ডাক্তার ! ও ডাক্তার !!

মার্চ মাসের শেষের দিকে বিদেশের মাটিতে শান্ত ও দৃঢ়ভাবে বিরূপ পরিস্থিতি সামলে মুখ্যমন্ত্রী আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিজের ও দেশের ভাবমূর্তি আরও উজ্জ্বল করেছেন। আর এখন, ছয় মাসের মধ্যে সেদিন যাঁরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন, তাঁদের দোষে তাঁদের নিজেদের রাজনৈতিক দলের ও দেশের মাথা হেঁট হল। লিখছেন সাগ্নিক গঙ্গোপাধ্যায়

Must read

‘ডাক্তার মানে তো মানুষ নয়
আমাদের চোখে সে তো ভগবান
কসাই আর ডাক্তার এক’ই তো নয়
কিন্তু দুটোই আজ প্রফেশান
কসাই জবাই করে প্রকাশ্য দিবালোকে
তোমার আছে ক্লিনিক আর চেম্বার
ও ডাক্তার… ও ডাক্তার…’
চেনা গান। কথা ও সুর, নচিকেতার। এই গানে কসাই আর ডাক্তার অন্বিত হয়েছে অর্থলোলুপতার সৌজন্যে। আর এখন জানছি বামপন্থী রামপন্থী ভয়ানক মমতা- বিরোধী ডাক্তার কসাইসুলভ হয়ে উঠছেন মাংসলোলুপ হওয়ার কারণে। সে মাংস আবার কোনও গবাদি পশুর খাদ্য-উপযোগী মাংস নয়। একেবারে তাজা মাংস। নারী শরীরের! এবং, কী আশ্চর্য! অত্যাশ্চর্য সমাপতন! সেই ডাক্তারবাবুও বিলাতি ডিগ্রিধারী। এক্কেবারে নচিকেতার গানের মতো।
মনে পড়ে কলিগুলো?
ও ডাক্তার, ও ডাক্তার…
তুমি কতশত পাশ করে
এসেছ বিলেত ঘুরে
মানুষের যন্ত্রণা ভোলাতে
ও ডাক্তার, ও ডাক্তার…
তোমার এমবিবিএস না না এফআরসি
বোধহয় এ টু জেড ডিগ্রি ঝোলাতে
ও ডাক্তার, ও ডাক্তার…
মহিলা সহকর্মীদের ‘টাটকা মাংস’ হিসেবে দেখা, অপারেশন টেবিলে নার্সের স্তন খামচে ধরা— ব্রিটেনের ‘যৌন শিকারি’ বাঙালি ডাঃ অমল বোসের কথা বলছি।

আরও পড়ুন-মণ্ডপে নয় মোদির ছবি, দিল্লির পুজো কমিটিগুলির গণবিদ্রোহ

একদা ল্যাঙ্কাশায়ার ব্ল্যাকপুল ভিক্টোরিয়া হাসপাতালে হৃদরোগ চিকিৎসার বিভাগীয় প্রধান। আপাতদৃষ্টিতে একজন ‘নিবেদিতপ্রাণ, অত্যন্ত দক্ষ শল্যচিকিৎসক। কিন্তু সেটা ডাঃ জেকিলের ছবি। মিঃ হাইড হিসেবে এই ব্যক্তিরই অন্য রকম কীর্তিকলাপ।
অস্ত্রোপচারের প্রস্তুতির সময় এক নার্সের স্তন খামচে ধরেছিলেন তিনি। আর এক মহিলার অভিযোগ, কলম খুঁজতে গিয়ে তিনি তাঁর পকেটে হাত দেন ও স্তন খামচে ধরে ‘তাজা মাংস’ বলে বর্ণনা করেন। এহ বাহ্য, ২০১৭ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে তিনি একাধিকবার মহিলা সহকর্মীদের যৌনহেনস্থা করেন বলে প্রমাণিত। অন্তত পাঁচজন মহিলা সহকর্মী তাঁর হয়রানির শিকার হয়েছেন। ২০২৩ সালে যৌনহেনস্থার অভিযোগে চাকরি থেকে বরখাস্ত হওয়ার পর তাঁর বিরুদ্ধে আদালতে মামলা গড়ায়। ব্রিটেনের আদালত ৫৫ বছর বয়সি এবং পাঁচ সন্তানের বাবা এই বিকৃত রুচির বাম-রামপন্থী চিকিৎসককে ৬ বছরের জন্য জেলে পাঠিয়েছে।
প্রিস্টন ক্রাউন কোর্টে বিচারক ইয়ান আনসওয়ার্থ অমলকে বলেন যে, তিনি তাঁর ‘উচ্চ অবস্থান’ ব্যবহার করে সহকর্মীদের ‘টার্গেট’ করে গেছেন! এই বিশ্বাসের বশে তিনি এই কাজ করেছেন যে তিনি কোনওভাবেই অভিযুক্ত হবেন না। তাঁকে ‘সাদা পোশাকের আড়ালে থাকা এক যৌন শিকারি’ বলে বর্ণনা করে আদালত। কারণ, অমলের মধ্যে কৃতকর্মের কোনও প্রকৃত অনুশোচনা দেখা যায়নি বলে জানিয়েছেন বিচারকেরা। এমন রত্নখচিত চরিত্র যাঁর, তাঁকেই বীরের সন্মান দিতে ইতস্তত করেনি গণশক্তি।
অক্সফোর্ডে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষণ পণ্ড করার অপচেষ্টা যেসব রাম-বাম ‘বীরপুঙ্গবরা’ চালান, তাঁদের অন্যতম ছিল এই ‘সাদা পোশাকের আড়ালে থাকা এক যৌন শিকারি’ ডাক্তার অমল বোস। এসএফআই সেদিন এই ডাক্তারের অপচেষ্টার সাফাই দিতে গিয়ে বলেছিল, ‘অক্সফোর্ডে গিয়ে মিথ্যাভাষণ দেবেন, আর SFI চুপ করে শুনবে? তা হয় না।’
সেদিন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের সামনেই অমল বোসের মতো গুটিকয় বিক্ষোভকারীকে ‘বাপি বাড়ি যা’ করে দিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
দিয়েছিলেন নিজের মনকে বশে রেখে, সংযত রেখে। বিক্ষোভকারীদের স্লোগান এবং পোস্টারের সামনে তিনি বললেন, ‘আমি আপনাদের সকলকে খুব ভালবাসি। আপনারা আপনাদের পার্টিকে আরও মজবুত করুন। যাতে আমার সঙ্গে তারা লড়তে পারে!’ পাশাপাশি মনে করিয়ে দিলেন, দেশের প্রতিনিধি হয়েই তিনি বিলেতে এসেছেন, অক্সফোর্ডে বক্তৃতা করছেন। বিক্ষোভকারীদের উদ্দেশে মমতা বলেন, ‘আমাকে অপমান করছেন করুন। দেশকে অপমান করবেন না।’ মমতার উদ্দেশে যখন বিক্ষোভকারীরা পোস্টার দেখাচ্ছেন, তখন জননেত্রীও পোডিয়াম থেকে পাল্টা পোস্টার দেখান। তাতে তাঁর মাথায় ব্যান্ডেজ করা ছবি। ১৯৯০ সালের ১৬ অগস্ট হাজরা মোড়ে তাঁর উপর যে হামলা হয়েছিল, পরের দিনের সংবাদপত্রে ওই ছবিটিই প্রকাশিত হয়েছিল। মুখ্যমন্ত্রী যখন ওই ছবি তুলে ধরছেন, তখন বিক্ষোভকারীদের দিক থেকে বলা হয়, ‘নাটক! নাটক!’ পাল্টা জননেত্রী শান্ত অথচ দার্ঢ্য কণ্ঠে বলেন, ‘কোনও নাটক নয়। এটাই ঘটনা।’ বাকি দর্শকদের সমবেত প্রতিবাদের সামনে বিক্ষোভকারীরা অবশ্য বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারেননি। পোস্টার নিয়ে হল ছেড়ে বেরিয়ে যেতে হয় তাঁদের। আর নেত্রী বলেন, ‘ওঁরা আমায় মিস্ করলেন।’ তার পরে বললেন জনপ্রিয় ইংরেজি গানের দু’লাইন, ‘ইফ ইউ মিস্ দ্য ট্রেন অ্যাম অন, ইউ উইল নো দ্যাট আই অ্যাম গন! ইউ ক্যান হিয়ার দ্য হুইসল ব্লো আ হানড্রেড মাইলস।’ সেটা ছিল এ-বছরেরই ২৮-২৯ মার্চের ঘটনা। ছ’মাসের মধ্যে জানা যাচ্ছে, বুক পকেট থেকে কলম নেওয়ার অছিলায় নার্সের স্তন খামচে জেলে গেছেন অভয়া মঞ্চের চিকিৎসক।
সেদিন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে ঘটনার জন্য দুঃখপ্রকাশ করে। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী হাসিমুখে জানান, এতে আমার আরও এখানে আসতে ইচ্ছে করছে। মনে রাখবেন, দিদি কারও তোয়াক্কা করে না, রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের মতো হাঁটে। যদি পারো, আমাকে ধরো।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মূলত নারী, শিশু ও প্রান্তিক মানুষের উন্নয়ন বিষয়ে বক্তৃতা দিতে আমন্ত্রিত ছিলেন। তিনি নিজের সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প যেমন ‘কন্যাশ্রী’ ও ‘স্বাস্থ্য সাথী’ নিয়েও কথা বলেন।
আর কী আশ্চর্য! ওই ডাক্তার নারী নির্যাতনের দায়ে জেলে গেলেন। একেবারে কাব্যিক ন্যায়বিচার!
বিদেশের মাটিতে শান্ত ও দৃঢ়ভাবে বিরূপ পরিস্থিতি সামলে সেদিন মুখ্যমন্ত্রী আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিজের ও দেশের ভাবমূর্তি আরও উজ্জ্বল করেছেন। আর এখন, সেদিন যাঁরা তাঁর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখাচ্ছিল, তাঁদের দোষে তাঁদের নিজেদের রাজনৈতিক দলের ও দেশের মাথা হেঁট হল।
এর বেলা গণশক্তি কী সাফাই দেবে?
রাম পক্ষ বাম পক্ষ যাই সাফাই দিক, ওদের মিথ্যে কথায় কান না দিয়ে, আসুন আমরা গলা মেলাই নচিকেতার গানে,
‘তোমার ছেলের চোখে দেখেছ কি
কত ঘৃণা জমা অবাক্ত
তোমারও অসুখ হবে, তোমারি
দেখানো পথে
যদি তোমাকেই দেখে কোনও
ডাক্তার
ও ডাক্তার… ও ডাক্তার…
ও ডাক্তার… ও ডাক্তার…’
পুনশ্চ : অক্সফোর্ডে যারা জননেত্রীর ভাষণ ভন্ডুল করতে নেমেছিল তারা কেবল ডাঃ অমল বোসের মতো বামাচারী ছিলেন না, গেরুয়া পার্টিও উপস্থিত ছিল তাদের মধ্যে। সুশীল ডোকওয়াল এক্কা, ব্রিটেনের এক চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট সংস্থার উচ্চপদে কর্মরত, তিনিও মার্চের শেষ ভাগে মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে শামিল ছিলেন বলে জানা গিয়েছিল। এক্কা কট্টর বিজেপি সমর্থক বলে পরিচিত। ফলে বিলেতের মাটিতেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরোধিতায় রাম-বাম যৌথ ষড়যন্ত্রের একেবারে হাতেগরম প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল তখনই। অমল বোস যখন জেলে, তখন সুশীল ডোকওয়াল এক্কার মনের অবস্থা কেমন, সেটা অবশ্য এখনও অজ্ঞাত।

Latest article