারে অস্বীকার করার উপায় নেই।
রিজার্ভ ব্যাঙ্কের স্টেট ফাইনাস আ স্টাডি অব বাজেট, ২০২৪-’২৫-এর তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ২০২৪-’২৫ অর্থ বছরের বাজেটে সামাজিক ক্ষেত্রে ব্যয়-বরাদ্দ এই বছর রাজ্যের মোট ব্যয়-বরাদ্দের ৫২২ শতাংশ। সারা ভারতে এই অনুপাত সর্বোচ্চ। দ্বিতীয় ছত্তিশগড় (৫০.৫ শতাংশ)। সামাজিক প্রকল্পগুলির ক্ষেত্রে এই বিপুল ব্যয় করতে গিয়ে ২০২৫-’২৬ সালের বাজেট-সহ সাম্প্রতিক কালের বেশ কয়েকটি অর্থ বছরের বাজেটে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের রাজস্ব শৃঙ্খলার কাঠামো ও আর্থিক স্বাস্থ্যের অবস্থা কোন অবস্থায় দাঁড়িয়ে রয়েছে তা পর্যালোচনা করা যাক।
মূলধনী ব্যয়
১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫-এর প্রকাশিত পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মধ্য মেয়াদি আর্থিক নীতির দলিল থেকে দেখা যাচ্ছে রাজ্যের মূলধনী ব্যয় রাজ্যে জিএসডিপির অনুপাতে অথবা রাজ্যের রাজকোষ ঘাটতির (Fiscal Defiot) অনুপাতে ক্রমশ বাড়ছে। ২০২১-২২, ২০২২-২৩,২০২৩-২৪, ২০২৪-২৫ (সংশোধিত) ও ২০২৫-২৬ (বাজেট এস্টিমেট) অর্থবছরে রাজ্যের মূলধনী ব্যয় যথাক্রমে ১৮৫৮৬ কোটি টাকা, ২২৭৫৩ কোটি টাকা, ২৯৭৫৭ কোটি টাকা এবং ২৯৯৪৯ কোটি টাকা এবং ৪০০৮৬ কোটি টাকা। রাজ্যের জি এস ডিপি র অনুপাতে এই ব্যয় যথাক্রমে ১৩৮, ১৫০,১৮০,১৬৫ ৬১৯৭। রাজকোষ ঘাটতির অনুপাতে এই ব্যয় যথাক্রমে ৩৬.৭৮, ৪৫.৫৪, ৫৫.১১, ৪১.০২, ও ৫৪.৭৮। বিশেষ করে ২০২৪-২৫ (সংশোধিত) অর্থবছর রাজ্যের মূলধনি ব্যয়ে উভয়ের অনুপাত বৃদ্ধির জন্য চ্যালেঞ্জ থাকছেই। রিজার্ভ ব্যাংকের স্টেট ফিনান্সের তথ্যেও এর সত্যতা মিলেছে। এই তথ্যে দেখা যাচ্ছে ২০২১-২২,২০২২-২৩, ২০২৩-২৪ (সংশোধিত) ও ২০২৪-২৫ (বাজেট এস্টিমেট) জিএসডিপি-র অনুপাতে রাজ্যের মূলধনী ব্যয় যথাক্রমে ১.৩, ১.৪, ১.৮ ও ১.৯। বামফ্রন্টের শেষ অর্থবছরে এই অনুপাত ছিল ০.৫। ভারতের ১৭টে সাধারণ রাজ্যগুলির তুলনায় দেখা যাচ্ছে ২০২২-২৩ অর্থবছর থেকে শুরু কের পরবর্তী বছরগুলিতে অন্ধপ্রদেশে, কেরল, হরিয়ানা ও পাঞ্জাবে এই অনুপাত পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় কম। সব চেয়ে শিল্পোন্নত রাজ্য মহারাষ্ট্রে এই অনুপাত যথাক্রমে ১.৫, ১.৭, ২.১ ও ২.০। এমনকী তামিলনাডুর মতো শিল্পোন্নত রাজ্যে ২০২৩-২৪ (সংশোধিত) ও ২০২৪-২৫ (বাজেট এস্টিমেট) অর্থবছরে এই অনুপাত পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় কম। কার্যত, রাজ্যের সামাজিক প্রকল্পগুলোতে ব্যয় বৃদ্ধির ফলে শিল্পোন্নত রাজ্যেও এই অনুপাত যথেষ্ট কমেছে। যাই হোক পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান সরকার সামাজিক প্রকল্পের বিপুল ব্যয় বহন করা সত্ত্বেও জি এস ডিপির অনুপাতে অথবা রাজকোষ ঘাটতির অনুপাতে রাজ্যের মূলবনী ব্যয় ক্রমশ উর্ধ্বগামী। তবে সামাজিক প্রকল্পের ব্যয় কমাতে পারলে নিঃসন্দেহে এই অনুপাত আরও বাড়ত।
রাজ্য সরকারের তথ্য থেকে আরও দেখা যাচ্ছে, পূর্বোক্ত অর্থ বছরগুলোতে জিএস ডিপির অনুপাতে রাজ্যের ঋণ যথাক্রমে ৩৯.২২, ৩৭.৮৯, ৩৮.৩৯, ৩৮.৯৩ ও ৩৭.৯৮। রিজার্ভ ব্যাংকের তথ্যে এই অনুপাত যথাক্রমে ৪২.২, ৩৯.১,৩৮.৩ ও ৩৮.০। ২০২১-২২ অর্থবছরের তুলনায় উভয় তথ্যে এই অনুপাত কমেছে। সাধারণ রাজ্যগুলির মধ্যে তুলনায় দেখা যাচ্ছে একমাত্র পাঞ্জাবে উপরোক্ত বছরগুলোতে এই অনুপাত ৪৫-এর বেশি। একই সময়কালে কেরল, বিহার, রাজস্থান ও মধ্যপ্রদেশ রাজ্যে এই অনুপাত পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় মাত্র ১ থেকে ২ শতাংশ কম। তবে ২০২৫ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত মোট ঋণ পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় বেশি আরও চারটি রাজ্যে— তামিলনাড়ু, উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র ও কর্নাটকে। মোট ঋণ পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় এই রাজ্যগুলোতে বেশি হলেও জিএসডিপির অনুপাতে ঋণ পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় যথেষ্ট কম। তবে উত্তরপ্রদেশে এই অনুপাত প্রায় ৩২ (৩১.৮)।

আরও পড়ুন-অক্ষয়তৃতীয়ার পুণ্যলগ্নে সঙ্গীত মুখরিত সৈকত শহর

নিঃসন্দেহে পশ্চিমবঙ্গের আর্থিক সুস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান প্রতিবন্ধকতা হল, রাজ্যে ঋণের স্ফিতি ক্রমশ বাড়ছে। রাজ্য বাজেটের তথ্যে স্পষ্ট প্রতিবছর ঋণের সুদাসল মেটাতে গিয়ে রাজস্ব আয়ের ৩৫ শতাংশের বেশি অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। বামফ্রন্টের ১,৯২,৯২০ কোটি টাকা ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে ২০২৬ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত রাজ্যের মোট ঋণ ৭,৭১,৬৭০ কোটি টাকা। ১৬ বছরে এই ঋণের সুদাসল মেটাতে ব্যয় ৭,৫৩,৭৬০ কোটি টাকা এবং সুদ বাবদ বায় ৪,৬১,৩৬৭ কোটি টাকা সুদাসল বাবদ ব্যয় মোট ঋণের ৯৭.৬৮% এবং সুদ বাবদ ব্যয় ৫৯.৭৯%। রাজ্যের ক্রমবর্ধমান এই ঋণের বোঝা লাঘবের জন্য কেন্দ্রের কাছে নিরবচ্ছিন্ন অনুরোধ সত্ত্বেও অদ্যবধি তার কোনও সুরাহা হয়নি।
(এরপর আগামী কাল)

Latest article