সেই সংস্থা যার প্রতিষ্ঠাতা আচার্য পি সি রায়, সেটাকেই মোদি সরকার ধ্বংস করতে চায়

বেঙ্গল কেমিক্যালসের জন্য বাজেটে বরাদ্দ মোটে ১ লক্ষ টাকা। এই সামান্য বাজেট বরাদ্দ নিয়ে সংসদে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জে পি নড্ডার কাছে কারণও জানতে চেয়েছেন তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায়। কোনও সদুত্তর মেলেনি। নামমাত্র বরাদ্দ প্রমাণ করে কেন্দ্র বাংলার সংস্থাগুলির সঙ্গে কীভাবে বঞ্চনা করছে। গতকালই চলে গেছে আচার্যের ১৬৩ তম জন্মবার্ষিকী। আজ এসব নিয়েই কলম ধরলেন দেবু পণ্ডিত

Must read

প্রফুল্লচন্দ্র রায় কোনও একমাত্রিক মানুষ ছিলেন না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে ‘আচার্য’ সম্বোধন করেন। বিলেতের বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর প্রবন্ধ নিয়ে চর্চা হত। কলেজ প্রাঙ্গণে তৈরি করেন নতুন ভারতের ছাত্রদল। তিনিই আবার ভারতবাসীকে শেখান স্বাবলম্বী হওয়ার মন্ত্র।

কেমন শিক্ষক ছিলেন তিনি? কয়েকটা উদাহরণ দেওয়া যাক ভুলে যেতে বসা ইতিহাসের পাতা থেকে। রসায়নের ক্লাস। ছাত্রদের সামনে এক টুকরো হাড় হাতে নিয়ে বুনসেন বার্নারে পুড়িয়ে মুখে পুরে দিলেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। ছাত্রদের শেখালেন, এটা ক্যালসিয়াম ফসফেট। এছাড়া আর কিছুই নয়। সেটা কোন প্রাণীর হাড় তা-ও আর চেনার উপায় রইল না। রসায়ন দিয়ে শুধু রসায়ন শিক্ষাই নয়, ছাত্রদের মনে ধর্মান্ধতার মূল উপড়ে ফেলার মন্ত্রটিও প্রবেশ করিয়ে দিতেন তিনি। যতটুকু দরকার, তার বাইরে কতটুকুই বা পড়ার আগ্রহ আছে আমাদের বইবিমুখ আগামীর? অথচ, বই পড়ার আগ্রহ থেকেই জন্ম হয়েছিল এই বাঙালি মনীষীর। নিজের সাফল্যকে পৌঁছে দিতে পেরেছিলেন সার্থকতার শিখরে।
বাংলাদেশের খুলনার রাড়ুলি গ্রামে জন্ম। নিজ গ্রামে পিতার প্রতিষ্ঠিত স্কুলেই তাঁর শিক্ষার সূচনা। গরিব পরিবারের মেধাবী ছেলে। প্রফুল্লচন্দ্র তখন স্কুলছাত্র। একদিন মনে হল, বাবার ভূগোলের জ্ঞান পরীক্ষা করলে কেমন হয়! শিশু প্রফুল্লচন্দ্রের প্রশ্ন, ‘আচ্ছা, সিবাস্টোপল কোথায়?’ মুহূর্তে বাবা হরিশ্চন্দ্রের উত্তর, ‘কী সিবাস্টোপলের কথা বলছ? ইংরেজরা ওই শহর কী ভাবে অবরোধ করল, তা যেন চোখে ভাসে!’

বাবার পরিকল্পনাতেই কলকাতায় পড়তে আসা, ওঠা ১৩২ নম্বর আমহার্স্ট স্ট্রিটের বাসা, চাঁপাতলায়। হেয়ার স্কুলে ভর্তি হলেন। প্রবেশিকা পরীক্ষায় ‘আশানুরূপ’ ফল হয়নি। বিদ্যাসাগরের কলেজ মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশনে ভর্তি হলেন। তারপর প্রেসিডেন্সিতে বাইরের ছাত্র হিসেবে যোগ দেন। সেখানেই স্যর আলেকজ়ান্ডার পেডলারের প্রেরণায় রসায়নের প্রতি বিশেষ টান। বাবার ইচ্ছে ছিল, ছেলে বিলেত যাক। কিন্তু পরিবারের আর্থিক সংগতি অনুকূল নয়। তাই গোপনে ‘গিলক্রাইস্ট’ বৃত্তির জন্য প্রস্তুতি শুরু। সেকথা জানাজানি হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ‘কৃতী’ ছাত্র বিদ্রুপ করে বলল, ‘ওর (প্রফুল্লচন্দ্রের) নাম লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যালেন্ডারের বিশেষ সংস্করণে বার হবে।’ প্রফুল্লচন্দ্র রায়ও আশা ছেড়েছিলেন। একদিন কলেজে ইংরেজি দৈনিক ‘দ্য স্টেটসম্যান’-এর একটা খবরে চোখ পড়ল। গোটা দেশ থেকে সে বছর বৃত্তি পেয়েছেন বোম্বাইয়ের বাহাদুরজি আর বাংলার প্রফুল্লচন্দ্র রায়। ১৮৮৭-তে রসায়নে মৌলিক গবেষণার জন্য ডিএসসি উপাধি পান তিনি।
মারকিউরাস নাইট্রাইটের আবিষ্কারকে প্রফুল্লচন্দ্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কৃতিত্ব হিসেবে ধরা হলেও যৌগটির ‘অস্তিত্ব’ এখনও অধরা, দাবি বিজ্ঞানীদের একাংশের। বরং তাঁর বৈজ্ঞানিক কৃতিত্ব, ‘জৈব নাইট্রাইট, গন্ধকযুক্ত বিবিধ জৈব যৌগ এবং ধাতব লবণের সঙ্গে তাদের বিক্রিয়া, জৈব হ্যালোজেন যৌগ বিশেষত ফ্লোরিনযুক্ত এবং পারদের ধাতু যুক্ত জৈব যৌগ— এ সবের প্রস্তুতি ও পরীক্ষণের সূচনা’ করা।

আরও পড়ুন- প্রতিবাদে উত্তাল দিল্লি, বন্ধ করা হল মাইক্রোফোন, ওয়েলে নেমে বিক্ষোভ

সন ১৯০৯। ভারতের রসায়ন তথা বৈজ্ঞানিক গবেষণার ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বছর। জ্ঞানেন্দ্রচন্দ্র ঘোষ, জ্ঞানেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, মানিকলাল দে, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, পুলিনবিহারী সরকার, নীলরতন ধর, মেঘনাদ সাহা, রসিকলাল দত্ত— এরকম এক ঝাঁক কৃতী ছাত্র ভর্তি হলেন প্রেসিডেন্সি কলেজে। তাঁরা শিক্ষক হিসেবে পেলেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়কে। এঁদের অনেককে নিয়েই প্রফুল্ল চন্দ্র পরবর্তী কালে গড়ে তোলেন ‘ইন্ডিয়ান স্কুল অব কেমিস্ট্রি’। পুত্র-গর্বে গর্বিত জননী যেভাবে বলেন, আমার ছেলেরাই আমার অলঙ্কার, ঠিক সেই ভঙ্গিতে প্রফুল্লচন্দ্র বলতেন, ‘এই সব ছাত্ররাই আমার রত্ন।’
এই প্রসঙ্গে আর একটি তথ্য।
ভারতে বিজ্ঞানের জগতে সর্বোচ্চ পুরস্কার শান্তিস্বরূপ ভাটনগর পুরস্কার। সেই শান্তিস্বরূপ ভাটনগর আক্ষেপ করে বলতেন, ‘আমি একটা গুরুতর অপরাধ করেছি যে, স্যর পি সি রায়ের ছাত্র হতে পারিনি। সেজন্য হয়তো তিনি আমাকে ক্ষমা করেননি।…আমি তাঁর রাসায়নিক ‘প্রশিষ্য’ হয়েছি। পি সি রায়ের ছাত্র অতুলচন্দ্র ঘোষের কাছে আমি রসায়ন শিখেছি।’ আসলে শিক্ষার জগতে প্রফুল্লচন্দ্র একটি ‘লেগাসি’।
কলেজকে ক্লাসের চৌহদ্দির মধ্যে আটকে রাখতে চান না প্রফুল্লচন্দ্র। ১৯২১-এ খুলনায় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা গেল। কিন্তু সরকার তা মানতে নারাজ। এমনকী, সরকারি প্রতিনিধি রূপে বর্ধমানের মহারাজা খুলনা পরিদর্শন করে এসে বললেন, ‘দুর্ভিক্ষের চিহ্ন নেই!’ স্থির থাকলেন না প্রফুল্লচন্দ্র। দ্বারে-দ্বারে ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। সংগ্রহ করলেন কয়েক লক্ষ টাকা। ১৯২২-এ বগুড়া, রাজশাহি, পাবনা-সহ বিস্তীর্ণ এলাকায় বিপুল বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হল জনজীবন। সরকারি হিসেবেই প্রায় ১,৮০০ বর্গ মাইল এলাকা প্লাবিত। ১২ হাজার গবাদি পশু নিখোঁজ। শস্য নষ্ট, প্রায় ৫০ জনের প্রাণহানি হয়েছে।’ বেঙ্গল রিলিফ কমিটির ছাতার তলায় শুরু করলেন কাজ। সায়েন্স কলেজই হল তাঁর হেড কোয়ার্টার। কমিটির আর একজন সেনানি সুভাষচন্দ্র বসু। প্রফুল্লচন্দ্রের আহ্বানে অন্তত ৭০ জন স্বেচ্ছাসেবক প্রাথমিক কাজ শুরু করলেন। তাঁর আহ্বানে বোম্বাই, মাদ্রাজ-সহ দেশের নানা প্রান্ত, এমনকী জাপান থেকেও সাহায্য এল। সঙ্গে-সঙ্গে দেশবাসী ত্রাণের জন্য সায়েন্স কলেজে পাঠাতে থাকলেন রাশি-রাশি জামাকাপড়।

স্বদেশ-ভাবনা থেকেই প্রফুল্লচন্দ্রের বিখ্যাত বই— ‘এ হিস্ট্রি অব হিন্দু কেমিস্ট্রি’ ও ৮০০ টাকা পুঁজি নিয়ে তৈরি শিল্প প্রতিষ্ঠান ‘বেঙ্গল কেমিক্যাল অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কস’। ৯১ নম্বর আপার সার্কুলার রোডে আচার্যের ভাড়াবাড়িটিই এই শিল্প প্রতিষ্ঠানটির আঁতুড়ঘর। উদ্দেশ্য ছিল দুটো। বিদেশ থেকে নানা দ্রব্যের আমদানিতে লাগাম পরানো। তার পাশাপাশি বাঙালিকে কেরানিগিরি থেকে সরিয়ে এনে নিজের পায়ে দাঁড় করানো।
কেন্দ্রের বাজেটে সাধারণত কোটি টাকা, লক্ষ কোটি টাকা বরাদ্দের কথাই শোনা যায়। কিন্তু মাত্র ১ লক্ষ! মোদি সরকারের এ বারের বাজেটে এই টাকাই বরাদ্দ হয়েছে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের হাতে গড়া বেঙ্গল কেমিক্যালস অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যালসের জন্য। সেই সঙ্গে বন্ধ হয়ে যাওয়া বেঙ্গল ইমিউনিটির ভাগ্যেও জুটেছে একই পরিমাণ অর্থ। আর এই টাকা বেঙ্গল কেমিক্যালসের মতো লাভজনক সংস্থার কেন প্রয়োজন তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সেই সঙ্গে পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের মতো মনীষীদের প্রতি বিজেপির মতো বাংলা-বিরোধী দলের মনোভাবও।

Latest article