সিকল সেল অ্যানিমিয়া

সেপ্টেম্বর মাস হল সিকল সেল সচেতনতা মাস। এখনও অনেকে এটাই জানেন না যে, তাঁদের শরীরে সিকল সেল-এর বৈশিষ্ট্য রয়েছে, কারণ এই রোগের উপসর্গ চট করে ধরা পড়ে না। তাই পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং সতর্কতা জরুরি কারণ স্বামী-স্ত্রী দুজনের মধ্যেই যদি এই অসুখ থাকে তাহলে সন্তানের সম্ভাবনা ২৫%। লিখছেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী

Must read

অনেকের কাছেই নামটা যেমন খুব অচেনা, রোগটিও এতদিন তাই ছিল। কিন্তু পরিসংখ্যান অনুযায়ী জিনবাহিত এই রোগের বাহক এই দেশে ২ লক্ষের ওপর। রোগে আক্রান্ত-সংখ্যা প্রায় ১৪ থেকে ১৫ লক্ষ মানুষ। ফলে না জেনে থাকার উপায় রইল না।
সিকল সেল অ্যানিমিয়া রক্তের এক ধরনের রোগ। পূর্ণবয়স্ক মানুষের শরীরে যে ধরনের হিমোগ্লোবিন থাকে, এই রোগে আক্রান্তের শরীরে তা থাকে না। এই অ্যানিমিয়া যেহেতু জিনবাহিত, তাই কে এই রোগে আক্রান্ত হবেন বা কে হবেন না তা বলা সম্ভব নয়।

আরও পড়ুন-সহিংসতার জেরে ৫ বাংলাদেশি শিক্ষার্থীকে ফেরত পাঠাচ্ছে ভারত

কী এই সিকল সেল অসুখ
সিকল সেল ডিজিজ হল থ্যালাসেমিয়া ও হিমোফিলিয়ার মতো জিনবাহিত একটি অসুখ। বংশপরম্পরায় এই রোগ বাহিত হতে পারে। এই অসুখে রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কমে যায়, ফলে রক্তাল্পতা দেখা দেয়। তাই ‘সিকল সেল ডিজিজ’কে ‘সিকল সেল অ্যানিমিয়া’ও বলা হয়। এই রোগের ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট কারণে রক্তে হিমোগ্লোবিন কমে যায়।
কেন হয়
আমাদের লোহিত রক্তকণিকার আকার গোল হয়। কিন্তু সিকল সেল ডিজিজ হলে হিমোগ্লোবিনের আকার বিকৃত হয়। হিমোগ্লোবিনকে বলা হয় মেটালোপ্রোটিন যা শরীরের কোষে কোষে অক্সিজেন বয়ে নিয়ে যায়। সহজে যদি বলি, বাতাস থেকে অক্সিজেন গ্রহণের পর এটা প্রথমে ফুসফুসে যায়। সেই ফুসফুস থেকে অক্সিজেন প্রতিটি টিস্যুতে, প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গে বয়ে নিয়ে যায় হিমোগ্লোবিন। শুধু তাই নয়, এই হিমোগ্লোবিনই অক্সিজেনের সঙ্গে কার্বন-ডাই-অক্সাইড বিনিময় করে। অর্থাৎ, ফুসফুস থেকে অক্সিজেন নিয়ে শরীরে পাঠায় আর শরীর থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিয়ে ফুসফুসে পাঠায়। ফুসফুস সেই বিষাক্ত কার্বন-ডাই-অক্সাইডকে আমাদের নিঃশ্বাসের মাধ্যমে বাইরে পাঠিয়ে দেয়। কাজেই হিমোগ্লোবিনের অভাব হলে রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা কমতে থাকে। আবার এই হিমোগ্লোবিনের জন্যেই রক্ত ঘন এবং লাল হয়। সিকল সেল অ্যানিমিয়া হলে রক্তে হিমোগ্লোবিন নষ্ট হতে শুরু করে অর্থাৎ লোহিত রক্তকণিকার গঠন বিকৃত হয়ে ভেঙে যায় এবং হিমোগ্লোবিন প্রোটিনের পরিমাণও কমতে শুরু করে। বিশেষজ্ঞদের মতে, লোহিত রক্ত কণিকাগুলির এমন বিকৃতির কারণ হল হিমোগ্লোবিন-এস। এর একটি অংশ আঠালো হয়ে যাওয়ার কারণে পাশাপাশি অনেক হিমোগ্লোবিন জুড়ে গিয়ে দড়ির মতো জট পাকিয়ে শক্ত হয়ে যায়। আর সেটাকে দেখতে অনেকটা ‘Sickle’ বা কাস্তের বা অর্ধচন্দ্রের মতো হয়।
কাদের হয়
পেডিয়াট্রি সিকল সেল অ্যানিমিয়া উপসর্গ ধরা দেয় সাধারণত শিশুর এক বছর বয়সের পর থেকে। বেশ কিছু ক্ষেত্রে ৪ মাসের শিশুদের মধ্যেও এই রোগ দেখা দেয় তবে তার কারণ হল হয়তো দেখা যাবে সেই শিশুটির বাবা এবং মা-এর যে কোনও একজনের মধ্যে এই রোগ রয়েছে। অনেক সময় দেখা যায় বাবা বা মায়ের সিকল সেল অ্যানিমিয়া নেই তাও জন্মের পরে শিশুর মধ্যে এই রোগ এসেছে আবার এমনও হতে পারে যে, বাবা এবং মায়ের মধ্যে কেউ একজন এই রোগের বাহক, হয়তো রেশিও খুব বেশি নয়, মৃদু অ্যানিমিয়া রয়েছে, অথচ সন্তানের মধ্যে পুরোদস্তুর রোগের প্রকোপ রয়েছে। এই রোগের নানা অজানা, জিনগত কারণ থাকলেও একটি অন্যতম প্রধান কারণ হল অপুষ্টি। বিশেষ করে প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে। তাই আদিবাসী এলাকা, পশ্চাদ্পদ শ্রেণির মানুষের মধ্যে এই রোগ বেশি।

আরও পড়ুন-নয়া আবগারি নীতির প্রস্তাব বয়সসীমা ২৫ থেকে কমিয়ে ২১, রাজস্বের লোভে তরুণদের মদ্যপানে উৎসাহ দিচ্ছে দিল্লির বিজেপি সরকার

উপসর্গ
হাত এবং পায়ের আঙুলে ফোলাভাব। শরীরে অক্সিজেন পৌঁছয় না ফলে প্রচণ্ড ক্লান্তি।
বুক, পেট, হাড়ে, অস্থিসন্ধিতে তীব্র ব্যথা ও শ্বাসকষ্ট।
ত্বক হলদেটে ভাব, চোখ, মুখে হলদেটে ভাব।
ঘন ঘন সংক্রমণ।
ঘন ঘন জ্বর আসা।
রক্তাল্পতা বা অ্যানিমিয়া।
চোখের সমস্যা।
হার্টবিট বাড়া-কমা বা অনিয়ন্ত্রিত হৃদস্পন্দন।
মস্তিষ্কে রক্তনালি বন্ধ হয়ে স্ট্রোকের সম্ভাবনা।
পরীক্ষা-নিরীক্ষা
সিকল সেল অ্যানিমিয়া এমন একটি বিরল রোগ যা থেকে আরও নানা রোগের জন্ম হয়। প্লীহা শুকিয়ে যেতে পারে, বুকে ব্যথা হতে পারে, স্ট্রোক, অ্যাকিউট চেস্ট সিনড্রোম, অন্ধত্ব, গলব্লাডারে স্টোন, পায়ের আলসার, থ্রম্বোসিস বা রক্ত জমাট বাঁধা, গর্ভকালীন নানা জটিলতা আসতে পারে। তাই এর চিকিৎসা জরুরি। তার আগে দরকার ঠিকমতো ডায়গনোসিস। এক্ষেত্র কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট, সেরাম বিলিরুবিন, ইউরিন অ্যানালিসিস, প্লেটলেট কাউন্ট এছাড়া রয়েছে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ টেস্ট।
চিকিৎসা
অ্যান্টিবায়োটিক দেন চিকিৎসক রোগের মাত্রা বুঝে। স্টেম সেল ট্রান্সপ্লান্টেশন করা যেতে পারে, অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনে রোগের ট্রিটমেন্ট হতে পারে, ব্লাড ট্রান্সফিউশনের মাধ্যমে রক্তে লোহিত রক্তকণিকার মাত্রা বাড়িয়ে এই রোগের চিকিৎসা করা হয়। নিয়মিত চোখের পরীক্ষা দরকার। প্রচুর জল খেতে বলা হয় রোগীকে। এর পাশাপাশি সঠিক ডায়েট জরুরি। এই রোগের সবরকম থেরাপিই খুব জটিল ও ব্যয়সাপেক্ষ।

Latest article