সৌগত রায়: আজ চব্বিশ পেরিয়ে পঁচিশে পা সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেসের (TMC)। যার মূল চালিকাশক্তি হলেন পশ্চিমবঙ্গের মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী শ্রীমতী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। গোটা রাজ্যের তথা দেশের মহিলাদের জন্য তিনি অনুপ্রেরণা। দেশকালের ঊর্ধ্বে তিনি জনপ্রিয় নেত্রী। ব্যক্তিত্বে, বিদ্যায়, বুদ্ধিতে তিনি সেরার সেরা। সাফল্যের ইতিহাসে তিনি বিকল্পহীন। তাই নতুন বছরের প্রথমদিনের অর্ধেক আকাশ তাঁর গল্প, তাঁর জয়গাথা ছাড়া অসম্পূর্ণ।
২০২২-এর ১ জানুয়ারি তৃণমূল কংগ্রেস (TMC) ২৪ বছর পার করে ২৫-এ পা দিল। ১৯৯৮ সালে ১ জানুয়ারি তৃণমূল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই সময়ের মধ্যে দলের যে অগ্রগতি হয়েছে তা চমকপ্রদ।
মমতা যখন তৃণমূল কংগ্রেস (TMC) তৈরি করেন, তার মূল শক্তি এসেছিল তাঁর যুব কংগ্রেসের কর্মী-নেতাদের কাছ থেকে। অবশ্য সঙ্গে সঙ্গে ডাঃ রণজিত পাঁজা, অজিত পাঁজা, কৃষ্ণা বসু, আনন্দমোহন বিশ্বাস-এর মতো প্রবীণ লোকরাও তাঁর সঙ্গে যোগ দেন। প্রথম দিকে সিপিএম তৃণমূলের বিরুদ্ধে অসম্ভব আক্রমণ শানায়। গড়বেতা, কেশপুর এবং বীরভূমের সুচপুরে সিপিএম-এর আক্রমণে অনেক তৃণমূল কর্মী মারা যায়। তা সত্ত্বেও তৃণমূল কংগ্রেস পরপর নির্বাচনে ভাল ফল করল। ১৯৯৮-তে লোকসভায় ৭টি আসন পায়, ১৯৯৯-তে লোকসভায় ৯টি আসন পায় এবং ২০০১-এর বিধানসভায় ৩০টি আসন পায়। তৃণমূলের কঠিন সময় আসে ২০০৪-এ। যখন লোকসভায় একা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তৃণমূল প্রার্থী হিসাবে জয়ী হন। ২০০৬-এও বিধানসভায় তৃণমূল কংগ্রেস মাত্র ৩০টি আসন পায়। সেই সময় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তাঁর উদ্ধত উক্তি করেন, ‘‘আমরা ২৩৫, ওরা ৩০— আমাদের আটকায় কে?’’ পরে অবশ্য বুদ্ধদেববাবু সিঙ্গুর এবং নন্দীগ্রামের কাদায় আটকে যান।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘুরে দাঁড়ানোর লক্ষ্যে তাঁর শ্রেষ্ঠ গণ আন্দোলন শুরু করেন। সিঙ্গুরে অনিচ্ছুক কৃষকদের নিয়ে তাঁর লড়াই সারা দেশের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কৃষকদের সমর্থনে লড়াই করতে গিয়ে তিনি বারবার বামফ্রন্টের পুলিশের হাতে নিগৃহীত হন। অবশেষে কৃষকদের সমর্থনে কলকাতায় ২৬ দিন ঐতিহাসিক অনশন করেন এবং সিঙ্গুরে ১৫ দিন অবস্থান করেন। অবশেষে টাটা কোম্পানি সিঙ্গুর ছেড়ে চলে যায়। পরে অবশ্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Mamata Banerjee) ক্ষমতায় আসার পর সব অনিচ্ছুক কৃষককে জমি ফেরত দিয়েছেন।
আরও পড়ুন-মনে পড়ে সেদিনের কথাগুলো
আরও রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম হয় পূর্ব মেদিনীপুরের নন্দীগ্রামে। সেখানে ইন্দোনেশিয়ার সেলিম গোষ্ঠী কেমিক্যাল হাব করার জন্যে ১৫ হাজার একর জমি অধিগ্রহণের পরিকল্পনা করে। নন্দীগ্রামের কৃষকরা এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন৷ ৭ জানুয়ারি ২০০৭ তিনজন তৃণমূল (TMC) কর্মী নিহত হন৷ ১১ মার্চ ২০০৭ বামফ্রন্টের পুলিশের গুলিতে ১৪ জন তৃণমূল সমর্থক নিহত হন৷ যার মধ্যে দু’জন ছিলেন মহিলা৷ নন্দীগ্রামেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন৷ এরপর হাওয়া তৃণমূলের দিকে ঘুরতে থাকে৷ বাংলার বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীরা নন্দীগ্রামে গুলি চালানোর বিরুদ্ধে কলকাতায় মিছিল করেন৷ ২০০৯ লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস সিঙ্গুর–নন্দীগ্রামের আন্দোলনের ফল পেতে শুরু করে৷ লোকসভায় ১৯টি আসনে তৃণমূল জয়ী হয়, যেখানে বামফ্রন্ট পায় মাত্র ১৬টি আসন৷ এই হাওয়াতেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ২০১১-তে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে রাজ্যে ক্ষমতায় আসেন এবং মুখ্যমন্ত্রী হন৷ তারপর আর দু’বার তৃণমূল কংগ্রেস (TMC) বিধানসভা নির্বাচনে জয়লাভ করেছিল৷ ২০১৬–তে তার প্রধান প্রতিপক্ষ ছিল সিপিএম-কংগ্রেস জোট এবং আনন্দবাজার গোষ্ঠী। ২০১৯–র লোকসভায় বিজেপি ভীষণভাবে উঠে আসে এবং রাজ্যে ৪২–এর মধ্যে ১৮টা আসনে জয়লাভ করে৷ অনেকেই বলেন, এর প্রধান কারণ হচ্ছে ২০১৮–র পঞ্চায়েত নির্বাচনে বহু জায়গায় নিরপেক্ষ নির্বাচন না হওয়া৷ পঞ্চায়েতে যাঁরা ভোট দিতে পারেননি তাঁদের অনেকেই তৃণমূলের বিপক্ষে ভোট দেন৷ লোকসভা নির্বাচনে ভাল ফল করায় বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতারা স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন যে তাঁরা পশ্চিমবাংলায় ক্ষমতায় আসবেন৷ অমিত শাহ স্লোগান দেন— ‘‘আগলে বার, ২০০ পার’’৷ কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পুরো হাওয়া ঘুরিয়ে দেন৷ তিনি ভাঙা পা নিয়ে রাজ্যের প্রতিটি প্রান্তে প্রচার করেন ২০২১–এ বিধানসভা নির্বাচনের সময়৷ আওয়াজ তোলেন— ‘‘বাঙালির আত্মমর্যাদা’’৷ বাংলার মানুষ শেষ পর্যন্ত তাঁকেই ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা দেন৷ বিজেপি ৭৭ আসনে থেমে যায়৷
অনেকেই প্রশ্ন করেন যে, মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্বাচনী সাফল্যের কারণ কী? আমার মতে, তিনটে নীতিতে তিনি অবিচল ছিলেন৷ এক, গণ আন্দোলনে পুলিশের গুলি চলবে না৷ দুই, কৃষকের জমি জোর করে অধিগ্রহণ করা যাবে না৷ তিন, গরিব মানুষকে তার বাসস্থান থেকে বিনা পুনর্বাসনে উচ্ছেদ করা যাবে না। এই নীতিগুলি গরিব মানুষের কাছে তাঁকে জনপ্রিয় করেছে। অন্যদিকে তাঁর গৃহীত প্রকল্পগুলো— যেমন কন্যাশ্রী, সবুজসাথী, খাদ্যসাথী, স্বাস্থ্যসাথী এবং সাম্প্রতিক লক্ষ্মীর ভাণ্ডার গরিব ও পিছিয়ে পড়া মানুষ ও মহিলাদের মধ্যে স্থায়ীভাবে তাঁর আসন তৈরি করেছে। সেই জায়গা কারও পক্ষে কেড়ে নেওয়া সম্ভব না।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জনপ্রিয়তাই তৃণমূল কংগ্রেসের চালিকাশক্তি। একে সম্পদ করে তৃণমূল কংগ্রেস শুধু এই রাজ্যে নয়, বিভিন্ন রাজ্যে তার সংগঠন ছড়িয়ে দিতে পারে। তিন বছরের মধ্যেই তৃণমূল কংগ্রেস স্বীকৃত সর্বভারতীয় দল হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।