দু’দিকে সাদা বরফ-ঘেরা পাহাড়, আর মাঝখান দিয়ে পাহাড়ি রাস্তা। রাস্তার পাশ দিয়ে কলকল শব্দে বয়ে চলেছে এক পাহাড়ি নদী, অনেকটা যেন আমাদের ছোটবেলায় আঁকা সেই ছবির মতো লাগছিল। এমন একটা জায়গায় যাওয়ার স্বপ্ন মনে লালিত হয়েছে দীর্ঘদিন। মনে মনে চেয়েছিলাম এমন একটা ডেস্টিনেশন যেখানে শুধুই বরফ আর বরফ। যেমন ভাবা ঠিক তেমনই কাজ। বেছে নিয়েছিলাম হিমাচলের অফবিট ডেস্টিনেশন সিসু ভিলেজকে (Sissu village)।
যাত্রা শুরু : আগের দিন রাত্রিবেলায় আমরা এসে পৌঁছেছিলাম মানালিতে। রাতে পাহাড়ের গায়ে অসংখ্য আলোকবিন্দু চোখে পড়েছিল, মনে হচ্ছিল টুনি বাল্ব দিয়ে কেউ যেন সাজিয়ে দিয়েছে পাহাড়টাকে। রাত শেষ হয়ে যখন ভোরের আলো ফুটল, ব্যালকনি থেকে চোখের সামনে ভেসে উঠল সাদা বরফের চূড়া, মনটা নেচে উঠল। কারণ আর কিছুক্ষণ পরেই আমরা আমাদের ডেস্টিনেশনের দিকে যাত্রা শুরু করব। দূর থেকে দেখা বরফের মধ্যে আমরা হারিয়ে যাব। সকাল-সকাল সিসু ভিলেজের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেলাম। কিছুদূর যাওয়ার পরে আমাদের গাড়ি একটা দোকানের সামনে দাঁড়াল। ওখানে সার বেঁধে পরপর বহু দোকান আছে। যেখানে বরফে চলাফেরা করার জন্য জুতো এবং পোশাক ভাড়া দেওয়া হয়। আমরা ওখানেরই একটা দোকান থেকে বরফে চলাফেরার জন্য জুতো এবং পোশাক ভাড়া নিলাম। এরপর আমাদের আবার পাহাড়ি রাস্তা ধরে পথচলা শুরু হয়ে গেল। অনেকটা সময় চোখের নিমেষে কীভাবে কেটে গেল বুঝতেই পারলাম না। অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দিক থেকে চোখ ফেরানো দায়, আর সেইসব সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতেই আমরা পৌঁছে গেলাম সিসু ভিলেজে।
এক টুকরো স্বর্গ : সিসু ভিলেজের ভিউ পয়েন্টে যখন নামলাম, মনে হল আমরা স্বর্গে পৌঁছে গিয়েছি, অদ্ভুত সৌন্দর্যে মোড়া সেই ডেস্টিনেশন। চারিদিকে সাদা বরফ ছেয়ে রয়েছে, এই সিসু ভিলেজের পাশ দিয়ে এই বয়ে চলেছে চন্দ্রা নদী। যেহেতু আমরা ডিসেম্বরে গিয়েছিলাম সেহেতু সেই সময় নদীর জলের উপরের অংশও বরফে পরিণত হয়েছিল।
সিসু ভিলেজে অবস্থিত লাহুল স্পিতির মাউন্টেন রেঞ্জ অপূর্ব সুন্দর। এই রেঞ্জের একদিকে যেমন বরফে ঢাকা তেমনই অন্যদিকে একদম ডেড মাউন্টেন অর্থাৎ বরফবিহীন পর্বত। এর সৌন্দর্য সত্যিই একটা অন্য মাত্রা এনে দেয় এই সিসু ভিলেজে। সিসু ভিলেজে (Sissu village) গেলে সৌন্দর্যের পাশাপাশি দেখা যেতে পারে সিসু লেক, চন্দ্রা নদী, সিসু ওয়াটার ফলস ইত্যাদি।
সিসু লেক : এই লেক লাহুল স্পিতি মাউন্টেন রেঞ্জের পাদদেশে চন্দ্রা নদীর বাঁকে অবস্থিত। এটি মানুষের দ্বারা তৈরি একটি লেক। একটা সময় এই লেকটি সবুজ শ্যাওলা গায়ে জড়িয়ে অবহেলিত অবস্থায় পড়ে থাকত। কিন্তু বর্তমানে এই লেকের জল এতটাই টলটলে যে দেখলে মনে হবে কেউ যেন একটা বিরাট আয়না রেখে দিয়েছে। ট্যুরিস্টদের আকর্ষণ করার জন্য এই লেকে বোটিংয়ের ব্যবস্থা করা আছে। এই লেকে শীতকালে অনেক সাইবেরিয়ান হাঁস এবং মাউন্টেন ট্রাউট মাছের দেখা মিলবে। চন্দ্রা নদীতেও দেখা যায় এই মাছ।
সিসু জলপ্রপাত : সিসু লেকে বসেই উপভোগ করা যেতে পারে সিসু জলপ্রপাতের সৌন্দর্য। চন্দ্রা নদীর অপর পাড়ে অবস্থিত এই জলপ্রপাত। এখানে পৌঁছতে গেলে কিছুটা পথ ট্রেক করে যেতে হয়। যাঁরা অ্যাডভেঞ্চার পিপাসু তাঁরা ট্রেক করে পৌঁছে যেতে পারেন এই জলপ্রপাতের একদম কাছে। জলপ্রপাতের চারপাশে সবুজের সমারোহ মনকে সতেজ করে তোলে। দূর থেকেও জলপ্রপাতের সৌন্দর্য অনুভব করা যেতে পারে।
গিপান বা ঘেপান লেক : সিসু লেক ছাড়াও এখানে আরও একটি লেক আছে। যেটি আকার এবং গভীরতায় সিসু লেকের থেকে অনেক বড়। এই লেকটি পর্বতের উপরে অনেকটা উচ্চতায় অবস্থিত। প্রায় ১৪ হাজার ফুট উচ্চতায় অবস্থিত এই লেকটি দেখতে গেলে অবশ্যই ট্রেক করে পৌঁছতে হবে। এই লেকটির বিশেষত্ব হল লেকের মধ্যবর্তী অংশে একটি ছোট দ্বীপ রয়েছে আর সেখানে সুন্দর সুন্দর বুনো ফুল ফোটে, যেটা দেখতে লাগে অসাধারণ।
সিসু ভিলেজের আছে লর্ড গাইফাং (ঘেপান)-এর মন্দির। গাইফাংকে লাহৌল উপত্যকার প্রধান দেবতা বলে মনে করা হয় এবং এটিই একমাত্র মন্দির যা দেবতার উদ্দেশ্যে নিবেদিত। মন্দিরটি শুধুমাত্র লাহৌল উপত্যকার বাসিন্দাদের জন্য উন্মুক্ত আছে। কিন্তু পর্যটকদের এই মন্দিরের ভেতরে প্রবেশের অনুমতি নেই।
আরও পড়ুন- বিশ্বভারতীকে কেন্দ্র করে বাংলার হেনস্তা চাইছে বিজেপি, বললেন জহর
অ্যাডভেঞ্চার গেমে ভরপুর সিসু : এখানে গেলে নানা ধরনের অ্যাডভেঞ্চার গেম উপভোগ করা যায়। যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে স্কেটিং, জিপলাইন, ট্রেকিং, রিভার রাফটিং ইত্যাদি।
কীভাবে যাবেন সিসু?
মানালি থেকে সিসু ভিলেজে (Sissu village) পৌঁছতে গেলে অটল টানেল-এর মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। ৯ কিলোমিটার দীর্ঘ এই টানেলটি অসাধারণ। মানালি থেকে সিসু ভিলেজের দূরত্ব মাত্র ২৫ থেকে ৩০ কিলোমিটার। তাই সকালে বেরিয়ে সারাদিন কাটিয়ে আবার সন্ধ্যার মধ্যে মানালি ফিরে আসা যায়। তবে যাঁরা সিসু ভিলেজের রাতের সৌন্দর্য উপভোগ করতে চান অথবা বরফের চূড়ায় সূর্যের প্রথম কিরণের ছটা উপভোগ করতে চান, তাহলে অবশ্যই এক রাত্রি থাকা যেতে পারে এই সিসু ভিলেজে।
কীভাবে যাবেন মানালি?
কলকাতা থেকে সরাসরি মানালি যেতে ১২৩১১ কালকা মেল ধরে চণ্ডীগড়ে নামতে হবে । ট্রেনটি প্রতিদিন হাওড়া স্টেশন থেকে ছাড়ে। ফ্লাইটে দিল্লি গিয়ে যাওয়া যায়। চণ্ডীগড় থেকে গাড়ি ভাড়া করে সড়কপথে মানালি যাওয়া যাবে। এ ছাড়াও দিল্লি হয়ে মানালি যাওয়া যায়। দিল্লির কাশ্মীরি গেট বাস টার্মিনাল থেকে মানালি যাওয়ার বাস ছাড়ে। দিল্লি থেকে মানালি যেতে সড়কপথে প্রায় ১১-১৩ ঘণ্টা লাগে। এ ছাড়াও প্রাইভেট গাড়ি ভাড়া করে মানালি যাওয়া যায়।
কোথায় থাকবেন?
সিসু ভিলেজে থাকার জন্য আছে অনেক হোম-স্টে আর গেস্ট হাউস। তবে যাঁরা মানালি থেকে ঘুরতে চান তাঁরা অবশ্যই মানালিতে থাকতে পারেন। মানালিতে প্রচুর হোটেল আছে।