জন্মশতবর্ষে গায়ক ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য

তিনি মৃত্যুঞ্জয়। শতবর্ষে কিংবদন্তি শিল্পী ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের উদ্দেশে শ্রদ্ধার্ঘ্য জানালেন ড. শঙ্কর ঘোষ

Must read

বালির রিভার্স টম্পসন স্কুলের ছাত্রটি স্কুলের বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে গান গাইবে। উত্তরপাড়ার রাজবাড়িতে আয়োজিত ঐ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি শরৎচন্দ্র। দুটি গান গাইবার সুযোগ পেয়েছিল ছাত্রটি। ‘পাগলা মনটারে তুই বাঁধ’ অপরটি ‘ভাইয়ের দোরে ভাই কেঁদে যায়’। গান শেষ হলে প্রবল হাততালিতে মুখর হল রাজবাড়ি। শরৎচন্দ্র আসন ছেড়ে উঠে এসে বালকটিকে আশীর্বাদ করে পুরস্কারস্বরূপ তুলে দিয়েছিলেন ৫ টাকার একটি নোট। সেই বালকটি পরবর্তীকালে বাংলার অন্যতম সেরা গায়ক হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। তাঁর নাম ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য (Dhananjay Bhattacharya)। জীবনে প্রচুর পুরস্কার পেয়েছেন কিন্তু শরৎচন্দ্রের হাত থেকে পাওয়া ৫ টাকার নোট তাঁর সারা জীবনের সেরা পুরস্কার বলে মনে করতেন ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য।

সেই ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের (Dhananjay Bhattacharya) জন্ম ১৯২২ সালের ১০ সেপ্টেম্বর রবিবার। বাবা সুরেন্দ্রনাথ, মা অন্নপূর্ণা। অষ্টম গর্ভের সন্তান ছিলেন ধনঞ্জয়। এই বিশ্বাস লোকের আছে অষ্টম গর্ভের সন্তান নাকি অসাধারণ ক্ষমতার অধিকারী হয়। ধনঞ্জয়ের জীবনে তা সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছিল। মোট ১১টি ভাই-বোন। তাঁর আরেক ভাই পান্নালাল ভট্টাচার্য শ্যামাসংগীত জগতের এক দিকপাল শিল্পী। সুরেন্দ্রনাথের অকস্মাৎ মৃত্যুতে অথৈ জলে পড়েছিলেন অন্নপূর্ণা দেবী। কিন্তু হাল ছাড়েননি। খুব কষ্ট করে সংসারটাকে দাঁড় করিয়েছিলেন। দারিদ্র্যকে ছোটবেলায় খুব কাছাকাছি দেখেছিলেন ধনঞ্জয়। স্কুলের স্যারেরা খুবই ভালবাসতেন। সুধাংশু স্যার একদিন প্রস্তাব দিলেন, ‘তুমি গান শিখবে?’ মায়ের অনুমতি পাওয়া গেল। নিয়মিত স্যারের সাইকেলে চেপে গান শিখতে যেতেন। উচ্চাঙ্গ সংগীতের তালিম নিলেন গোকুল নাগের কাছে। এছাড়াও শিখলেন সত্যেন ঘোষালের কাছে। তাঁর এই শাস্ত্রীয় সংগীতের প্রভাব ধনঞ্জয়ের জীবনে গভীরভাবে ছাপ ফেলেছিল। ‘ঢুলি’ ছবির ‘ত্রিনয়নী দুর্গা’ কিংবা বেসিক রেকর্ডে ‘ঝনন ঝনন বাজে সুর বাহারে’ বা ‘রুমা ঝুমা ঝুম বাদল ঝরে’ গানগুলির মধ্যে।

আরও পড়ুন: মহানায়কের বায়োপিক অচেনা উত্তম

সংগীতে চলার পথ সর্বদাই মসৃণ হয়নি। তরুণ বয়সে ধনঞ্জয় (Dhananjay Bhattacharya) অডিশন দিতে হাজির হলেন হিন্দুস্তান রেকর্ড কোম্পানিতে। অডিশনের দায়িত্বে থাকা কুন্দনলাল সায়গলের পছন্দ হল না ধনঞ্জয়ের গান। ‘জীবন সঙ্গিনী’ ছবিতে গাইবার সুযোগ পেলেন। তাঁর সহশিল্পী শচীন দেববর্মন, যাঁকে নিজের আদর্শ বলেই মানতেন। শচীনকর্তা ধনঞ্জয়কে বললেন ‘বাংলা গান গাইতাছ দরদ নাই ক্যান? বাংলা গান গাইবার কায়দাই শিখ নাই।’ প্রচণ্ড অনুশীলনের মধ্য দিয়ে ধনঞ্জয় নিজেকে তৈরি করতে লাগলেন। সুযোগ এল ইউনিভার্সিটি ইনস্টিউট হলে গান গাইবার। মূল আকর্ষণ শচীন দেববর্মন। ধনঞ্জয় যখন গাইছেন তখন শচীনকর্তা হাজির হয়ে গেছেন। উইংসের পাশে দাঁড়িয়ে তিনি গান শুনলেন। গান শেষ হলে শচীনকর্তা জড়িয়ে ধরে স্নেহভরে বলেছিলেন, ‘গলাডারে রাইখো ধনঞ্জয়।’
মাকে প্রণাম করে রেডিওতে প্রথম গান গাইতে গেলেন ১৯৩৮ সালে। গানটি হল ‘জোছনা রাতে কেন ডাকে বাঁশী’। সেই শুরু। তারপর বহু বছর আকাশবাণীতে সংগীত পরিবেশন করেছেন। ‘জীবনসঙ্গিনী’র পর আলেয়া ছবিতে সুযোগ পেলেন। তাঁর গাওয়া ‘মাটির এ খেলাঘর’ গানটি অভূতপূর্ব সাড়া ফেলে দিয়েছিল। চমকে দিলেন ‘শহর থেকে দূরে’ ছবির গানে। ‘রাধে ভুল করে তুই চিনলি না তোর প্রেমিক শ্যামরায়’ লোকের মুখে মুখে ফিরল সেই গান। আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি ধনঞ্জয়কে। ‘তানসেন’ ছবির কাজ চলছে পুরোদমে। রবীন চট্টোপাধ্যায় একটি জটিল গান গাওয়ালেন ভীমসেন যোশীকে দিয়ে। পছন্দ হয়নি সুরকারের। ডেকে পাঠালেন ধনঞ্জয়কে। কয়েক দিনের অনুশীলনের পর রেকর্ডিং। মুগ্ধ সুরকার বুকে জড়িয়ে ধরলেন ধনঞ্জয়কে। ‘মহাপ্রস্থানের পথে’ ছবিতে সুরকার পঙ্কজকুমার মল্লিক একটি গান ‘তু ঢুঁঢতা হ্যায়’ নিজে কয়েকবার গেয়ে তোলালেন ধনঞ্জয়কে। রেকর্ডিং হল। পূর্ণ সিনেমা হলে নিউ থিয়েটার্সের কর্তাব্যক্তিরা গান শুনে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেন। ‘মাথুর’ ছবির গান রেকর্ডিং। এমপি স্টুডিওতে। সুরকার পণ্ডিচেরির বিখ্যাত সংগীতসাধক দিলীপকুমার রায়। গানটি গাইলেন পুরোপুরি দিলীপকুমার রায়ের ঢঙে। রাইচাঁদ বড়ালের সুরে ‘স্বামীজী’ ছবিতে ধনঞ্জয় গাইলেন ‘যাবে কি হে দিন আমার’। গানটি আজও শ্রোতারা মনে রেখেছেন। ‘রানী রাসমণি’ ছবিতে অনিল বাগচীর সুরে গাওয়া দুটি গান (গঙ্গা প্রভাসাদি এবং কোন হিসেবে হর দাঁড়িয়েছ মা পদ দিয়ে) অভূতপূর্ব। ‘মহাকবি গিরিশচন্দ্র’ ছবিতে তাঁর গাওয়া ‘নদে টলমল করে’ গান আজও স্মরণীয়। ‘সাহেব বিবি গোলাম’ ছবি ‘তীর মারে তীরন্দাজ’ কালজয়ী হয়ে আছে। এই একই কথা প্রযোজ্য ‘নবজন্ম’ ছবির ‘আমি আঙ্গুল কাটিয়া কলম বানাই’ সম্পর্কেও।
শ্রীমতী পিকচার্সের প্রায় সব ছবিতেই ধনঞ্জয় (Dhananjay Bhattacharya) গান গেয়েছেন। ‘মেজদিদি’ ছবির গান রেকর্ডিং চলছে। কালীপদ সেনের সুরে ধনঞ্জয় গাইলেন ‘জনম মরণ পা ফেলা’ গানটি। নামভূমিকার শিল্পী কাননদেবী আরেকবার গানটির রেকর্ডিং করতে বললেন। সাধারণত রিটেক করতে হয় না ধনঞ্জয়কে। তিনি গাইলেন। মুগ্ধ কাননদেবীর স্বীকারোক্তি ‘দুবারই একই রকম লাগল গানটি’। ছবিতে আরও কয়েকটি বিখ্যাত গানের উল্লেখ করা যায়। ‘চন্দ্রনাথ’ ছবিতে ‘স্মৃতির বাঁশরী’, ‘বড়দিদি’ ছবিতে ‘ও দয়াল গো’, ‘শিল্পী’ ছবিতে ‘বন্ধুরে তুমি বিহনে’, ‘রাজা কৃষ্ণচন্দ্র’ ছবিতে ‘মন রে কৃষিকাজ জানো না’, ‘সাধক বামাখ্যাপা’ ছবিতে ‘কোন গুণে তুই গুণময়ী’, ‘সাধক কমলাকান্ত’ ছবিতে ‘শ্যামাধন কি সবাই পায়’, ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবিতে ‘এ-মায়া প্রপঞ্চময়’, ‘দেবীতীর্থ কামরূপকামাখ্যা’ ছবিতে ‘আমার মায়ের নামটি দয়াময়ী’, ‘চারণকবি মুকুন্দদাস’ ছবিতে ‘গোঠে আমি যাব মাগো’, ‘ঢুলি’ ছবিতে ‘ভাঙনের তীরে ঘর বেঁধে কিবা ফল’ উল্লেখযোগ্য কিছু গান। ‘পাশের বাড়ি’ ছবিতে সলিল চৌধুরির সুরে তাঁর গাওয়া ‘ঝির ঝির ঝির ঝির বরষা’ গানটি সে-যুগের তরুণ-তরুণীদের মুখে মুখে ফিরত। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে একটি ছবিতে তিনি গেয়েছেন। ছবির নাম ‘বাদশা’। গানটি হল ‘ও তুই ঘুমের ঘোরে থাকবি কত আর’— আরেকটি কালজয়ী গান। আরেকটি গান শ্রোতারা ভুলতে পারবেন না ‘বাবলা’র ছবিতে তাঁর গাওয়া ‘জীবন পারাবারের মাঝি’। এ-ছাড়াও যেসব ছবিতে তিনি গেয়েছেন তার মধ্যে আছে স্বয়ংসিদ্ধা, সাত নম্বর বাড়ি, বিষ্ণুপ্রিয়া, শ্বশুরবাড়ি, লেডিস সিট, ভগবান শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য, সাড়ে চুয়াত্তর, পরেশ, বৃন্দাবন লীলা, শ্রীশ্রীনিত্যানন্দ মহাপ্রভু, ঠাকুর হরিদাস, নববিধান প্রভৃতি ছবি। ছবির সুরকার হয়েছেন তিনি বারকয়েক। ‘জয় মা তারা’ ছবি তিনি সুরকার। ‘লেডিস সিট’ ছবির তিনি সুরকার। ‘বাতাসি’ ছবির তিনি অন্যতম সুরকার। ছায়াছবিতে কণ্ঠদানের পাশাপাশি কয়েকটি ছবিতে তিনি অভিনয় করেছেন। সেই তালিকায় আছে পাশের বাড়ি, লেডিস সিট, শ্বশুরবাড়ি, নববিধান প্রভৃতি। কাননদেবীর অনুরোধেই তিনি ‘নববিধান’ ছবিতে অভিনয় করেছিলেন।
বোম্বে থেকে ডাক পেয়েছেন বহুবার। ফিরিয়ে দিয়েছেন বারংবার। শচীন দেববর্মন, সলিল চৌধুরি-সহ বহুজনের অনুরোধ রাখেননি। কিন্তু একবার বম্বেতে যেতেই হল। রাইচাঁদ বড়ালের কাছ থেকে তার পেয়ে ছুটে গিয়ে জানলেন হিন্দি ‘মহাপ্রভু চৈতন্য’ ছবির গান তাঁকেই গাইতে হবে। প্রথমে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। কিন্তু রাইচাঁদের অন্তরের বেদনা বুঝতে পেরে অবশেষে সম্মত হলেন। কলকাতায় তৈরি কয়েকটি হিন্দি ছবিতে তিনি অবশ্য গেয়েছেন। তার মধ্যে রয়েছে ‘ঝুটি কসমে’। ‘হুয়া নাদান রে’ গানটি তিনি গাইলেন ‘কস্তুরী’ ছবিতে পঙ্কজকুমার মল্লিকের সুরে। ‘বিদ্যাপতি’ ছবিতে গাইলেন ভি বালসারার সুরে। বিজন পালের সুরে গাইলেন ‘এক সুরত দোল দিল’ ছবিতে।
বেসিক রেকর্ডে তাঁর গাওয়া প্রচুর গান আছে। তার মধ্যে মনে পড়ে যায় যে গানগুলি, তার উল্লেখ করছি মাত্র। শূন্য ঘরে ফিরে এলাম যেই, এই মাটিতে জন্ম নিলাম মাটি তাই রক্তে মিশেছে, যদি ভুলে যাও মোরে, কাল সারারাত চোখে ঘুম ছিল না, জল ভরো কাঞ্চনকন্যা, ঝানানা ঝানানা বাজে, দোলে শাল পিয়ালের বন, ভুলিতে দিব না আমারে প্রভৃতি গানগুলি। রবীন্দ্রসংগীতও গেয়েছেন তিনি। ‘নিভৃত প্রাণের দেবতা’, ‘বিশ্ব যখন নিদ্রামগন’, ‘এবার নীরব করে দাও হে তোমার’ প্রভৃতি গানগুলি। নজরুলের যে গানগুলি তিনি গেয়েছেন তার মধ্যে রয়েছে ‘চিরদিন কাহারো সমান নাহি যায়’, ‘জগতের নাথ কর পার’, ‘কোথায় তুই খুঁজিস ভগবান’ প্রভৃতি।

১৯৯২ সালের পয়লা জানুয়ারি দক্ষিণেশ্বরে কল্পতরু উৎসবে যখন গান গাইতে যান তখনই শারীরিক অবস্থা খুব খারাপ। চিকিৎসা বাড়িতেই চলছিল। ডায়াবেটিক নেপ্রোপ্যাথি। শেষ পর্যন্ত ওই বছরের ১৮ ডিসেম্বর উত্তর কলকাতার এক নার্সিংহোমে ভর্তি করানো হয় তাঁকে। যমে-মানুষে টানাটানি। শেষে ২৭ ডিসেম্বর রবিবার সন্ধ্যা সাতটায় তাঁর জীবনদীপ নির্বাপিত হয়। তাঁর মতো শিল্পীর মৃত্যু নেই। তিনি মৃত্যুঞ্জয়। শতবর্ষে এই কিংবদন্তি শিল্পীর উদ্দেশে রইল আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম। কামনা করছি তাঁর গাওয়া গানগুলি সংরক্ষিত করা হোক। শতবর্ষে সেটাই হবে প্রকৃত শ্রদ্ধাঞ্জলি।

Latest article