সর্বার্থে কোণঠাসা নিরানন্দ বোস, এখন ফের ভেসে ওঠার চেষ্টায়

আবার নোংরা খেলায় নেমে পড়েছেন রাজভবনের বাসিন্দা। সংবিধানের ৩৫৬ অনুচ্ছেদের কথাও উল্লেখ করে রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসনের সুপারিশ করেছেন উনি। ওঁর আসল চরিত্র কী, সেটা অবশ্য জানতে কারও বাকি নেই। সেই নোংরা চেহারাটা ফের বেআব্রু করছেন দেবাশিস পাঠক

Must read

শ্রীযুক্ত ধনখড় সাহেবের পশ্চিমবঙ্গ থেকে গমন ও শ্রীমান আনন্দ সিভি আনন্দ বোস (cv ananda bose) মহোদয়ের সেই স্থলে অভিষিক্ত হওয়ার পর থেকে আজ ইস্তক নাটকীয় উপচারের অভাব ঘটেনি। সেই উপচার সামগ্রীতে সর্বশেষ সংযোজন সংবিধানের ৩৫৬ অনুচ্ছেদের কথাও উল্লেখ করে রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসনের সুপারিশ।

অমন অকারণ অযৌক্তিক সুপারিশের অনিবার্য অভিঘাতে জন রোষাগ্নি তাঁকেও গ্রাস করবে, সম্ভবত এই আশঙ্কার কারণেই কেন্দ্রকে রিপোর্টটি পাঠিয়েই শারীরিক সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি। এই রিপোর্ট পুরোদস্তুর রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

তিনি (cv ananda bose) নিজের রাজনৈতিক অ্যাসাইনমেন্টের কারণে রিপোর্টটি দিয়েছেন। তিনি জানেন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে, সুতরাং ‘অবনতি যদি হয়’, এই কথাগুলি এ ক্ষেত্রে আসে না। রাজ্যপাল এটিও জানেন ওই সীমান্তবর্তী এলাকার দায়িত্ব তাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের, বিএসএফের। যদি ও পার থেকে হামলাকারীরা ঢুকে উসকানি দেয় বা অনুপ্রবেশ হয়, তার দায়িত্ব বিএসএফের। অথচ বিএসএফকে সঠিক দায়িত্ব পালন করতে হবে, সেটির উল্লেখ প্রয়োজন ছিল রাজ্যপালের রিপোর্টে। সেটা নেই। এই রিপোর্টে বিজেপিকে ‘খুশি করার মতো’ এবং বাংলাকে ‘ইঙ্গিতপূর্ণ ভাবে কলুষিত’ করার চেষ্টা হয়েছে, সে-নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।

এর আগেও আমরা দেখেছি, বিজেপির অ্যাজেন্ডা মেনে ২০ জুন রাজভবনে পালিত হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ দিবস। জগদীপ ধনখড়ের সময়ে যা হত, সিভি আনন্দ বোসের সময়ে তাই-ই হয়েছে। বিজেপির দাবি, শ্যামাপ্রসাদের নেতৃত্বেই ১৯৪৭ সালের ২০ জুন আনুষ্ঠানিক ভাবে ভারতের অংশ হিসাবে পশ্চিমবঙ্গে সিলমোহর পড়ে। সে দিন শ্যামাপ্রসাদপন্থী ৫৪ জন বিধায়কের প্রবল দাবির কাছেই পশ্চিমবঙ্গ স্বীকৃতি পেয়েছিল বলে বিজেপি দাবি করে। শ্যামাপ্রসাদের দাবি ছিল, ভারত ভাগ করলে বাংলাকে ভাগ করে বাংলার হিন্দুপ্রধান অঞ্চলগুলি নিয়ে ‘পশ্চিমবঙ্গ’ তৈরি করতে হবে। যা হবে হিন্দুপ্রধান ভারতের অংশ। এই দিনটি প্রতি বছর নিয়মিত পালন করে বাংলার গেরুয়া শিবির। আনন্দ বোস রাজভবনে বসে সেই কম্মটিই করেছেন। দেখেছি, এ রাজ্যের কোনও শিক্ষাবিদকে খুঁজে পায়নি রাজভবন। তাঁর কথায় উঠবে-বসবে, এমন কিছু ‘পাপেট’কেই স্থায়ী উপাচার্য বাছাইয়ের জন্য প্রস্তাবিত সার্চ কমিটিতে নিয়োগ করতে চেয়েছেন রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস (cv ananda bose)। যাঁরা ওঁর কথা শুনবেন, উঠবেন, নাচবেন, এমন কিছু পাপেট উনি রেখেছেন কমিটিতে। যেমন ভাবে উপাচার্য নিয়োগ করছিলেন, সেই প্রক্রিয়াই জারি রেখেছিলেন তিনি সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ পাওয়ার পরেও। সার্চ বা অনুসন্ধান কমিটির সদস্য মনোনয়নের জন্য রাজ্য, রাজ্যপাল এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)— তিন পক্ষকেই পাঁচটি নাম জানাতে বলে শীর্ষ আদালত। সেই মতো রাজ্যের তালিকায় ছিলেন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য সব্যসাচী বসু রায়চৌধুরী, আইএসআই-এর অধ্যাপক অভিরূপ সরকার, বাঁকুড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য দেবনারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায়, সাহা ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক অভিজিৎ চক্রবর্তী, সংস্কৃত কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য অনুরাধা মুখোপাধ্যায়। আর সিভি আনন্দ বোসের পাঠানো তালিকায় ছিলেন বীরেন্দ্রকুমার তিওয়ারি (উপাচার্য, আইআইটি, খড়্গপুর), উদয় মৈত্র (অধ্যাপক, ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স, বেঙ্গালুরু), রমেশ চন্দ্র (উপাচার্য, মহারাজা সুরোজমল বৃজ বিশ্ববিদ্যালয়, ভরতপুর), সৈয়দ ই হাসনৈন (অধ্যাপক, আইআইটি, দিল্লি), ইন্দ্রনীল মান্না (উপাচার্য, বিআইটি, মেসরা)। এই তালিকায় আইআইটি, খড়্গপুরের উপাচার্য ছাড়া সকলেই ভিন্‌রাজ্যের শিক্ষাবিদ।

কীর্তিমান এই রাজ্যপাল সংবাদ সংস্থা পিটিআইকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘রাজ্য সরকারের প্রতি আস্থা হারিয়েছে বাংলার মানুষ’। শুধু তা-ই নয়, তাঁর নির্দেশে আরজি কর-কাণ্ড নিয়ে রাজভবনে একটি কন্ট্রোল রুমও খোলা হয়েছিল। সিবিআই তাদের তদন্ত রিপোর্টে রাজ্যের পুলিশের তদন্তের কথাগুলোর পুনরাবৃত্তি করার পর সেই সব অহেতুক কার্যকলাপের পরিণতি কী হল, সেটা অবশ্য অনালোচিত ও অনালোকিত। ০৩৩২২০০১৬৪১ এবং ৯২৮৯০১০৬৮২— এই দু’টি নম্বরে ফোন করে এখন কী বিষয়ে কথা বলা যায়, জানতে ইচ্ছে করে।
এই রাজ্যপাল দিল্লিতে বলেছিলেন, ‘‘এই মুহূর্তে বাংলার অবস্থা উদ্বেগজনক। ছাত্ররা সরকারের উপর বিশ্বাস হারিয়েছেন, যুবকেরা ভীতসন্ত্রস্ত, আর মহিলারা হতাশায়। নাগরিকদের সুরক্ষা দেওয়া সরকারের দায়িত্ব। কিন্তু এই ঘটনার পর প্রশ্ন উঠছে সরকারের ভূমিকা নিয়েই। সাম্প্রতিক ঘটনাটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে সরকারের গাফিলতি।’’ পাশাপাশি তাঁর বক্তব্য ছিল, কলকাতা পুলিশ ‘দুর্নীতিগ্রস্ত’ এবং ‘রাজনৈতিক মদতপুষ্ট’। তখন তাঁর মনে হয়েছিল, ‘‘শীর্ষ আদালতের পর্যবেক্ষণ শুনে দেশ স্বস্তি পেল।’’এখনও সেই কথা বলার মুরোদ তাঁর আছে কি? আমরা জানি না।

আরও পড়ুন-১২ দিন পরও নিখোঁজ পূর্ণম, দিশেহারা স্ত্রী

আমরা জেনেছি, সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণের এক মাস পূরণের আগেই ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দু’বার রাজ্য বিধানসভায় পাশ হওয়া একাধিক বিলে অনুমোদন দিলেন রাজ্যপাল। ওই পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছিল, রাজ্য বিধানসভায় পাশ হওয়া বিল রাজ্যপালের ঝুলিয়ে রাখা ‘বৈধ’ নয়। এর আগে মঙ্গলবার রাজ্যপাল বোস ‘পশ্চিমবঙ্গ শহর ও দেশ (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) (সংশোধনী) বিল ২০২৩’, ‘পশ্চিমবঙ্গ ভূমি সংস্কার ও প্রজাস্বত্ব ট্রাইব্যুনাল (সংশোধন) বিল ২০২২’, ‘পশ্চিমবঙ্গ কর ট্রাইব্যুনাল (সংশোধনী) বিল ২০২২’ অনুমোদন করেছিলেন। পাশাপাশি, রাজ্যপাল পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় ‘পশ্চিমবঙ্গ সংখ্যালঘু কমিশন (সংশোধন) বিল ২০২৫’ পেশ করার সুপারিশ করেছিলেন রাজ্য সরকারের কাছে। প্রসঙ্গত, তামিলনাড়ু বিধানসভায় পাশ হওয়া ১০টি বিলে সে রাজ্যের রাজ্যপাল সম্মতি না-দেওয়ায় সেগুলি আইনে পরিণত করতে পারছিল না সরকার। রাজ্যপালের ওই ভূমিকার বিরোধিতা করে শীর্ষ আদালতে গিয়েছিল ডিএমকে সরকার। শীর্ষ আদালত জানায়, অনন্তকাল ধরে বিধানসভায় পাশ হওয়া বিল ঝুলিয়ে রাখতে পারেন না রাজ্যপাল।

বিজেপি-বিরোধী দলের শাসনে থাকা বিভিন্ন রাজ্যপালেরা ঘোরতর রাজনৈতিক চরিত্র। সবাই দেখছে, কেন্দ্রীয় শাসকেরা ঠিক কী ভাবে রাজ্যপালদের ব্যবহার করতে চান। রাজভবনকে সরাসরি রাজনীতির আখড়া করে তোলার ক্ষেত্রে নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহরা চ্যাম্পিয়ন! তাঁদের ‘বিকশিত’ ভারতে রাজভবনগুলি যে ভাবে মুখোশ খুলে রাজনীতি করার দলীয় প্রশ্রয় পেয়ে যাচ্ছে, তার জুড়ি মেলা ভার। পশ্চিমবঙ্গে রাজভবনের বর্তমান কর্তা সি ভি আনন্দ বোস তাঁর পূর্বসূরিকেও ছাপিয়ে গেলেন। ইনি এমন রাজ্যপাল যাঁর বিরুদ্ধে যৌন নিগ্রহের অভিযোগ এবং তাঁর সাংবিধানিক রক্ষাকবচ সত্ত্বেও তদন্তে ছাড়পত্র চেয়ে এক অভিযোগকারিণীর মামলা গ্রহণ করেছে দেশের সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়।

রাজ্যপাল নামক ‘নিরপেক্ষ’ সাংবিধানিক পদাধিকারীকে সচেতন ভাবে (রাজনৈতিক) সংবাদের উপকরণ করে তোলার ক্ষেত্রে অগ্রণী ছিলেন ধনখড়। রাজভবন কার্যত বিজেপি নেতাদের সমান্তরাল দফতর হয়ে উঠেছিল। আর আনন্দ বোস? উপাচার্য নিয়োগ নিয়ে এই প্রাক্তন আইএএস কী করেছেন, বিধানসভায় পাশ হওয়া ক’টা বিল ‘আটকে’ আছে, রাজ্যপালের বিরুদ্ধে ওঠা শ্লীলতাহানির অভিযোগের গতি কী হবে, নীতি আয়োগের বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রীর ভূমিকাকে কটাক্ষ করে রাজভবনের ‘এক্স’ হ্যান্ডল-বার্তা না হয় বাদই দিলাম। এবার রাষ্ট্রপতি শাসনের সুপারিশ করেছেন সিভি আনন্দ বোস।
শেক্সপিয়রের জুলিয়াস সিজ়ার নাটকের উক্তি ধার করে বলতেই হবে, বোস ‘ইজ় অ্যান অনারেবল ম্যান’।

Latest article