উঃ! এবার কি তবে কাদম্বিনী হতে হবে?

গদ্দার কুলের পোদ্দার, কাঁথির শন্তিকুঞ্জের মেজখোকা, কুভেন্দুর দেওয়া টার্গেট পূরণ করতে গিয়েই বোধহয় নির্বাচন কমিশনের খসড়া ভোটার তালিকায় অজস্র বৈধ ও জীবিত ভোটার মৃত বলে চিহ্নিত! তাড়াহুড়োর এসআইআর-এ এমন ভ্রান্তি স্বাভাবিক হতে পারে, তবে প্রশ্রয়যোগ্য নয়। সেইসঙ্গে মোদি এবং অমিত শাহের ঘুসপেটিয়ারা সব কোথায় গেল? লিখছেন, জানতে চাইছেন দেবু পণ্ডিত

Must read

রবীন্দ্রনাথের ‘জীবিত ও মৃত’ গল্পের শেষ অংশ মনে পড়ে?
সেটা এইরকম : “কাদম্বিনী ‘ওগো, আমি মরি নাই গো, মরি নাই গো, মরি নাই’— বলিয়া চীৎকার করিয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া সিঁড়ি বাহিয়া নামিয়া অন্তঃপুরের পুষ্করিণীর জলের মধ্যে গিয়া পড়িল। শারদাশংকর উপরের ঘর হইতে শুনিতে পাইলেন ঝপাস্‌করিয়া একটা শব্দ হইল।… কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিল, সে মরে নাই।”
পশ্চিমবঙ্গের ভোটারদের এখন কি তবে কাদম্বিনী হতে হবে, নির্বাচন কমিশনের সৌজন্যে!
কারণ ১ : ডানকুনির তৃণমূল কংগ্রেসের কাউন্সিলর সূর্য দে, দিব্যি বেঁচে আছেন, কিন্তু নির্বাচন কমিশনের কাছে তিনি মৃত! মঙ্গলবার সকালে কালীপুর শ্মশানে নিজেই হেঁটে চলে আসেন। বক্তব্য, একজন জনপ্রতিনিধিকেই যদি মৃত দেখানো হয় এ- ভাবে তবে লক্ষ লক্ষ সাধারণ মানুষকে তো সহজেই বাদ দিতে পারে কমিশন। সূর্য এনুমারেশন ফর্ম পূরণ করেছেন। জমা দিয়েছেন বুথস্তরের আধিকারিকের (বিএলও) কাছে। তার পরেও এমন ভাবে তাঁকে ‘মৃত’ দেখানোর কারণ কী?
কারণ ২ : জালালউদ্দিন শেখ (৭৫)। বাড়ি বহরমপুর থানার শাহাজাদপুর গ্রামে। নিজের নামের পদবি ভুল থাকায় ওই বৃদ্ধ আতঙ্কে ভুগছিলেন। সেই আতঙ্কের জেরে শেষমেশ তিনি বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছেন। শনিবার সকালে জমিতে কাজ করার সময় তিনি বিষ খান।
কারণ ৩ : শিবপুরের রামমোহন মুখার্জি লেনের ৬৮ বছরের শ্যামলী বন্দ্যোপাধ্যায়। বেঁচে আছেন। কথা বলছেন। লড়াই করছেন। দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে নিয়মিত ভোট দিয়ে আসছেন। ২০০২ সালে তাঁর নাম উঠেছিল ভোটার তালিকায়। তারপর থেকে লোকসভা হোক বা বিধানসভা— প্রতিটি নির্বাচনে তিনি নিজে গিয়ে ভোট দিয়েছেন। অথচ সরকারি নথি জানাচ্ছে, তিনি ‘মৃত’! এই বিভ্রান্তিকর নথিই আজ তাঁর জীবনে সবচেয়ে বড় আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আরও পড়ুন-নির্বাসিত মোহনবাগান সঙ্গে বিপুল জরিমানা

কারণ ৪ : দক্ষিণ ২৪ পরগনার কাকদ্বীপের লক্ষ্মীনারায়ণপুর গ্রামের ৯৯ নম্বর বুথের মীরা নায়েক ও রসিদা বিবিকে মৃত দেখিয়ে তালিকা থেকে কেটে দেওয়া হয়েছে তাঁদের নাম। তড়িঘড়ি ওই দুই ভোটারকে দিয়ে ৬ নম্বর ফর্ম পূরণ করে ভুল সংশোধনের জন্য আবেদন জানিয়েছে বিএলও নারায়ণ দাস। কিন্তু, তালিকায় নাম না উঠলে তাঁরা সমস্ত সরকারি পরিষেবা থেকে বঞ্চিত হবেন।
কারণ ৫ : কোচবিহার–১ ব্লকের ফলিমারি গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় থাকেন অশ্বিনী অধিকারী (৬৫) এবং তাঁর স্ত্রী শিবানী অধিকারী (৫৬)। বেশ বেঁচে–বর্তে রয়েছেন দম্পতি। অথচ দু’জনের নামই মৃত ভোটারের তালিকায় রয়েছে। জানতে পেরে অসুস্থ হয়ে পড়েন অশ্বিনী। দম্পতি রাজবংশী সম্প্রদায়ের। এখানকার স্থায়ী বাসিন্দা। ২০০২-এও ভোট দিয়েছেন। ২০২৫-এর ভোটার তালিকায় তাঁদের নাম ছিল। কোনও সন্তান নেই। কাকতালীয়ভাবে স্থানীয় বিএলও আসকর আলি অশ্বিনীদের প্রতিবেশী। বলছেন, ওই বুথে ৯১৪ জন ভোটারের মধ্যে ৬০ জন মৃত ছিলেন। সমস্ত ফর্ম জমা করার পরে অ্যাপে দেখি ৬২ জন মৃত ভোটার দেখাচ্ছে।
কারণ ৬ : মঙ্গলবার সকাল থেকে বারবার খসড়া তালিকা দেখেও নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না কলকাতা পুরসভার ১১৩ নম্বর ওয়ার্ডের বাঁশদ্রোণীর কংগ্রেসনগর, নিরঞ্জনপল্লির সোমনাথ মিত্র। তাঁর কথায়, ‘তালিকায় বাবা, মায়ের নাম থাকলেও আমার নাম নেই। আমি তো বাংলাদেশি নই! তা হলে আমার নাম বাদ গেল কেন, সেটা বুঝতে পারছি না। আমিও তো সকলের মতো এনিউমারেশন ফর্ম ফিলআপ করে জমা দিয়েছিলাম!’ নিরঞ্জনপল্লিরই প্রায় ৯৭ জনের নাম বাদ গিয়েছে খসড়া তালিকা থেকে।
এইভাবে প্রায় সব জেলাতেই খসড়া তালিকায় জীবিতরা মৃত, আর মৃতরা জীবিত— এমন সমস্যা নিয়ে ভোটারদের একাংশের মধ্যে তীব্র উৎকণ্ঠা তৈরি হয়েছে। তাঁদের আশা— ডাক আসবে নির্বাচন কমিশনের। কিন্তু, কবে? জানেন না কেউই। পাড়ায় পাড়ায় তৃণমূল কংগ্রেসের কর্মীরা নাম বাদ যাওয়া জীবিত ও বৈধ নাগরিকদের পাশে থাকছেন। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের হঠকারিতায় এই যে অস্থির পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তাতে ঘুরে ফিরে উঠে আসছে একটা কবিতার লাইন। ‘মৃতরা এ পৃথিবীতে ফেরে না কখনও। মৃতরা কোথাও নেই…।’
দেশ ভাগের প্রেক্ষাপটে, ‘১৯৪৬–৪৭’ কবিতায় মৃতদের নিয়ে কালজয়ী লাইন কবি জীবনানন্দ দাশ–এর। স্বাধীনতার ৭৮ বছর পরে বাংলার ভোটার তালিকার স্পেশ্যাল ইনটেনসিভ রিভিশন (সার)–এর খসড়া তালিকা দেখার সুযোগ মিললে জীবনানন্দ হয়তো প্রত্যাহার করে নিতেন তাঁর সেই লেখা। কারণ, মঙ্গলবারের খসড়া তালিকা বলছে— মৃতরাও জীবিত হয়ে ফিরে আসেন, আর জীবিতেরা মৃত হয়ে থেকে যান!
আর এই আবহাওয়ায় একটি প্রশ্ন। আমাদের প্রথম ও প্রধান জিজ্ঞাসা : গত ১১ বছরে মোট ২৩ হাজার ৯২৬ জন অনুপ্রবেশকারী গ্রেফতার হয়েছে। পাকিস্তান, বাংলাদেশ, ভুটান, নেপাল, মায়ানমার মিলিয়ে এই সংখ্যা। এর মধ্যে সবথেকে বেশি গ্রেফতার হয়েছে বাংলাদেশ সীমান্তে। সংখ্যাটা ১৮ হাজার ৮৫১। অর্থাৎ, ১১ বছরে ভারত ও বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে বছরে গড়ে অনুপ্রবেশকারী গ্রেফতার হয়েছে ১ হাজার ৭১৩ জন। কোটি কোটি রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশ অনুপ্রবেশকারী, নরেন্দ্র মোদি এবং অমিত শাহের ভাষায় ঘুসপেটিয়া, তাহলে কোথায়?

Latest article