সন্ধ্যা নামার পর যখন সব কর্মব্যস্ত মানুষ ঘরে ফেরেন বিশ্রামের জন্য তখন একদল আকাশপ্রেমী মানুষ ওই অন্ধকার আকাশে প্রযুক্তির চোখ দিয়ে রহস্যময় নিসর্গের চুলচেরা বিশ্লেষণ করে খুঁজে পান নানা তথ্য ও তত্ত্ব, যা আমাদের এই ব্রহ্মাণ্ডকে (Universe) চিনতে এবং আমাদের উৎস সম্পর্কে জানতে সাহায্য করে। সম্প্রতি এমনই কিছু বিস্ময় আমেরিকার ন্যাশনাল অ্যারোনটিক্স অ্যান্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বা নাসার হাত ধরে সাধারণ মানুষের নজর কেড়েছে।
হাতির শুঁড় ও নীহারিকার কাফিলা
বিশাল দেহ, দু-ধারে জমাট চামড়ার বোঝা, কালো কলেবর, কৌতূহলী আবাহন, পথনির্দেশের জন্য সুউচ্চ শৃঙ্গবিশিষ্ট হাতির প্রর্দশনীর মতোই ‘এলিফ্যান্টস ট্রাঙ্ক নেবুলা’ বা হাতির শুঁড়ের মতো দেখতে নীহারিকা বয়ে চলেছে নৈসর্গিক নির্গমণ অঞ্চল এবং তরুণ তারার মেঘজটলা ‘আইসি ১৩৯৬’-এর মধ্য দিয়ে। মহাকাশের বুকে এই বিস্ময়কর ছবিটি বিজ্ঞানীরা স্পিৎজার স্পেস নামে একটি দূরবীক্ষণ যন্ত্রের সহযোগিতায় তুলেছেন। গবেষণায় জানা গেছে ‘আইসি ১৩৯৬’ অপত্য নক্ষত্রের মেঘজটলাটি নক্ষত্রপুঞ্জ ‘সেফিয়াসে’র উচ্চ এবং দূরবর্তী তারামণ্ডলের মধ্যে অবস্থিত। পৌরাণিক কাহিনি অনুযায়ী সেফিয়াস হল ইথিওপিয়ার রাজা, ‘অ্যান্ড্রোমেডা’ নক্ষত্রমণ্ডলের পিতা এবং ‘ক্যাসিওপিয়া’ তারামণ্ডলের স্বামী! চিত্রটির বাম দিকে দেখা যায় ঐ অবাক করা মহাজাগতিক হাতির কাণ্ড, যা ‘ভিডিবি ১৪২’ নামে চিহ্নিত, এই নীহারিকাটি প্রায় কুড়ি আলোকবর্ষেরও বেশি দীর্ঘ। আমাদের সৌরজগতের থেকে প্রায় ২৪৫০ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। এই বিশদ টেলিস্কোপিক দৃশ্যে দেখা যাচ্ছে উজ্জ্বল ওল্টানো খাঁজ, শীতল আন্তঃনাক্ষত্রিক ধূলিকণা এবং গ্যাসের প্রচুর পকেট রয়েছে এই অঞ্চলে। মজার ব্যাপার হল এইসব গাঢ়, টেন্ড্রিল-আকৃতির মেঘপুঞ্জে তারা গঠনের কাঁচামাল থাকে এবং কচি-কচি তারাদের জন্ম দিয়ে থাকে। নীহারিকাটি তুলনামূলকভাবে ওই মেঘমণ্ডলে পাঁচ ডিগ্রি কোণে আকাশের একটি বড় অঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত। এই উপস্থাপনাটি এক ডিগ্রি প্রশস্ত দৃশ্যের ক্ষেত্র বিস্তার করে, যা আগামী দিনে নতুন তারাদের আঁতুড়ঘর হতে পারে। মহাজাগতিক চিত্রগ্রাহক ও জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের কাছে এই গর্ভিণী হাতির শুঁড়ের মতো নীহারিকার দলটিকে একটি নীহারিকার কাফিলা বা দ্য ক্যারাভ্যান অব নেবুলা মনে হয়!
বিড়ালের চোখ : একটি গভীর ও বিস্তৃত নীহারিকা
এ-হল একটি নক্ষত্র সৃষ্টির পরের ঘটনা। জীবনের শেষ দিকে লালদৈত্য নক্ষত্র থেকে নির্গত আয়নিত গ্যাসের একটি প্রসারিত, উজ্জ্বল শেল বা কাঠামো নিয়ে গঠিত নীহারিকা। বিড়ালের চোখের মতো কেন্দ্রস্থল অত্যন্ত উজ্জ্বল এবং আকর্ষণীয়, সঙ্গে চতুর্দিকে নির্গত বর্ণচ্ছটা; নাম তাই বিড়ালচক্ষু নীহারিকা বা ক্যাটস আই নেবুলা! জ্যোতির্বিজ্ঞানের পরিভাষায় এর নাম এনজিসি ৬৫৪৩। এটি হল আকাশের সবচেয়ে পরিচিত গ্রহ-নীহারিকাগুলির মধ্যে একটি।
আরও পড়ুন- অর্জিত জ্ঞানের প্রজন্মান্তরে প্রসারণই হল শিক্ষা
এই নীহারিকাটি আয়নিত গ্যাসের মোড়কে মোড়া একটি গ্যাসীয় গ্রহ-নীহারিকা; এটি কোনও নক্ষত্রমণ্ডলের অংশ নয়। বিজ্ঞানের দরবারে এই বিশেষ নীহারিকাটি ক্ল্যাডওয়েল সিক্স নামেও পরিচিত। ওই নিসর্গের ড্রাকো তারামণ্ডলের উত্তরভাগের খুব কাছে অবস্থিত এই নীহারিকাটিকে ১৭৮৬ খ্রিস্টাব্দের ১৫ ফেব্রুয়ারি জার্মান বংশদ্ভূত ব্রিটিশ জ্যোতির্বিশারদ ফ্রেডরিক উইলিয়াম হার্সেল আবিষ্কার করেন। এটিই প্রথম নীহারিকা যার চারপাশের বর্ণালি বা বর্ণচ্ছটার অনুসন্ধান করেছিলেন ইংরেজ শিক্ষানবিশ জ্যোতির্বিজ্ঞানী উইলিয়াম হাগিন্স।
এই নীহারিকাটি আমাদের সৌরজগৎ থেকে আনুমানিক তিন হাজার আলোকবর্ষ দূরত্বে অবস্থিত। বিজ্ঞানীদের ধারণা নীহারিকার বাইরে নির্গত অস্পষ্ট আলোকপ্রভার বিস্তারই প্রায় পাঁচ আলোকবর্ষ জুড়ে। সূর্যের মতো নক্ষত্রের জীবনের একটি চূড়ান্ত পর্যায় হিসেবে গ্রহ-নীহারিকাকে দীর্ঘকাল ধরে সমাদৃত করা হয়েছে। অতি-সম্প্রতি, কিছু গ্রহ-নীহারিকাতে এই ধরনের বর্ণবলয় বা জ্যোতিশ্চক্র দেখতে পাওয়া গেছে, সম্ভবত এগুলো তারার বিবর্তনের পূর্ববর্তী পর্বগুলির সময় কম্পনের ফলে সৃষ্ট ঝেড়ে ফেলে দেওয়া উপাদান থেকে গঠিত। বিজ্ঞানীদের গবেষণা, গ্রহ-নীহারিকাদের জীবনপর্বটি প্রায় দশ হাজার বছর ধরে চলতে থাকে বলে মনে করা হয়। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এই আলোর বলয়ের মধ্যস্থিত ফিলামেন্টারি অংশগুলির বয়স পঞ্চাশ হাজার থেকে নব্বই হাজার বছর বলে অনুমান করেন। তবে বিড়ালের চোখের মতো উজ্জ্বল কেন্দ্রের চারদিকে নির্গত জ্যোতির্বলয়ের উৎস সম্পর্কে কোনও সঠিক ব্যাখ্যা আজও বিজ্ঞানীদের কাছে ‘রাশিয়ান ডল স্ট্রাকচারে’র মতোই রহস্যে মোড়া।
প্যান্ডোরার বাক্স :ছায়াপথের মহাজোট
মনে পড়ে সেই ৭০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে হেসিওদের লেখা গ্রিক পুরাণের প্যান্ডোরার বাক্সের কথা! গ্রিক দেব কুলপতি জিউস মানবদরদি প্রমিথিউসের ঠগামি করার জন্য বিশ্বকর্মা হেফাস্টাসকে দিয়ে প্রথম মানবী প্যান্ডোরাকে বানিয়েছিলেন। জিউস কারসাজি করে প্রমিথিউসের ভাই এপিমিথিউসের সঙ্গে প্যান্ডোরার বিয়ে দেন এবং বিয়ের সময় প্যান্ডোরাকে একটি বাক্স উপহার দিয়েছিলেন; যা ইতিহাসে ‘প্যান্ডোরার বাক্স’ নামে পরিচিত। এই বাক্সটির উপরে লেখা ছিল ‘কখনো খোলো না’, অথচ সঙ্গে একটি চাবিও ছিল। এর রহস্য কী! নিষিদ্ধ বস্তুর প্রতি আকর্ষণ, নয়তো অজানাকে জানার নিবিড় কৌতূহলপ্রবণতা।
ঠিক এই প্যান্ডোরার বাক্সের মতোই রহস্যে ঘেরা একটি মহাজাগতিক ছায়াপথের মহাজোটের সন্ধান মিলেছে জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের কাছে। আমাদের সৌরজগৎ থেকে প্রায় ৩.৫ বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে স্কালপ্টর তারামণ্ডলের কাছাকাছি অবস্থিত ‘আবেল ২৭৪৪’ ছায়াপথমণ্ডলী। এটিই যেন সেই অজানা সম্ভাবনা! ঐ নৈসর্গিক স্থানে একত্রে প্রায় অনেকগুলো ছায়াপথ মিশে বিজ্ঞানীদের কাছে একটি খুবই প্রিয় মহাকাশ পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। একসঙ্গে কয়েকটি ছায়াপথ মিশে ওই জটলাটি একটি আতশ কাচ বা বিবর্ধক কাচ হিসেবে কাজ করে। ফলস্বরূপ বহুদূরের কোনও ছায়াপথ বা আলোর উৎস পর্যবেক্ষকের চোখে বিবর্ধিত অবস্থায় ওই মহাজোটের প্রেক্ষাপটে ফুটে ওঠে। এই ঘটনাকে বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলা হয়ে থাকে গ্রাভিটেশনাল লেন্সিং বা মহাকর্ষীয় দূরদৃষ্টি।
প্রদত্ত গভীর ও মোজাইক করা চিত্রটি জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের এনআইআর ক্যামেরা দ্বারা রেকর্ড করা গ্যালাক্সি ক্লাস্টার বা ছয়াপথ-মহাজোট ‘অ্যাবেল ২৭৪৪’-এর একটি অত্যাশ্চর্য দৃশ্য উপস্থাপন করে। এক্ষেত্রে ‘আবেল ২৭৪৪’ নিজেই তিনটি ভিন্ন বৃহদায়তন গ্যালাক্সি ক্লাস্টারের একটি বিস্ময়কর একত্রীকরণ বলে মনে হয়। আমেরিকার ন্যাশনাল অ্যারোনটিক্স অ্যান্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বা নাসার জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের অবলোহিত প্রতিকৃতি তৈরির ক্ষমতা ও প্যান্ডোরার ছায়াপথমণ্ডলীর প্রাকৃতিক গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং-এর ক্ষমতা একত্রে প্রায় পঞ্চাশ হাজার উৎসের ছবি সংগ্রহ করছে সেই সমস্ত বস্তু বা বস্তুসমষ্টির ছবি যা আগে কখনও তোলা সম্ভব হয়নি।