স্বল্পদৈর্ঘ্যে কল্পনির্ঝর

কলকাতার ম্যাক্সমুলার ভবনের গ্যেটে ইনস্টিটিউটে অনুষ্ঠিত হল ‘কল্পনির্ঝর আন্তর্জাতিক স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র উৎসব’। দেখানো হয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ৩২টি ছবি। দর্শকদের উপস্থিতি ছিল উল্লেখ করার মতো। ছিলেন বিশিষ্টজনেরাও। চলচ্চিত্র উৎসব ঘুরে এসে লিখলেন অংশুমান চক্রবর্তী

Must read

শহর কলকাতার সবচেয়ে বড় আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব আয়োজিত হয় রাজ্য সরকারের উদ্যোগে। সেটা ‘কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব’। রাজ্য সরকারের শিশু-কিশোর আকাদেমির উদ্যোগে আয়োজিত হয় ‘কলকাতা আন্তর্জাতিক শিশু-কিশোর চলচ্চিত্র উৎসব’। এর পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগেও কয়েকটি জায়গায় চলচ্চিত্র উৎসব আয়োজিত হয়। রীতিমতো আন্তর্জাতিক মানের। কোনও উৎসবে দেখানো হয় পূর্ণ দৈর্ঘ্যের ছবি, কোথাও তথ্যচিত্র, আবার কোনও উৎসবে দেখানো হয় স্বল্প দৈর্ঘ্যের ছবি।

আরও পড়ুন-বদল হোক ভাবনার

২১-২৫ এপ্রিল, কলকাতার ম্যাক্সমুলার ভবনের গ্যেটে ইনস্টিটিউটে অনুষ্ঠিত হল ‘কল্পনির্ঝর আন্তর্জাতিক স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র উৎসব’। এবার ছিল ২২তম এডিশন। এই উৎসব বহু আগেই শহরের চলচ্চিত্র ক্যালেন্ডারে বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে। সমীহ আদায় করেছে সিনেপ্রেমীদের। কল্পনির্ঝর ফাউন্ডেশন আয়োজিত এই চলচ্চিত্র উৎসবে বছর বছর দেখানো হয় বিশ্বের নামীদামি চলচ্চিত্র নির্মাতাদের উল্লেখযোগ্য ছবি।
এই বছরের উৎসবে দেখানো হয়েছে পৃথিবীর নানান দেশের ৩২টি স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি। ভারতের বিভিন্ন ভাষার ছবি যেমন দেখানো হয়েছে, তেমনই দেখানো হয়েছে বুলগেরিয়া, অস্ট্রিয়া, আমেরিকা, সুইজারল্যান্ড, চিন, স্পেন, জার্মানি, বেলজিয়াম, ফ্রান্সের ছবি। প্রতিদিন দর্শকদের উপস্থিতি ছিল উল্লেখ করার মতো। এসেছেন, ছবি দেখেছেন, ভাব বিনিময় করেছেন বিশিষ্ট চলচ্চিত্র পরিচালক গৌতম ঘোষ, অভিনেতা বরুণ চন্দ, চলচ্চিত্র সমালোচক শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়, অভিনেত্রী ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত, গ্যেটে ইনস্টিটিউট ম্যাক্সমুলার ভবনের ডিরেক্টর অ্যাস্ট্রিড ওয়েজ প্রমুখ। এছাড়াও ছিলেন রাজু রমন, রবীন বন্দ্যোপাধ্যায়। উদ্বোধনী ছবি ছিল কঙ্কণা চক্রবর্তী পরিচালিত ‘রি-রাউটিং’।
প্রতিযোগিতা বিভাগটি ভারতীয় ছবির জন্য নির্ধারিত। উৎসবের সেরা নির্বাচিত হয়েছে তরুণ জৈন পরিচালিত হিন্দি ছবি ‘ব্যালাড অফ দ্য মাউন্টেন’। তুলে ধরা হয়েছে উত্তরাখণ্ডের এক পাহাড়ি শিশুকন্যার গল্প, যে সবুজ প্রকৃতির বুকে বেড়ে ওঠে। ওড়ার স্বপ্ন দেখে। মহাকাশচারী হতে চায়। ২০২৪ সালে তৈরি হয়েছিল ১৭ মিনিটের ছবিটি। কাহিনি তো বটেই, অভিনয়, সংলাপ, দৃশ্য গ্রহণ, সম্পাদনা, আবহ দর্শকদের মন ছুঁয়ে গেছে। ছবিটি যেন কবিতার মতো। আশ্চর্য, মায়াবী।
প্রতিযোগিতা বিভাগের অন্য ছবিগুলোও মনকাড়া। অনুপ আব্রাহাম প্যারাকাল পরিচালিত ‘দ্যাট পারফেক্ট ডে’র কাহিনি দানা বেঁধেছে মাইকেল নামে এক দশ বছরের ছেলেকে ঘিরে। সামনেই তার জন্মদিন। তাই দারুণ উত্তেজিত। সে ক্লাসরুম চকোলেটে ভরিয়ে দেওয়ার স্বপ্ন দেখে। কিন্তু তার গাড়ি-চালক বাবা সেই স্বপ্ন পূরণে অসামর্থ্য। ঘিরে ধরে মনখারাপ। ২৪ মিনিটের ছবি। এককথায় অসাধারণ।
প্রতীক রাজেন্দ্র শ্রীবাস্তব পরিচালিত ‘মাই ফাদার ইজ অ্যাফ্রেড অফ ওয়াটার’ ২৮ মিনিটের ছবি। তুলে ধরা হয়েছে এক অসুস্থ বাবার গল্প। লক্ষ্য বান্থিয়া পরিচালিত ‘ফ্লাইট’ ছবিটি ২৩ মিনিটের। অসহায় একাকী নারীর জীবনকথা বলা হয়েছে, যিনি অসুস্থ, ভুগছেন মধুমেহ এবং উচ্চরক্তচাপজনিত সমস্যায়। তাঁর পুত্র আদি কর্মসূত্রে থাকে দূর শহরে। দেখা দেয় নানা সমস্যা। অস্মিতা পালের ‘বাশা’ ২২ মিনিটের ছবি। গল্পের মূল চরিত্র একটি ফুটফুটে শিশুকন্যা, যাকে তার মা ছেড়ে চলে যায়।
কৌশিক সেনগুপ্তর ‘দোসর’। ৩০ মিনিটের ছবি। বোনা হয়েছে সম্পর্কের গল্প। মূল চরিত্রে অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক এবং পেয়িং গেস্ট তরুণী। দুজনের মধ্যে রচিত হয় পিতা-পুত্রীর সম্পর্ক। একটা সময় তরুণীর আচরণ অস্বাভাবিক হয়ে ওঠে। চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে বলা হয়। শেষমেশ তরুণী বুঝতে পারেন, তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গোরা’ দ্বারা প্রভাবিত। তাঁর সামনে দেশমাতার হাতছানি। রবি কুমারের ‘সংস অফ দ্য মিস্ট’ ২২ মিনিটের ছবি। গ্রামের লোকনৃত্য শিল্পী সুরেশ গল্পের প্রধান চরিত্র। এখানেও বলা হয়েছে সম্পর্কের কথা।
প্রতিযোগিতা বিভাগে জুরি মেম্বার ছিলেন দুই চলচ্চিত্র পরিচালক, শর্মিষ্ঠা মাইতি এবং রাজদীপ পাল। জুরির দায়িত্ব পালন করতে পেরে তাঁরা খুশি। প্রসঙ্গত, অরোরা ফিল্ম কর্পোরেশন প্রযোজিত তাঁদের তৈরি স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি ‘কায়ান্তর’ ২০১৯ সালে পেয়েছিল কল্পনির্ঝর আন্তর্জাতিক স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র উৎসব-এ ‘বিশেষ জুরি উল্লেখ’ পুরস্কার। এছাড়া তাঁরা দুজনে মিলে পরিচালনা করেছেন ‘মালাই’, ‘থ্রি অন আ বেড’ এবং ২০১৪ সালে জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত ডকুমেন্টারি ‘অ্যাট দ্য ক্রসরোডস : নন্দন বাগচী লাইফ অ্যান্ড লিভিং’। ২৯তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে বেঙ্গলি প্যানোরমা বিভাগে সেরা ছবি নির্বাচিত হয়েছিল তাঁদের ‘মনপতঙ্গ’।

আরও পড়ুন-প্রেসক্রিপশনে জেনেরিক ওষুধের নাম লিখতে ফের নির্দেশ সুপ্রিম কোর্টের

অন্য দেশের ছবিগুলোর মধ্যে দর্শকদের মনে বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে বুলগেরিয়ার ‘দ্য প্রিমিয়ার’ সুইজারল্যান্ডের ‘দ্য রাইস’, জার্মানির ‘চিকেন’, স্পেনের ‘ডেজ অ্যান্ড নাইটস’, ফ্রান্সের ‘এ ফ্রেন্ডশিপ’ প্রভৃতি ছবিগুলো। উৎসবের সমাপ্তি ছবি ছিল অশোক বিশ্বনাথনের ‘ডিসটেন্সেস’।
নিছক বিনোদন নয়, উৎসবে প্রদর্শিত প্রায় প্রতিটি ছবিই দর্শকদের ভাবিয়েছে, জাগিয়েছে। দিয়েছে বিশেষ কোনও সামাজিক বার্তা।

Latest article