তত্ত্ব ও তথ্যে প্রাণের উৎস

প্রথম দিনের সূর্য প্রশ্ন করেছিল সত্তার নতুন আবির্ভাবে— কে তুমি! বৎসর বৎসর চলে গেল, দিনের শেষ সূর্য; তবু আজও চলছে খোঁজ প্রাণের উৎস সন্ধানে। দ্বিতীয় পর্বের আলোচনায় তুহিন সাজ্জাদ সেখ

Must read

উত্তরহীন প্রশ্নের উত্তরের খোঁজে
প্রাণের উৎস কোথায়— সমুদ্রে নাকি ভূমিপৃষ্ঠে; এই নিয়েই গোটা পৃথিবীতে জীববিজ্ঞানী এবং রসায়নবিদদের মধ্যে একটি তুমুল বিতর্ক বিদ্যমান রয়েছে। একজন যুক্তি দেয় মহাসাগরের তলদেশ থেকে প্রাণের উৎস, তো আর একজন সেই যুক্তি খণ্ডন করার চেষ্টা করে বোঝায় প্রাণের সৃষ্টি এই মাটিতেই। তবে, জীবন ঠিক কীভাবে সৃষ্টি হয়েছিল এবং ঠিক কোথায় হয়েছিল তা নিয়ে নিপাট ঝগড়া থাকলেও, কবে হয়েছিল প্রাণের সৃষ্টি সে-ব্যাপারে সকলেই প্রায় একমত— বৈজ্ঞানিক ধারণা, আজ থেকে প্রায় ৩৮০-৪০০ কোটি বছর আগে এই পৃথিবীতে প্রাণের উন্মেষ ঘটে! যাই হোক, মতবিরোধ থাকলেও সকলে মিলে সেই বিশেষ জন্ম-রসায়ন বা সেই বিশেষ পরিবেশ-পরিস্থিতির অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছেন নিবিড়ভাবে। হয়তো একদিন সেই ইতিহাস তাঁরা জনমানসে আনতে পারবেন এবং এই মানবজাতির জন্মরহস্য জানার অদম্য কৌতূহল মেটাতে সক্ষম হবেন।

আরও পড়ুন-দার্জিলিং ও কালিম্পংয়ে পর্যটকদের জন্য চালু হতে চলেছে অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টস

প্রচলিত তথ্য এবং সম্ভাব্য তত্ত্ব
বৈজ্ঞানিক মহলের প্রচলিত ধারণা, মহাসাগরের অতলে জলতাপীয় খাঁজ কিংবা শৈল শিরা থেকেই প্রাণের প্রথম উন্মেষ। ১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দে পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরের ভিতরে যখন প্রথম এইপ্রকার হাইড্রো-থার্মাল ভেন্টস বা খাঁজ বা ফোকরের সন্ধান পাওয়া যায়, তখন সেখানে ‘ব্ল্যাক স্মোক’ বা কালো ধোঁয়ার দেখা মেলে। এই দেখে বিজ্ঞানীদের ধারণা এটাই হয়তো ‘কোষ’ সৃষ্টির পক্ষে প্রাথমিক অনুকূল পরিবেশ। সমুদ্রের ওই অঞ্চলে উপস্থিত ফোকর থেকে প্রচুর পরিমাণে সালফাইড মিশ্রিত প্রায় ৪০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ফুটন্ত গরম জলের স্রোত বইত, যা হালকা হয়ে উপরের দিকে উঠলে শীতল সমুদ্রের জলের স্পর্শে ঘনীভূত হয়ে ওই কালো রঙের ধোঁয়া উৎপন্ন করত। বিজ্ঞানীদের এই ধারণা আরও দৃঢ় হয় ২০০০ খ্রিস্টাব্দে, যখন তাঁরা মধ্য আটলান্টিক মহাসাগরের গভীরে ওই প্রকার জলতাপীয় খাঁজ এবং শৈল শিরা আবিষ্কার করেন, যা লস্ট সিটি নামে পরিচিত। তাৎপর্যপূর্ণভাবে, এই লস্ট সিটির চূড়াগুলো ক্ষারীয় এবং ওগুলো সার্পেন্টিনাইজেশন প্রক্রিয়ায় ম্যাগনেসিয়াম, আয়রন এবং সিলিকেট খনিজ জলের সঙ্গে বিক্রিয়া করে প্রচুর হাইড্রোজেন উৎপাদনের ফলে সৃষ্টি হয়েছে।
তবে এই ধরনের ক্ষারীয় ভেন্টস আবিষ্কারের আগেই, ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে নাসার জেট প্রোপালশন ল্যাবরেটরিতে কর্মরত ভূ-রসায়নবিদ ড. মাইকেল রাসেল কীভাবে ক্ষারীয় সামুদ্রিক ভেন্টে প্রাণের উন্মেষ ঘটে সে-বিষয়ে একটি বিশেষ পন্থা আবিষ্কার করেন। তিনি দেখান, সৃষ্টির শুরুর দিকে আজকের তুলনায় সমুদ্রের জলে অনেক বেশি পরিমাণে কার্বন ডাই অক্সাইড পাওয়া যেত, স্বাভাবিকভাবেই ওই অতিরিক্ত আম্লিক জল যখন ওইসব ক্ষারীয় ভেন্টস নিঃসৃত জলের সঙ্গে মিশে বিক্রিয়া করে তখন যে পিএইচ মাত্রার পরিবর্তন এবং শক্তির রূপান্তর ও তারতম্য লক্ষ্য করা যায়, তা একটি কোষ গঠনের জন্য যথেষ্ট উপযোগী। কোষ অভ্যন্তরীণ ‘প্রোটন-মোটিভ’ ফোর্সের জন্য কোষ পর্দা তৈরির মুহূর্তে আ্যাডিনোসিন ডাই-ফসফেট যেভাবে অ্যাডিনোসিন ট্রাই-ফসফেটে রূপান্তরিত হয়, তার পন্থা বা মেকানিজম ওই অ্যালকালাইন হাইড্রো-থার্মাল ভেন্টে বর্তমান। প্রাণ-কোষ সৃষ্টির লগ্নে প্রোটন গ্রেডিয়েন্টের যে তারতম্য পরিলক্ষিত হয়, তখন যে বিভব পার্থক্য দেখা যায় তা ওই অতল সামুদ্রিক ভেন্ট কিংবা চূড়ার ক্ষেত্রেও অনুরূপ। তাই গভীর সমুদ্রের লস্ট সিটিকেই অনেক বিজ্ঞানী প্রথম প্রাণের উৎসস্থল হিসেবে মনে করেন। তবে এখানেই শেষ নয়, বিজ্ঞানীদের মধ্যে রয়েছে নানা মত, তাই চলছে নিরন্তর প্রাণের উৎস-সন্ধানে উৎসব!

আরও পড়ুন-দিল্লিতে ডাক্তারি পড়ুয়ার রহস্যমৃত্যু

অন্যান্য বৈজ্ঞানিক মতামত
ড. রাসেলের একজন সহকর্মী রসায়নবিদ ড. লরা বার্জ বিজ্ঞানী রাসেলের গভীর সমুদ্রের শৈলচূড়া প্রাণ প্রতিষ্ঠার সহায়ক, এই তত্ত্ব মেনে নিয়েই তিনি নিজের মতো করে বিক্রিয়াধর্মী সোডিয়াম সিলিকেট দ্রবণের সঙ্গে ধাতব লবণ মিশিয়ে একটি ‘কেমিক্যাল গার্ডেন’ তৈরি করেন। পরীক্ষা করে দেখেন, এইভাবে কোষপর্দা এবং উদ্ভিদের কাণ্ডের মতো ফাঁপা স্তম্ভও তৈরি করা সম্ভব। তিনি ড. রাসেলের সঙ্গে অনেকটাই সহমত পোষণ করেন। এ-ছাড়াও সামান্য মতবিরোধ রেখেও ইউনিভার্সিটি কলেজ অব লন্ডনের জৈবরসায়নবিদ ড. নিক লেন একইরকম ভাবেই এই ‘প্রিবায়োটিক জিওইলেক্ট্রোকেমিক্যাল’ সিস্টেমের কথা মাথায় রেখেই তাঁর অরিজিন অব লাইফ রিয়েক্টর তত্ত্বের প্রকাশ ঘটান। তবে আমেরিকার উডস হোল ওশিয়েনোগ্রাফিক ইনস্টিটিউটের ভূরসায়নবিদ ড. ফ্রেডার ক্লেইন তাঁর গবেষণায় দাবি করেন, কোষ কোনও খাঁজ বা ফোকর থেকে নয়; বরং ইবেরিয়ান মহাদেশের প্রান্তে স্পেন ও পর্তুগাল উপত্যকা অঞ্চলে সমুদ্রের তলদেশের প্রায় ৭৬০ মিটার গভীর থেকে প্রাপ্ত পাথরের মধ্যে খুঁজে পাওয়া গিয়েছে কোষ সৃষ্টির অনুকূল পরিবেশের নমুনা।
তবে জার্মানির ইউনিভার্সিটি অব ওস্নাব্রুকের বিজ্ঞানী আর্মেন মুল্কিডানিয়াঁ কিন্তু এইসব অতল সামুদ্রিক তত্ত্বকে পাত্তা দিতে একেবারেই নারাজ। তিনি মনে করেন, যে কোষ তৈরি হতে সোডিয়ামের চেয়ে প্রায় ১০ গুণ বেশি পটাশিয়াম দরকার হয়, সেই কোষ কীভাবে একটি সামুদ্রিক পরিবেশে সৃষ্টি হতে পারে যেখানে পটাশিয়ামের চেয়ে প্রায় ৪০ গুণ বেশি সোডিয়াম উপস্থিত। তাঁর ধারণা প্রাণের উৎস মহাদেশীয়, এবং তা ধীরে ধীরে পরিবেশের মধ্যে তার নানা জৈব রাসায়নিক পরিকাঠামো তুলে ধরেছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন কোষের আরএনএ বা রাইবো নিউক্লিক অ্যাসিড নিউক্লিওটাইডের সঙ্গে সূর্য থেকে আগত অতিবেগুনি রশ্মির যে সম্পর্ক তা সমুদ্রের তলদেশে সম্ভব নয়, কেননা অতিবেগুনি রশ্মি পৃথিবী পৃষ্ঠের উপর পড়ে, গভীর সমুদ্রে পৌঁছায় না।

আরও পড়ুন-মহারাষ্ট্রে খুন বাংলার শ্রমিক

তাত্ত্বিক মতপার্থক্য এবং নিরন্তরতা
প্রাণের উৎস সন্ধানের খোঁজ নিরন্তর তা সে যতই মতবিরোধ থাক। খুব কাছ থেকে দেখলে বোঝা যায় এই তত্ত্বগত পার্থক্য আসলে কোনও দ্বন্দ্বই নয়, তফাতটা শুধু বিষয়গত দৃষ্টিকোণের। প্রত্যেকের একটাই গন্তব্য, তা হল প্রথম কোথায় কীভাবে প্রাণের উন্মেষ ঘটে সেটা খুঁজে পাওয়া। যাঁরা সংশ্লেষক বা সিন্থেটিক রসায়নবিদ তাঁরা মনে করেন প্রাণের উৎস মহাদেশীয় এবং যাঁরা ভূবিজ্ঞানী এবং জৈব বিশারদ তাঁদের অধিকাংশই মনে করেন প্রাণের উৎস অতল মহাসাগরীয়। আসলে এখনও পর্যন্ত পাওয়া সমস্ত তথ্য ও তত্ত্বের মধ্যে কোনও না কোনও কমতি দেখা গিয়েছে; কোনও তত্ত্বই সম্পূর্ণ প্রাণের উৎস সন্ধানের ব্যাখ্যা দিতে পারেনি। তাই আমাদের সকলের অধীর অপেক্ষা, আগামিদিনে হয়তো বিজ্ঞানীরা আমাদের সেই তত্ত্বও একদিন উপহার দেবেন।

Latest article