সাইনবোর্ড

সেই ঢাকা-বোর্ডের ওপর বসে দু’জন— কিক্কি আর কিচ্চি। একজোড়া পায়রা হলেও তাদের স্বভাব আর চিন্তা-ভাবনা সম্পূর্ণ ভিন্ন।

Must read

দেবাশিস চক্রবর্ত্তী
নিউ টাউনের এক মেঘলা সকালে আঠারোতলা বাজার যাবার ২৯৭ নম্বরের রাস্তাটি যেন অস্বাভাবিক নীরব। সবেমাত্র বাদলা রাতের ঘুম ভেঙেছে নতুন শহর, তার ব্যস্ততার সুর এখনও শোনা যায়নি। পথের ধারে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা ভিজে লোহার ব্যারিকেডগুলো যেন একদল নিঃশব্দ প্রহরীর মতো পথ আগলে রেখেছে। তাদের দুধসাদা ফলকে ঝকঝক করছিল— ‘ট্রাফিক পুলিশ’। আর ঠিক তাদের পাশেই এক রহস্যে মোড়া সাইনবোর্ড, যা পুরো ডিডি ব্লকের কৌতূহলকে হলুদ কাপড়ে ঢেকে রেখেছিল। ঠিক কী লেখা রয়েছে তার নিচে, তা জানা অসম্ভব।
সেই ঢাকা-বোর্ডের ওপর বসে দু’জন— কিক্কি আর কিচ্চি। একজোড়া পায়রা হলেও তাদের স্বভাব আর চিন্তা-ভাবনা সম্পূর্ণ ভিন্ন।
কিক্কি একটু ভাবুক স্বভাবের, যেন এক নির্জন ধ্যানী। তার মনটা প্রায়ই গভীর চিন্তায় মগ্ন। শহরের এই নতুন রূপ, তার চারপাশে মানুষের নিত্যনতুন নির্মাণ, এইসব তাকে ভাবায়। মাঝে মাঝেই ভাবে, মানুষেরা কেন এত নিয়ম বানায়? এত কিছু লিখে রাখার প্রয়োজন হয় কেন? আমাদের জীবনে তো কোনও লেখা নেই— তবু তো দিন চলে, ঋতু আসে, ডিম ফেটে ছানা বেরোয়, আর আমরা মুক্ত আকাশে ডানা মেলি। এই পাখনাবিহীন মানুষ নামের প্রাণীদের কর্মকাণ্ড তার কাছে সবসময়ই এক অদ্ভুত ধাঁধার মতো মনে হয়। এত ব্যস্ততা, এত নিয়ম-কানুন, এত লেখা আর নির্দেশনা— এসবের শেষ কোথায়?
আরও পড়ুন-দিনের কবিতা
কিচ্চি তার সম্পূর্ণ বিপরীত। সে চঞ্চল, প্রাণোচ্ছল, কৌতূহলী। তার চোখে সবসময় নতুনের খোঁজ। সে জানে কোথায় নতুন পাখির দল এসেছে, কোন গাছে মৌসুমি ফুল ফুটেছে, কোন ছাদের কোণে শুকনো ধানের চিটে পড়ে আছে। তার জগৎটা শুধু চোখে দেখা আর কানে শোনাতেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং গন্ধ শুঁকে, ডানায় বাতাস মেপে, প্রকৃতির প্রতিটি ইশারাকে সে অনুভব করতে পারে। তার কাছে জীবনের মানে হল গতি, ছন্দ এবং নিরন্তর নতুনকে আবিষ্কার করা।
ওরা শহরে জন্মেছিল ঠিকই, কিন্তু শহর যেন ওদের নিজস্ব নয়। ওদের নিজস্ব এক জগৎ আছে— গাছের ডালে, ছাদের কার্নিসে, বিদ্যুতের তারে। ওদের জগৎটা শীতল বাতাস, ডানার বিস্তার আর নিজেদের একান্ত ভাষার অশব্দ সুরে ভরা। ওরা জানে, হাটগাছার কোন বাড়ির ছাদে এখনও কাপড় শুকোতে দেওয়া হয়, জোতভিমের কোন পাড়ার গলিতে ধান সিদ্ধ করার গন্ধ ভেসে আসে, কোঁচপুকুরের কোন মাঠে গাছের ছায়ায় কোকিল নিজস্ব সুরে গান গায়। এটাই তাদের মানচিত্র— নির্বাক অথচ নির্ভুল, যা কোনও কাগজে আঁকা নেই, বরং অনুভবের রঙে আঁকা।
সকালটা আজ একটু বেশিই নীরব। মানুষের কোলাহল নেই বললেই চলে। শহরের ঘুমন্ত প্রাণ এখনও জেগে ওঠেনি। এই নির্জনতায় কিক্কি কিচ্চিকে জিজ্ঞেস করল, ‘কিচ্চি, কখনও ভেবেছিস, ঐ হলুদ কাপড়ের নিচে কী লেখা আছে?’
কিক্কির এই প্রশ্নে কিচ্চি হালকা অবাক হল— ‘ওসব লেখা তো মানুষের জন্য, কিক্কি। ওরা কথা লেখে, কথা পড়ে, কথা বোঝে। আমরা তো শুনি হাওয়া, দেখি আলোছায়া, শুঁকি গন্ধ। চল বরং ঐ গাছটায় বসি— রোদটা উঠছে, পাতাগুলো কেমন চকচক করছে দেখ!’ কিচ্চির কাছে মানুষের এই রহস্যময় লেখালেখি কোনও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ই নয়। তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হল প্রকৃতির নিজস্ব ভাষা— রোদের উষ্ণতা, পাতার নড়াচড়া, বাতাসের শব্দ।
কিক্কি মৃদু হাসল। কিচ্চির চোখে সবকিছু কত সরল! তবু তার মনে হয়, ওদের জীবনেও তো রহস্য আছে— ডিম ফেটে নতুন প্রাণ বেরিয়ে আসে, কুয়াশায় পথ চিনতে হয়, ঝড়ে আশ্রয় খুঁজে নিতে হয়— এসব তো কোনও বইয়ে লেখা থাকে না। তবু তারা নিজেদের অভিজ্ঞতা দিয়ে শিখে নেয়, বুঝে নেয়। শেখার প্রক্রিয়াটা মানুষের মতো প্রাতিষ্ঠানিক নয়, প্রকৃতি-নির্ভর আর স্বতঃস্ফূর্ত।
এই ভাবনাগুলো যখন কিক্কির মনে নিজের ভাষায় ঘুরপাক খাচ্ছিল, ঠিক তখনই দূর থেকে একটি গাড়ির হর্ন ভেসে এল। কিচ্চি চমকে উঠল, ‘কিক্কি, গাড়ি আসছে!’ দুজনেই তৎপর— প্রয়োজনে যে কোনও মুহূর্তে ডানা মেলবে। মন সজাগ, শরীর উড়ান দেওয়ার জন্য প্রস্তুত।
গাড়িটি এসে ব্যারিকেডের সামনে থামল। গাড়ি থেকে এক লোক নামল। তার হাতে একটি টুলবক্স। সে সরাসরি সাইনবোর্ডের কাছে গিয়ে হলুদ কাপড় সরিয়ে ফেলল। কিক্কি বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। লেখাটা এখন স্পষ্ট, এক পথচলতি লোক সাইনবোর্ড পড়ে বলল, ‘‘ওহ্, রাস্তা সারাইয়ের কাজ চলছে। ‘সাময়িকভাবে’ পথ বন্ধ।’’
‘সাময়িকভাবে’ কথাটা না বুঝলেও কিক্কি মনে মনে হাসল। এত আয়োজন, এত গোপনীয়তা, আর শেষে কী সাধারণ একটি কথা! মানুষের জগৎটা যেন অকারণ জটিলতায় ভরা। একটা সামান্য কাজের ঘোষণা দেওয়ার জন্য এত কিছু! তাদের জগতে এমন কিছু হলে তারা শুধু একটি ইঙ্গিত দিত— একটি নির্দিষ্ট সতর্কবার্তা, যা প্রতিটি পাখি তার নিজের মতো করে বুঝে নিত। কোনও লিখিত বিবৃতির প্রয়োজন হত না।
ততক্ষণে কিচ্চি উড়ে গেছে পাশের নিউ টাউন স্কুলের গার্ডরুমের ছাদের দিকে— সেখানে কেউ টুকরো করে রুটি ছড়িয়ে দিয়েছে। কিচ্চির গন্ধ শোঁকার দক্ষতা তাকে ভুল পথে চালিত করেনি। কিক্কি একটু পরে আকাশে ডানা মেলে। তার মন এখন হালকা। মেঘের ফাঁক গলে রোদ উঠছে ধীরে ধীরে। কিক্কির মনেও যেন এক আলোর রেখা ফুটে উঠেছে।
উড়তে উড়তে সে ভাবে— মানুষের আছে লেখার মতো ভাষা, নিয়ম, বিজ্ঞপ্তি। আর ওদের আছে প্রাকৃতিক অভিজ্ঞতা, ডানার স্বাধীনতা, অন্তর্দৃষ্টি। একটা পাতার নড়াচড়া বলে দেয় বৃষ্টির পূর্বাভাস, একটা কর্কশ শব্দ বলে দেয় বিপদের সঙ্কেত। কাউকে কিছু লিখে দিতে হয় না। প্রতিটি পায়রা জানে, কখন কোথায় যেতে হবে, কখন আশ্রয় নিতে হবে।
শহর মানুষের হয়ে গেলেও, আকাশটা তো আজও ওদের। এই আকাশেই তারা থাকবে— কিক্কি, কিচ্চি, আর তাদের মতো আরও অগণিত পাখি— নির্বিচারে, নিবিঘ্নে, ডানায় ভর করে।
কিক্কির এই ভাবনা থেকেই সে সাইনবোর্ডটির দিকে এক নতুন দৃষ্টিতে তাকায়। সাইনবোর্ডটি যেন এখন শুধু একটি মানুষের লেখা নির্দেশ নয়, বরং এটি তাদের জীবনেরও এক অংশ হয়ে উঠেছে। এটি তাদের প্রতিদিনের কৌতূহলের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ছিল, রহস্য উন্মোচন হল আজ। হলুদ কাপড়ের নিচে কী লেখা আছে, তা জানার আকাঙ্ক্ষা তাদের সকালকে একটি নতুন অর্থ দিয়েছিল। এখন যখন লেখাটা স্পষ্ট, তখন তাদের মনে হল, এই সাইনবোর্ডটি যেন তাদের জীবনের একখানা অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘোষণা করল।
কিচ্চি ছাদ থেকে ফিরে এসে সাইনবোর্ডের ওপর বসতেই কিক্কি তার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘দেখলি কিচ্চি, মানুষেরা কত সামান্য কথাকে কত বড় করে তোলে। আমাদের জীবন কত সহজ, তাই না?’
কিচ্চি মাথা নেড়ে সায় দিল। তার চোখ তখন স্কুলের পাশের পার্কের প্রায় শুকিয়ে যাওয়া কৃষ্ণচূড়ায় নতুন গজানো ছোট্ট শাখার দিকে। তার কাছে নতুন জীবন, নতুন ফুল, নতুন খাবার— এসবই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সাইনবোর্ড তার কাছে শুধু এক উঁচু জায়গা, যেখানে বসে চারপাশের জগৎ দেখতে পায়।
কিন্তু কিক্কির কাছে ব্যাপারটা একটু আলাদা। তার কাছে এই সাইনবোর্ড মানুষের জটিলতার প্রতীক। এখন উন্মোচিত রহস্য আরও গভীর চিন্তার খোরাক। সে ভাবল, আমরা তো উড়েই চলে যেতে পারি। কিন্তু মানুষেরা এই ব্যারিকেড আর সাইনবোর্ডের জালে আটকা পড়ে থাকে।
দিনের আলো বাড়তেই শহর তার স্বাভাবিক রূপ নিয়ে নিল। গাড়ির ভিড়, মানুষের ব্যস্ততা। ব্যারিকেডগুলো তাদের কাজ শুরু করল, আর সাইনবোর্ডটি তার নতুন নির্দেশ নিয়ে স্থির হয়ে রইল। কিক্কি আর কিচ্চি তাদের জায়গাটা থেকে উড়ে গিয়ে পাশের গাছের ডালে আশ্রয় নিল। সেখান থেকে তারা দেখল, মানুষেরা কীভাবে সেই সাইনবোর্ডের নির্দেশ মেনে তাদের পথ বদলাচ্ছে।
কিক্কির মনে হল, হয়তো তাদের জীবনও এই সাইনবোর্ডটির মতো। প্রকৃতির কোনও এক অদৃশ্য শক্তি তাদের গতিপথ নির্ধারণ করে দেয়—কখন ডানা মেলতে হবে, কখন ফিরতে হবে নীড়ে। কিন্তু মানুষ আর তাদের মধ্যে পার্থক্য হল, মানুষেরা এই নির্দেশ লিখে রাখে, আর তাদের নির্দেশ লেখা থাকে সেই প্রকৃতিরই হৃদয়ে।
দুপুরবেলায়, রাস্তার কাজের গর্জন শহরের নীরবতাকে ছিঁড়ে ফেলছে, হঠাৎ এক ভারী লোডার সোজা গিয়ে ধাক্কা মারল সেই সাইনবোর্ডের বাঁ পাশে। আঘাতটা খুব বড় না হলেও সাইনবোর্ড হেলে পড়ল একপাশে— শব্দের তলার পাতলা পাতগুলো সামান্য বেঁকে গেল, ফলকের নিচের কোণে ছেঁড়া কাপড়ের টুকরোটা বাতাসে দুলতে লাগল অস্থিরভাবে। দূরে দাঁড়িয়ে থাকা কিক্কি ও কিচ্চি দু’জনেই যেন এক অজানা ধাক্কায় কেঁপে উঠল। সাইনবোর্ড আর মানুষের বস্তু মনে হল না— বরং যেন কোনও জীবন্ত স্মৃতি, ভাষায় নয়, অনুভবে গাঁথা। কিক্কি বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে থাকল! কিচ্চির চোখে জল জমেনি, ডানার নড়াচড়া থেমে গেল কিছু সময়ের জন্য।
শেষ পর্যন্ত, সাইনবোর্ডটা শুধু রাস্তা তৈরির ঘোষণা হয়ে রইল না, বরং হয়ে উঠল মানুষের আর পাখির যৌথ জীবনযাত্রার এক নীরব সাক্ষী। কিক্কি আর কিচ্চি প্রতিদিন সকালে হয়তো সেই দোমড়ানো সাইনবোর্ডের দিকে তাকাবে, কিন্তু তারা জানে, তার রহস্য আর তাদের কাছে অজানা নয়। এ তাদের জীবনের অংশ— যেখানে এক নতুন সকালের জন্ম হয়, এক নতুন দিনের সূচনা হয়। তাদের মনে করিয়ে দেয়, মানুষের জটিলতার মধ্যেও তাদের নিজস্ব সরলতা কত মূল্যবান। এই সাইনবোর্ড, যা একদিন মানুষের তৈরি এক বাধা ছিল, তা আজ কিক্কি আর কিচ্চির কাছে জীবনের এক গভীর দর্শন।
অঙ্কন : শংকর বসাক

Latest article