অতই সহজ গান্ধীকে মেরে ফেলা? গান্ধীর পায়ে রাত্রি চক্র ঘোরে

যাঁকে হত্যা করেছিল হিন্দুত্ববাদীরা ৩০ জানুয়ারি, ১৯৪৮-এ, তাঁর বিকল্প পথটা আজও প্রাসঙ্গিক। সেই পথটা জানা, চেনা ও বোঝার জন্যই বেশি বেশি করে গান্ধীজিকে পড়া দরকার। লিখছেন কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্র বিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. শিলাদিত্য চক্রবর্তী ও চাকদহ কলেজের শিক্ষক জামশেদ নাসির মণ্ডল

Must read

গান্ধীজির মতো ‘ব্যর্থ’ মানুষ আর ভারতীয় ইতিহাসে আর কেউ আছেন বলে মনে হয় না। আধুনিক শিল্পসভ্যতায় তাঁর বিশ্বাস ছিল না। অথচ, তাঁর জীবৎকালেই ভারতকে শিল্পায়িত দেশ হিসেবে গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেন তাঁর মানসপুত্রেরা। তাঁরা অনেকেই তাঁর গ্রামভিত্তিক দেশের স্বপ্নকে অবাস্তব বলে ভেবেছিলেন। কদিন আগেই যখন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ‘সার্জিকাল স্ট্রাইক’ দিবস পালন করতে বলা হচ্ছিল, সেই মিলিটারি উন্মাদনার কথা বাদ দিলেও আমাদের জাতীয়, প্রাদেশিক বা স্থানীয় রাজনীতিতে হিংসার অস্তিত্ব কি অস্বীকার করা যায়? কোন দল আর অহিংসার রাজনীতির দাবিদার হতে পারে এই ভারতে?
তারপর ধরা যাক জাতপাতের রাজনীতির কথা। সেখানেও ‘হরিজন’ শব্দটি আর ‘হরিজন’দেরও পছন্দ নয়। পৃথিবী জুড়ে তার জায়গা কেড়ে নিয়েছে ‘দলিত’ কথাটি। অনেকেই জানতে চান, গান্ধীজি কি নারীবাদী ছিলেন, না কি প্রকারান্তরে পুরুষতন্ত্রেরই সমর্থক? তাঁর কি ‘বৈজ্ঞানিক মনোভাব’ ছিল, না ‘ধর্মীয় কুসংস্কার’-এর ধারকবাহক ছিলেন তিনি?
কিংবা সেই আদি প্রশ্ন— তিনি কি সত্যিই ‘মহাত্মা’ (Mahatma Gandhi), না কি আজকের এক বরিষ্ঠ নেতার ভাষায়, এক জন ‘চতুর বানিয়া’ মাত্র?
যাঁকে ঘিরে এত প্রশ্ন, এত সন্দেহ, তাঁকে প্রতি বছর অন্তত দুদিন করে, ২ অক্টোবর এবং ৩০ জানুয়ারি, স্মরণ করা কেন? জন্মদিন পালন কি একটি অন্তঃসারশূন্য রাষ্ট্রিক প্রথামাত্র? সেই মুণ্ডিত মস্তক, শীর্ণদেহী, চশমাধারী, হাতে লাঠি, চাদরে ঘেরা, দৃঢ়চেতা মানুষটিকে তাঁর নিধন দিবসে স্মরণ করাই বা কেন? আজও কেন এই ‘ব্যর্থ’ মানুষটি আমাদের মনে থেকে যান তাঁর বিশ্বজনীন আবেদন নিয়ে?

দীপেশ চক্রবর্তী একবার লিখেছিলেন, গান্ধীজি (Mahatma Gandhi) পড়ানো হয় বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন সব পাঠ্যক্রমে যেখানে সমস্ত ছাত্রের সাধারণ শিক্ষার একটি ভিত্তি প্রস্তুত করার চেষ্টা করা হয়। ফলে গান্ধীজির লেখাপত্রের স্থান হয় প্লেটোর ‘অ্যাপলজি’ বা লকের ‘হিউম্যান আন্ডারস্ট্যান্ডিং’ বা ‘মার্ক্স-এঙ্গেলস’-এর ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’ বা জন স্টুয়ার্ট মিলের ‘অন লিবার্টি’র পাশেই। দীপেশ লিখেছিলেন, “মার্কিন মানববিদ্যার পাঠ্যক্রমে আর কোনও উপমহাদেশীয় মানুষ এমন জায়গা করে নিয়েছেন বলে আমার জানা নেই’’।

রবীন্দ্রনাথের যেমন ছিল ‘স্বদেশী সমাজ’ প্রবন্ধটি, গান্ধীজিরও (Mahatma Gandhi) তেমনই ছিল ‘হিন্দ-স্বরাজ’। সেই বইটাই বিশ্বের বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়ানো হয়। এই বইটি যেন গান্ধীজির সামাজিক-রাজনৈতিক-ব্যক্তিগত দর্শনের এক ম্যানিফেস্টো! জীবনের শেষে এসেও এসেও গান্ধীজি বলতেন, বইটির দু’একটি শব্দ ব্যতীত আর কিছুই তিনি পরিবর্তনের যোগ্য মনে করেন না। বন্ধু হেনরি পোলককে একবার বলেছিলেন, এই বইয়ের বক্তব্যগুলো যেন তাঁকে ভূতের মতো চেপে বসেছিল, যেন এই বই না লিখলেই নয়। লিখেওছিলেন ঝড়ের বেগে, মাত্র দশ দিনে, কোনও এক প্রয়োজনবোধের ঘোরের ধাক্কায়। আরও নানা চিন্তার মতোই একটি ‘অবাস্তব’ চিন্তার সংগ্রহ। সমগ্র বই জুড়ে গান্ধীজি বলছেন মানুষের আত্মিক ও সার্বিক অহিংসার সাধনা তার লোভ সংবরণের মধ্যে। আধুনিক শিল্পসভ্যতার মধ্যে বাস করে ও তারই অংশ হয়ে এই সাধনা কখনওই সার্থক হতে পারে না। শিল্প-সভ্যতা বলতে শুধু যন্ত্র-লোহালক্কড়-কারখানা-রেলগাড়ি-মোটরগাড়ি নয়, সেই সঙ্গে গান্ধীজি টেনে নিয়ে এসেছেন আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যা, আইন, এমনকী পার্লামেন্টারি রাজনীতিও। তিনি বলছেন এই সমস্ত প্রতিষ্ঠানই লোভকে মদত দেয়। লোভই হিংসার উৎস। বর্তমানে কেন্দ্রের শাসকদলের মতো অনেকেই এক ধরনের রাজনৈতিক দর্শন শেখাচ্ছে যাতে বলা হচ্ছে যে, সমাজ বস্তুটি একটি ‘ম্যানেজ’ করার জিনিস। যদি আইনের আটঘাট ভাল করে বাঁধা যায় ও তার যথাযথ প্রয়োগ করা যায়, তা হলে চোর-ছেঁচড়-গুন্ডাও দেশ ভালভাবে চালাতে পারবে, কারণ তাদের চুরি করার কোনও উপায়ই থাকবে না! গান্ধী কিন্তু এ-সব কথার ধারেকাছে নেই। তাঁর কাছে রাজনীতি করা ও ব্যক্তি-মানুষের আত্মিক বিকাশের মধ্যে কোনও তফাত নেই।

আরও পড়ুন- ২ ব্যাগ মমতা, বইমেলায় নেত্রীর বই নিয়ে আগ্রহ তুঙ্গে

এই প্রতিবেশে হিন্দ স্বরাজের মতো বই পড়ে ছাত্রছাত্রীরা, মার্কিন সমাজের ধনতান্ত্রিক ও পয়সা-পূজারি সমাজেই যাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ বসবাসের ও সাফল্যের স্বপ্ন দেখে, তারা কী পাবে?
এককথায়, তারা পাবে এমন একজন মানুষের সাক্ষাৎ যিনি আমাদের শেখান কী ভাবে বাস্তব কাজকর্মে নীতির সঙ্গে আপস যাতে ন্যূনতম মাত্রার বেশি না হয়, সেদিকে তীক্ষ্ণ ও সতর্ক দৃষ্টি রেখে বাঁচতে হবে। গান্ধীজি ছিলেন এই রকম এক ঘোর ‘অবাস্তব’ মানুষ, যিনি ভাবতেন ‘বাস্তব’কে ততটুকুই জমি ছাড়ব, যেটুকু না ছাড়লে নয়। সংগ্রাম হবে, বাস্তবটাকেই আদর্শের কাছাকাছি নিয়ে আসার। যন্ত্রের দাস হওয়া, এমনকী শরীর-যন্ত্রেরও, গান্ধীজির পক্ষে সম্ভব ছিল না।

১৯৪৫ সালেও নেহরু লিখছেন তাঁর বাপুকে যে, ‘হিন্দ-স্বরাজ’ একটি ‘সম্পূর্ণ অবাস্তব’ গ্রন্থ। শিল্প, ভারী শিল্প ও শহর ছাড়া ভারতের দ্রুত উন্নতি কী ভাবে সম্ভব? জবাবে গান্ধীজি লেখেন, যে শহরে কোটি কোটি মানুষকে এনে ফেলা হবে, সেই শহরে কি মানুষের পক্ষে হিংস্রতা এড়ানো সম্ভব? এই গান্ধী আজও বেঁচে থাকলে রাষ্ট্রীয় নেতাদের চোখে চোখ রেখে বলতেন, তোমরা নীতিগত ভাবে ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ’-এ বিশ্বাস করো না। তোমরা ভেবেছ, যেনতেনপ্রকারেণ উন্নয়নটি হয়ে যাক। তা হলেই অবশেষে সবার মঙ্গল। আগে স্থির করো অহিংস সমাজ গড়াটাই উপায় ও লক্ষ্য, তার পর উন্নয়ন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বাসস্থান এই সমস্ত ‘বিকাশ’-এর কথা অন্য ভাবে ভাবো। এখানেই গান্ধীজি, আজকাল যাকে উন্নয়নের ‘বিকল্প ভাবনা’ বলা হয়, সেই ভাবনার পথের পথিক। আর সেই পথটা জানা-চেনা ও বোঝার জন্যই বেশি বেশি করে গান্ধীজিকে পড়া দরকার।

Latest article