যাঁরা নির্জনতা পছন্দ করেন, পৃথিবীর কোলাহল থেকে অনেক দূরে যেতে চান, মহাকাশ থেকে দেখতে চান পৃথিবীর সৌন্দর্য, হারিয়ে যেতে চান নিখিল ভুবনে। বেড়ানোর রসদ জোগাড় করে ক’দিনের জন্যে ঘুরে আসতে পারেন মহাকাশে। সকাল-বিকেল মহাশূন্যে হেঁটে নিতে পারেন কয়েক চক্কর। তারপর নিজের মুখোমুখি বসবেন নিজেই। আপনাকে বাধা দেওয়ার কেউ নেই। অবশ্য কী খাবেন বা কী রান্না করবেন তার সুযোগ বেশ কম। পৃথিবী থেকেই নিয়ে যেতে হবে সব খাবার। উড়ন্ত মানুষের মতো সেগুলো ধরে ধরে খেতে হবে। তবুও মহাকাশে বেড়ানোর আনন্দটাই আলাদা।
আরও পড়ুন-বাংলাসাহিত্যে ভ্রমণ
পুজোর বুকিং এখনও
শুরু হয়নি
মহাকাশ বেড়ানোর পুজোর বুকিং এখনও শুরু হয়নি, কিন্তু যাদের সত্যি বেড়াতে যাওয়ার ইচ্ছে আছে মহাকাশে তাঁরা পর্যটকদের লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন। অবশ্য আপনি যখন ভাবতে শুরু করেছেন মহাকাশে যাওয়াটা কতটা রিস্কের তার আগেই এক প্রবাসী ভারতীয় গোপীচাঁদ থোতাকুরা মহাকাশে গেলেন, ঘুরলেন, জয় করলেন। প্রথম ভারতীয় পর্যটক হিসেবে সাক্ষী থাকলেন মহাকাশ ভ্রমণের। গোপীচাঁদ পেশায় বিমান চালক, ছোটবেলা থেকে স্বপ্ন উড়ানে পাড়ি দেওয়া তাঁর শখ। তাই আমেরিকার বেসরকারি মহাকাশ সংস্থা ‘ব্লু অরিজিনের নিউ সেফার্ড-২৫’ অভিযানের অংশ হিসেবে মহাকাশে পর্যটক হিসেবে বেড়িয়ে এলেন। গোপীচাঁদ কিন্তু একা নন। সঙ্গে ছিলেন তাঁর পাঁচ সঙ্গী। এঁরা হলেন মেসন অ্যাঞ্জেল, সিলভাইন চিরন, কেনেথ এল হেস, ক্যারল শ্যালার এবং প্রাক্তন এয়ারফোর্স ক্যাপ্টেন এড ডোয়াইট। মহাকাশে গিয়ে পৃথিবীর জন্যে মন খারাপ হলে গোপীচাঁদ গল্প করতেন এঁদের সঙ্গে।
আরও পড়ুন-সব ছোটদের জন্য
প্রথম মহাকাশ পর্যটক গোপীচাঁদের গল্প
সকাল-সন্ধে বুঝতে না পেরেও গোপীচাঁদের মনে পড়ত তাঁদের ছেলেবেলার কথা। মনে পড়ত অন্ধ্রপ্রদেশের বিজয়ওয়াড়ার কথা। গোপীচাঁদ ভাবতেন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছে তাঁর স্বাস্থ্য সংস্থার কথা। একেবারে ছোটবেলা থেকেই আকাশ নিয়ে প্রবল আগ্রহ ছিল গোপীচাঁদের। এই আকাশ আর মহাকাশই ছিল তাঁর ব্যক্তিগত পাঠক্রম। পড়াশুনা শেষ করেই বিমান চালানোর নেশায় মেতে উঠেছিলেন। গাড়ি চালানোর আগেই শিখে নিয়েছিলেন বিমান চালানো। বিমান চালানোর প্রাথমিক শিক্ষার পর আরও দক্ষতা অর্জন করতে আমেরিকার ফ্লোরিডার ‘এন্ত্রি-রিডল অ্যারোনটিক্যাল ইউনিভার্সিটি’ থেকে মহাকাশবিদ্যা নিয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। গোপীচাঁদ বুশ, অ্যারোবেটিক এবং সিপ্লেন, গ্লাইডার এবং এয়ার বেলুনও ওড়াতে পারেন। আন্তর্জাতিক চিকিৎসা বিমানের পাইলট হিসেবেও কাজ করেছেন তিনি। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল এবং মহাকাশের সীমানা ‘কারমান লাইন’ পেরিয়ে মহাশূন্যে কিছু সময় কাটিয়ে আবার পৃথিবীতে ফিরে আসেন নভোচারীরা। তাঁরা ব্লু অরিজিন ফাউন্ডেশন, ক্লাব ফর দ্য ফিউচারের পক্ষে একটি পোস্টকার্ড মহাকাশে নিয়ে যান। ক্লাবের লক্ষ্য হল পৃথিবীর সুবিধার জন্য স্টিম-এ কেরিয়ার গড়ার জন্য ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করা এবং সংগঠিত করা।
কমার্শিয়াল ফ্লাইট ছাড়াও, তিনি অ্যারোবেটিক বিমান এবং সমুদ্র বিমানের পাশাপাশি হট এয়ার বেলুনও উড়িয়েছেন। আন্তর্জাতিক মেডিক্যাল বিমানের পাইলট হিসেবেও কাজ করেছেন। সম্প্রতি তানজানিয়ার মাউন্ট কিলিমাঞ্জারো আগ্নেয়গিরিতে আরোহণ করেছিলেন গোপী থোতাকুরা। মহাকাশ মিশনের জন্য নির্বাচিত হওয়ার বিষয়ে, গোপী থোতাকুরা বলেছিলেন যে ব্লু অরিজিন মাদার আর্থকে রক্ষা করার জন্য, পৃথিবীর বাইরে মহাকাশে জীবন এবং অ্যাডভেঞ্চারের অপেক্ষায় রয়েছে। মহাকাশে জীবন শনাক্ত করার খোঁজ চালাচ্ছেন।
আরও পড়ুন-বিধান মার্কেটে বিধ্বংসী আগুন, পরিদর্শনে মেয়র
মহাকাশে যাবেন কীসে করে?
কিন্তু মহাকাশে বেড়াতে যাবেন কীসে করে! এই ভাবনার অবসান ঘটিয়েছেন নিউ শেফার্ড। প্রায় ২৬ বার মহাকাশে ঘুরিয়ে এনেছেন ৩৭ জন মহাকাশ পর্যটককে। এই বেসরকারি ফ্লাইট নিউ শেফার্ড একবার না বারবার মহাকাশ আপ- ডাউন করতে পারে। নিয়মিত মহাকাশ ভ্রমণের জন্যে ব্লু অরিজিন এই মহাকাশযান তৈরি করেছে। ব্লু অরিজিন এই নিউ শেফার্ডের কথা বলতে গিয়ে তার প্রযুক্তির কথা তুলে ধরেছেন। তাঁরা বলছেন, নতুন শেফার্ডের ইঞ্জিন অত্যন্ত তরল অক্সিজেন এবং হাইড্রোজেন দ্বারা চালিত হয়। উড়ানের সময়ে কোনও কার্বন নিঃসরণ হয় না। ব্লু অরিজিন আরও একটি আশার কথা জানিয়েছে, মহাকাশ ভ্রমণের জন্যে এক্কেবারে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য নিয়ে গ্লেন নামে একটি ভারী রকেটও তৈরি করেছেন। আগামিদিনে মহাকাশে বেড়ানোর জন্যে নতুন নতুন যানবাহন তৈরির ভাবনাও তাদের রয়েছে।
কোন এয়ারপোর্ট থেকে মহাকাশের বিমান ছাড়বে?
সাধারণত টেক্সাস থেকে নিউ শেফার্ড মহাকাশে পাড়ি দেয়। গোপীচাঁদ ও তাঁর সঙ্গীদের নিয়েও টেক্সাস থেকে মহাকাশে পাড়ি দিয়েছিল নিউ শেফার্ড-২৫। মহাকাশে পৌঁছতে গোপীচাঁদদের সময় লেগেছিল ১১ মিনিট। ১৯ মে সকাল ৮:৩০-এ পাঁচ বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে গোপীচাঁদ-এর এই নিউ শেফার্ড-২৫ টেক্সাস থেকে সোজা পৌঁছে যায় মহাকাশে। ঠিক এসপ্ল্যানেড থেকে জলের তলায় মেট্রোতে হাওড়া পৌঁছতে যত সময় লাগে সেই সময় টেক্সাস থেকে মহাকাশে পৌঁছে যান গোপীচাঁদরা!
মির কর্প থেকে ব্লু অরিজিন
এর আগে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে মানুষ সমেত মহাকাশে রকেট পাঠানোর পরিকল্পনা ছিল ব্লু অরিজিন-এর। কিন্তু উৎক্ষেপণের আগে সেই অভিযান বাতিল করা হয়। করণ তার ঠিক আগে টেক্সাস থেকে একটি রকেট উৎক্ষেপণ করতে গিয়ে ব্যর্থ হয় ব্লু অরিজিন। তবে ওই রকেটে কোনও মানুষ সওয়ার ছিলেন না। বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে মহাকাশ পর্যটন বিষয়ে কোর্স চালু হয়েছে। নিউ ইয়র্কের রচেস্টার ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি, জাপানের কিয়ো বিশ্ববিদ্যালয় এবং ফ্লোরিডার এমব্রিরিডল অ্যারোনটিক্যাল ইউনিভার্সিটিতে মহাকাশ পর্যটনবিষয়ক কোর্স চালু হয়েছে।
মহাকাশ বেড়ানোর খরচ কত?
মহাকাশ পর্যটন দু’ধরনের। প্রথম ধরনটি হচ্ছে সাব-অরবিটাল। সাব-অরবিটাল মহাকাশযানটি যাত্রীদের কারমান লাইনের ঠিক বাইরে নিয়ে যায়— যেটা আমাদের মাথার ওপরে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থান করছে। এটি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল এবং মহাকাশের মধ্যে সীমানা হিসেবে বিবেচিত হয়। সাব-অরবিটাল পর্যটকরা মহাকাশে কয়েক মিনিট কাটিয়ে পৃথিবীতে ফিরে আসেন। অন্যদিকে, অরবিটাল পর্যটকেরা কারমান লাইনের চেয়ে অনেক বেশি দূরত্বে যেতে পারেন। সাধারণত যাত্রীরা প্রায় ৪০০ কিলোমিটার উচ্চতায় কয়েক দিন থেকে এক সপ্তাহের বেশি সময় কাটাতে পারেন এবং পৃথিবীকেও প্রদক্ষিণ করতে পারেন। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে স্পেস এক্সের ফ্যালকন ৯ চারজন যাত্রীকে ১৬০ কিলোমিটার উচ্চতায় নিয়ে যায় এবং তিনদিন ধরে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে আবার ফিরে আসে। মহাকাশ পর্যটন অত্যন্ত ব্যয়বহুল পর্যটন। মহাকাশে যেতে একেক পর্যটককে সর্বনিম্ন ১০ লাখ ডলার দিতে হয়। এর মধ্যে কিছু ক্ষতিকর বিষয়ও আছে।
আরও পড়ুন-শহরের পুজো মণ্ডপ পরিদর্শন শুরু করল কলকাতা পুলিশ
মহাকাশ পর্যটনে ব্যবহৃত রকেটগুলো সরাসরি উপরের বায়ুমণ্ডলে গ্যাসীয় এবং কঠিন রাসায়নিক পদার্থ নির্গত করে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করে। ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন (ইউসিএল), কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় এবং ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে, রকেট উৎক্ষেপণ থেকে নির্গমনে বায়ুমণ্ডল যে পরিমাণ উষ্ণ হয়, তা অন্য কোনও কারণে হয় না। এছাড়া রয়েছে নিরাপত্তা। অ্যাস্ট্রোনমি ম্যাগাজিনের প্রতিবেদনে বলা হয়, নিরাপত্তাজনিত বিশেষ সতর্কতার পরও ২০২৩ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ৬৭৬ জন মহাকাশচারীর মধ্যে ১৯ জন মারা গিয়েছেন। অর্থাৎ শতকরা ৩ ভাগ নভোচারী উড্ডয়নের সময় মারা যান।
‘গ্লোবাল স্পেস ট্যুরিজম মার্কেট’ শিরোনামে রিসার্চ অ্যান্ড মার্কেটসের প্রতিবেদন অনুসারে, ২০৩০ সালের মধ্যে আনুমানিক চক্রবৃদ্ধি বার্ষিক বৃদ্ধির হার (CAGR) ৩৭ দশমিক ১ শতাংশ-সহ ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী মহাকাশ পর্যটনশিল্প ৮ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছবে বলে অনুমান করা হয়েছে।