১০০ দিনের কাজের প্রকল্প (মনরেগা)। গরিব গ্রামবাসীর কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধির জন্য একটি যুগান্তকারী প্রকল্প।
এই প্রকল্পে সংশ্লিষ্ট এলাকার শ্রমিকরা দাবি করামাত্রই সরকার বছরে কমপক্ষে ১০০ দিনের কাজ দিতে বাধ্য। অর্থাৎ এই প্রকল্পে গ্রাম ভারতের গরিব মানুষের হাতে কিছু টাকা যায়। তার মাধ্যমে তাদের সংসারে কিছু সুরাহা হয় এবং পরোক্ষে চাঙ্গা হয় গ্রামীণ বাজার। কিন্তু চোর-ছ্যাঁচড়দের থেকে সরকারি প্রকল্প রক্ষা করা সবসময়ই কঠিন। মনরেগাও এই ব্যাধিমুক্ত নয়। অসাধু রাজনীতির কারবারিরা ভুয়ো জব কার্ড দিয়ে এই প্রকল্পের কিছু টাকা হাতিয়ে নেয়। এই অনাচার কমবেশি সারা দেশেই চলে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। যেমন গত অর্থবর্ষে (২০২৪-২৫) অনেকগুলি রাজ্যে ভুয়ো জব কার্ড চিহ্নিত হয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিহার (৮,১১১), ওড়িশা (৭,৫৬৬), অসম (৭,৩৪১), ছত্তিশগড় (৬,৮৮৮), উত্তরপ্রদেশ (৩,৪২১), মহারাষ্ট্র (১,৪০১), গুজরাত (৯৮৮), মধ্যপ্রদেশ (৮০৪), ত্রিপুরা (২৮৩), পশ্চিমবঙ্গ (২)। সংসদে মোদি সরকারের দেওয়া পরিসংখ্যান বলছে, গোটা দেশে গত অর্থবর্ষে ৫৮,৮২৬টি ‘ফেক জব কার্ড’ বাতিল হয়েছে। তার মধ্যে ডাবল ইঞ্জিন রাজ্যেই ৪২,৭৩৮টি। তার পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গের ছবিটা রীতিমতো ইতিবাচক। এখানে মাত্র ২টি ভুয়ো জব কার্ড পাওয়া গিয়েছে।
অথচ ‘গেরুয়া’ রাজ্যগুলির বিষয়ে দিল্লিওয়ালাদের কোনও হেলদোল নেই। যত লম্ফঝম্প কেবল পশ্চিমবঙ্গকে নিয়ে। কারণ, মোদির মাথাব্যথা তো একজনই। জননেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
টানা সাড়ে তিনবছরেরও বেশি সময় যাবৎ বাংলার লক্ষ লক্ষ গরিব মানুষের সঙ্গে বঞ্চনা চলছে।
কিন্তু কেন?
কেন্দ্রের অভিযোগ, বেহাত হয়েছে সরকারি অর্থ। রয়েছে জাল জব কার্ড। কিন্তু ফেক জব কার্ডের সংখ্যা কত? লোকসভায় জানতে চেয়েছিলেন তৃণমূলের মালা রায়। কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রকের রাষ্ট্রমন্ত্রী কমলেশ পাসোয়ান তার যে জবাব দিয়েছেন তাতেই স্পষ্ট সবকিছু।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রাজীব গান্ধী ভারতবাসীর চোখ খুলে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, সরকারের দেওয়া প্রতিটি টাকার মাত্র ১৫ পয়সা প্রকৃত বেনিফিসিয়ারির কাছে পৌঁছয়। মাঝপথেই নয়ছয় হয়ে যায় বাকি অর্থ। সেদিন দেশের সামনে নিজের বক্তব্যের সমর্থনে যে দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছিলেন সেটা ছিল ওড়িশার কালাহান্ডি। তখন সেখানেও ছিল কংগ্রেস সরকার। জানকীবল্লভ পট্টনায়ক মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সিতে।
কিন্তু সেই রাজ্যের মানুষের চরম দুর্দশা দেখে তিনি এমন বিমর্ষ ও ক্ষুব্ধ হলেন যে, তা প্রকাশ করে ফেললেন জনসমক্ষে। পরবর্তীকালে দেশের একাধিক আদালত, দুর্নীতি মামলার বিচারে রাজীবের ওই মন্তব্য উদ্ধৃত করে তাঁদের পর্যবেক্ষণ কিংবা রায় দিয়েছে।
আর আজ। কেন্দ্রে বিজেপি সরকার। দুর্নীতিতে এগিয়ে ডবল ইঞ্জিন শাসিত বিহার, ওড়িশা, অসম, ছত্তিশগড় এবং উত্তরপ্রদেশ।
আর মোদি ও তাঁর অনুগামীরা সেই সত্য ঢাকতে ব্যস্ত। তাদের টার্গেট পশ্চিমবঙ্গ, যেখানে মোটে দুটো ফেক জব কার্ড মিলেছে। মোদির মতো কোনও দেশনেতাকে এমন ভূমিকায় আমরা পাইনি। যিনি ‘আমরা-ওরা’ কিংবা ‘সিঙ্গল ইঞ্জিন-ডাবল ইঞ্জিন’ তত্ত্বের ভিত্তিতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলার অভিনয় করছেন।
দুর্নীতি-বিরোধী যুদ্ধের নামে ভারতের এই আজগুবি ন্যাকামি অবশ্য আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি এড়ায়নি। স্বচ্ছতার মাপকাঠিতে ভারতের স্থান এজন্য বরাবরই একেবারে নীচের দিকে । ক্রমান্বয়ে দু-দশ ধাপ উত্তরণ ছিল আমাদের প্রত্যাশা। কিন্তু ভারতবাসীর এমনই মন্দকপাল যে, অধিকাংশ বছর আমাদের অবনমনই ঘটছে দু-চার ধাপ করে।
এছাড়া মোদির আর পরিত্রাণের উপায় কী?
গত কয়েকমাসে দফায় দফায় বিহার গিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। ঘোষণাও করেছেন প্রায় ১৫ হাজার কোটির প্যাকেজ। দিয়েছেন বিস্তর প্রতিশ্রুতি। তাতেও চিঁড়ে ভিজছে এমনটা বলা যাচ্ছে না। অপারেশন সিঁদুরের পর এই প্রথম কোনও রাজ্যের ভোট হবে। এই ঘটনাকে সামনে রেখে দেশাত্মবোধের ধ্বজা তুলেছেন মোদি। কিন্তু সেই ঘটনা কি আদৌ ডিভিডেন্ড দেবে? নিশ্চিন্ত নন তিনি। কারণ বিভিন্ন রাজ্যের সাম্প্রতিক ভোটের ট্রেন্ড বলছে, ইস্যু যতটা না জাতীয়, তার থেকে ঢের বেশি লোকাল, অর্থাৎ স্থানীয়। বিহার বিধানসভার ভোটেও মূল ইস্যু, সেই রাস্তাঘাট, পানীয় জল, মহিলাদের উন্নয়ন। ফলে ‘সিঁদুর’ দিয়ে মহিলাদের মন জয় করা যাবে কি না তাতে সন্দেহ রয়েছে। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা বলছে সাম্প্রতিক একটি সমীক্ষা। সি ভোটারের সেই সমীক্ষাতেও অপারেশন সিঁদুর নিয়ে তেমন আশার আলো দেখতে পাচ্ছে না বিজেপি।
এনডিএ জোটের ঘোষিত মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী নীতীশ কুমার এখন কার্যত অস্তমিত সূর্য। পিংপং বলের মতো বারপাঁচেক এদিক-ওদিক করে নিজের বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট করেছেন। স্লোগান উঠেছে, বিহার কি মাঙ্গ, শুনলিয়া নিশান্ত। বহুত বহুত ধন্যবাদ। কে এই নিশান্ত? তিনি নীতীশ কুমারের পুত্র।
অবস্থা এমন জায়গায় পৌঁছেছে, উল্টো মুখী বাতাস এমন জোরে বইতে শুরু করেছে যে, বিহারবাসীর মন জয়ে মোদি এখন তাঁর ভাষণে টেনে আনছেন ত্রিনিদাদের প্রধানমন্ত্রী কমলা প্রসাদ বিশ্বেশ্বরের প্রসঙ্গ।
বিহার ভোট বলে নয়, এটাই মোদির স্ট্র্যাটেজি। ভোট থাকলে বিদেশ সফরে গিয়ে অনাবাসী ভারতীয়দের সামনে দলের কথা প্রচার করা। বিদেশের মঞ্চকে বহুবার ব্যবহার করেছেন মোদিজি। এবার দেশের মঞ্চকে ব্যবহার করছেন বিদেশের কথা বলার জন্য।
কিন্তু প্রশ্ন এত করেও সাফল্য আসবে কি?