যোগ্য চাকরিহারা শিক্ষকরা চাকরিতে পুনর্বহাল না হওয়া পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের পাশে থাকবেন। নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামে চাকরিহারা শিক্ষকদের সভায় দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যেহেতু দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে ২৫,৭৫২ জন শিক্ষকের চাকরি বাতিল হয়েছে , তাই আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য থেকেই এই সমস্যার সমাধানের পথ খুঁজবে রাজ্য সরকার।
এসএসসির বা মধ্যশিক্ষা পর্ষদ রিভিউ পিটিশনে আইনি সাহায্যের জন্য মনু সিংভি, কপিল সিব্বলের মতো বড় মাপের আইন বিশেষজ্ঞের সাহায্য নেবে এটাই ঠিক হয়েছে।
যারা এই রায়ের ফলে চাকরি হারিয়েছেন, তাদের মানসিক যন্ত্রণা-উৎকণ্ঠা থাকাটা অস্বাভিক নয়। কারণ শিক্ষা-মেধার পরিপূর্ণতা থাকা সত্ত্বেও কম্পিটিটিভ পরীক্ষার প্রতিটা ধাপ অতিক্রম করে চূড়ান্ত লিস্টে স্থান করে নেওয়া কম কথা নয়। এই সফলতা বার বার আসবে জীবনে তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। তাই আবারও পরীক্ষার সম্মুখীন হওয়ার কারণে সুপ্রিম নির্দেশ সঠিক বলে মনে হয় না।
যে মামলায় তদন্তের অজুহাতে প্রাক্তন শিক্ষা মন্ত্রী-সহ একাধিক ব্যক্তি জেলবন্দি। যে মামলার রায় ঘোষণার সময় যোগ্য এবং অযোগ্যের পৃথকীকরণ করে দিয়েছে সর্বোচ্চ আদালত। অযোগ্যদের সুদ-সহ টাকা ফেরতের নির্দেশ আর যোগ্যদের পুনরায় পরীক্ষায় বসার সুযোগ দান, যে সূত্রেই হোক সুপ্রিম কোর্ট এই পৃথকীকরণে সন্তুষ্ট হয়েই রায় দিয়েছে; তাহলে যোগ্যদের চাকরি বাতিল কীসের জন্য! প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। নিরাপরাধ ব্যক্তি যেন শাস্তি না পায়, ভারতের বিচার ব্যবস্থার এই যে স্পিরিট তা কি লঙ্ঘন হল না? এর উত্তর কে দেবে!
অযোগ্যদের বাছতে আরও সময় আরও তদন্ত হতেই পারত, কিন্তু তড়িঘড়ি প্রায় ২০,০০০ হাজারের কাছাকাছি যোগ্য শিক্ষকদের চাকরি বাতিল অবিবেচনাপ্রসূত বলেই মনে হয়।
আরও পড়ুন- মৌলবাদীদের হুমকি উপেক্ষা করে সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নববর্ষ পালনের নির্দেশ
এই পরিস্থিতিতে সিপিএম ও বিজেপি চাকরিহারা শিক্ষকদের প্ররোচিত করে রাজ্যে একটা অস্থিরতা তৈরির ক্ষেত্র প্রস্তুত করে চলেছে। চাকরি বাতিলের সব দায় রাজ্য সরকার তথা মুখ্যমন্ত্রীর ওপর চাপিয়ে রাজনৈতিক ফয়দা তোলার চেষ্টা করছে। মুখ্যমন্ত্রীর আশ্বাস সত্যেও কিছু চাকরিহারা শিক্ষকের ডিআই অফিস অভিযান এবং চরম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি সিপিএম বিজেপির মদতপুষ্ট এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না। এরা সমাধান চায় না। এরা চাকরিতে পুনর্বহাল হোক যোগ্যরা এটা চায় না। চায় রাজনৈতিক ডিভিডেন্ট।
বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য আইনজীবী হিসেবে এবং অভিজিৎ গাঙ্গুলি বিচারক হিসেবে সমগ্র প্যানেল বাতিলের বন্দোবস্ত করেছে হাইকোর্টে। এসএসসি সুপ্রিম কোর্ট-এ ৫৩০৩ জন অযোগ্যের তালিকা জমা দেওয়ার পর ও সমস্ত চাকরি বাতিলের হাইকোর্টের রায়কে বহাল রাখল সুপ্রিম কোর্ট। আর বাংলার মুখ্যন্ত্রীর ওপর সমস্ত দায় চাপিয়ে দিল ওরাই, সিপিএম আর বিজেপি।
১৯৯২ সালে তৎকালীন রাজ্য সরকার শিক্ষকদের চাকরির বয়স ৬৫ বছর থেকে কমিয়ে ৬০ বছর করে দেওয়ার পর এক সাথে ৭০ হাজার শিক্ষকের চাকরি চলে যায়। ক্ষুব্ধ শিক্ষকদের আন্দোলনে বেপরোয়া লাঠি চালিয়ে রক্তাক্ত করে হাসপাতালে পাঠিয়েছিল তৎকালীন বাম সরকার। মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন জ্যোতি বসু। ২০২১ সালে বিজেপিশাসিত উত্তর প্রদেশে কোর্টের অর্ডারে চাকরি যায় ৬৯ হাজার হবু শিক্ষকের। আন্দোলনরত সেই শিক্ষকদের ওপর লাঠি চালায় যোগী প্রশাসন। পুলিশের লাঠি চালানো নতুন নয়। শৃঙ্খলারক্ষায় পুলিশের কাজ পুলিশ করে। কিন্তু ওই ঘটনাগুলির তুলনায় আজকের প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। কারণ বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী শিক্ষকদের স্বার্থে নিজেই ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছেন। তিনি কারও চাকরি বাতিল করেননি। বরঞ্চ এই চাকরি বাতিলের ঘোর বিরোধী তিনি। এটা তিনি ইনডোর স্টেডিয়ামে সেদিন স্পষ্ট করে দিয়েছেন। তার পরও যে-সমস্ত শিক্ষক রাস্তায় নেমে শৃঙ্খলা ভাঙছেন, মুখ্যমন্ত্রীকে নোংরা ভাষায় আক্রমণ করছেন তা সমর্থনযোগ্য হতে পারে না কোনওমতেই।
এই চাকরি বাতিলের সুপ্রিম রায়-এ লাভ-ক্ষতি কাদের :
ক্ষতি
(১) চাকরিহারা শিক্ষকদের ক্ষতি : কারণ যোগ্যতার পরীক্ষা দিয়ে যে চাকরি তাঁরা পেয়েছেন, দ্বিতীয় বার পরীক্ষা দিলে সেই দক্ষতা দেখানো আজ আর অনেকের পক্ষেই সম্ভব নয়।
(২) স্কুলগুলির ক্ষতি : শিক্ষক না থাকায় ছাত্রছাত্রীদের পড়াশুনা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। একজন মাত্র সাবজেক্ট টিচার যে স্কুলে সেখানে সেই শিক্ষক চাকরি হারালে ক্লাস বন্ধ হবে।
(৩) শিক্ষা দফতরের ক্ষতি : কারণ শিক্ষা ব্যবস্থাকে চালু রাখা শক্ত হবে।
(৪) সামগ্রিক ক্ষতি এই বাংলার যুব সমাজের : কারণ আইনি জটিলতায় চাকরির পরীক্ষাগুলি বারবার বিঘ্নিত হচ্ছে। বেকার শিক্ষিত যুবক-যুবতীরা সুযোগ হারাচ্ছেন।
এই কারণে মুখ্যমন্ত্রী আপ্রাণ চেষ্টা করবেন চাকরিহারা শিক্ষকরা যেন পুনর্বহাল হন।
লাভ কাদের
(১) বিরোধী দলগুলির লাভ : কারণ এই ইস্যু টিকে সামনে রেখে রাজ্যে বিশৃঙ্খলা তৈরি তারা করতে পারবে। তাই তারা বিভ্রান্ত করছেন চাকরিহারা শিক্ষকদের। তাদের উৎকণ্ঠাকে কাজে লাগিয়ে ডিআই অফিসে তালা মারা, পুলিশকে আক্রমণ করা, মুখ্যমন্ত্রীকে অশালীন ভাষায় আক্রমণ করাকে উৎসাহিত করছে।
(২) আইনি জটিলতায় চাকরিগুলি বাতিল করতে পারলে বিরোধী দলগুলি দেখাতে পারবে বাংলায় চাকরি হয় না।
এই অবস্থায় মুখ্যমন্ত্রীর ওপর ভরসা রেখে স্কুলে পৌঁছনো দরকার চাকরিহারা যোগ্য শিক্ষকদের। অন্য কোনও পক্ষ দ্বারা বিভ্রান্ত হওয়া বোকামির নামান্তর।