কিংবদন্তি নাট্যব্যক্তিত্ব বাদল সরকার। বাংলায় থার্ড থিয়েটারের জনক। জন্ম ১৯২৫ সালের ১৫ জুলাই। উত্তর কলকাতার বিডন স্ট্রিটে। ছিলেন টাউন প্ল্যানার৷ নাগপুরে কর্মজীবন শুরু৷ পরবর্তী সময়ে কর্মসূত্রে ফ্রান্স, নাইজেরিয়া, ইংল্যান্ডে কাটিয়েছেন। বিদেশে থাকাকালীন বহু বিদেশি নাটক দেখেছেন। লন্ডনে ‘থিয়েটার ইন দ্য রাউন্ড’ দেখেই তাঁর মধ্যে বিকল্প ধারার থিয়েটারের প্রতি আগ্রহ জন্মায়। একটা সময়ে কাজকর্ম ছেড়েছুড়ে কলকাতায় ফিরে আসেন।
নাট্যজীবন শুরু পাঁচের দশকে। সর্বভারতীয় খ্যাতি দেয় ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’। থিয়েটারকে মঞ্চ থেকে মাটিতে নামিয়ে এনেছিলেন। দূর করেছিলেন অভিনেতা এবং দর্শকের প্রভেদ। খোলা আকাশের নিচে মঞ্চস্থ হত তাঁর নাটক। অন্যদের সঙ্গে অভিনয় করতেন নিজেও। ২০১১ সালের ১৩ মে কোলন ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মিশে যান আলোর ঠিকানায়।
আরও পড়ুন-দিনের কবিতা
এই বছর পালিত হচ্ছে বাদল সরকারের জন্মশতবর্ষ। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগের অন্তর্গত মিনার্ভা নাট্যসংস্কৃতি চর্চাকেন্দ্র জুলাই ২০২৫-এ তাঁর স্মরণে প্রকাশ করেছে নাট্য-বিষয়ক পত্রিকা ‘চর্চা’র বিশেষ সংখ্যা। প্রধান সম্পাদক রাজ্যের মন্ত্রী তথা বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব ব্রাত্য বসু। সম্পাদকীয়তে তিনি লিখেছেন, ‘‘আমরা গর্বিত নবপর্যায়ে ‘চর্চা’র এই প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হল এমন একজন বাঙালিকে আশ্রয় করে, যিনি তাঁর নাট্যরচনা, প্রয়োগ ও পরিচালনার সঙ্গে তাঁর নাট্য ভাবনাতেও আমাদের দীর্ঘ নাট্য-ঐতিহ্যকে ঝাঁকিয়ে দিতে পেরেছিলেন বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে।”
এই সংখ্যায় আছে বেশকিছু উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ। শুরুতেই ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক বিষ্ণু বসুর রচনা ‘সাহিত্য, নাটক : বাদল সরকার’। ১৯৯৩ সালে ‘স্যাস’ পত্রিকায় প্রকাশিত রচনাটি পুনর্মুদ্রিত হয়েছে। নাটক কি শুধুই দেখার, নাকি পড়ারও? তোলা হয়েছে প্রশ্ন। মধুসূদন, দীনবন্ধু, রবীন্দ্রনাথের পাশাপাশি সমকালীন নাটককারেরা জায়গা করে নিয়েছেন। গুরুত্বের সঙ্গে আলোচিত হয়েছে বাদল সরকারের নাটককৃতি। বলা হয়েছে, ১৯৫৬-১৯৬৭, এই পর্বের নাটকগুলি পড়ছে প্রসেনিয়াম থিয়েটারের আওতায়। ১৯৭০-১৯৯১ পর্যন্ত প্রায় ৩০টি নাটক থার্ড থিয়েটারের অন্তর্গত। থার্ড থিয়েটারের জন্য লেখা নাটকগুলোয় বাদল সরকার তত্ত্ব প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী হয়ে আধার ও আধেয়কে করে তুলেছেন যথাসম্ভব নিরাভরণ, বহুস্তরতা বিবর্জিত। নাটককার সচেতনভাবে সরে এসেছিলেন নাটকের সাহিত্য-তত্ত্ব থেকে। প্রাবন্ধিকের কথায়, ‘এ-পর্যায়ের নাটকসমূহে পাঠকের তুলনায় দর্শকদের প্রাপ্তি বেশি।’
আরও পড়ুন-আত্মীয় যখন বন ও বন্যপ্রাণী
বাদল সরকার অনুপ্রাণিত হয়েছেন বিদেশি নাটক এবং সিনেমা থেকে। রচনা করেছেন বেশকিছু কমেডি। প্রাবন্ধিকের মনে হয়েছে, ‘সলিউশন এক্স’, ‘কবি কাহিনী’ প্রভৃতি নাটকে পরিমিতিবোধ দিয়ে সংহার করা হয়েছে যাবতীয় ভাঁড়ামি, মুদ্রাদোষ, মুখবিকৃতির সম্ভাবনাকে। কয়েক ধাপ এগিয়ে ‘বল্লভপুরের রূপকথা’কে প্রাবন্ধিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সেরা কমেডি বা সর্বোত্তম কমেডি বলে উল্লেখ করেছেন। পরবর্তী সময়ে বাদল সরকারের ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’, ‘সারারাত্তির’ প্রভৃতি নাটকের হাত ধরে বাংলা নাটক পৌঁছেছিল অন্যতর আধুনিকতায়। নাটককার সমকালীনকে ছুঁতে চেয়েছিলেন ব্যক্তি ও বিশ্বের সংকটের মধ্য দিয়ে। ‘পাগলা ঘোড়া’, ‘বাকি ইতিহাস’, ‘শেষ নেই’ নাটকগুলি উঠে এসেছে আলোচনায়। আঁকা হয়েছে প্রশ্ন, বীভৎসতা ও ধ্বংস কি তবে সভ্যতার শেষ সত্য বাণী? ছোট্ট উত্তর, ‘শেষ পর্যন্ত মানুষই মানুষের আশ্রয়।’
বাদল সরকার নির্দেশিত বহু নাটকে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছেন পঙ্কজ মুন্সী। লিখেছেন তিনিও। তাঁর প্রবন্ধের শিরোনাম ‘ভিন্ন পথের সন্ধানি বাদল সরকার’। শম্ভু মিত্র ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’ প্রকাশ করেছিলেন ‘বহুরূপী’ পত্রিকায়। চেয়েছিলেন মঞ্চস্থ করতে। শেষপর্যন্ত সম্ভব হয়নি। কারণ ‘শৌভনিক’ দল আগেই নাটকটি মঞ্চস্থের দিন ঘোষণা করে দেয়। বাদল সরকার নিষেধ করেননি। লেখক জানিয়েছেন, এতে শম্ভু মিত্র যথেষ্ট ক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন। কে জানে, হয়তো শম্ভু মিত্রের নির্দেশনায় নাটকটি ভিন্নরূপ পেতে পারত।’
গৌরকিশোর ঘোষের ‘সাগিনা মাহাতো’ মঞ্চস্থ করেছিলেন বাদল সরকার। এই নাটক তাঁকে পরিচালকরূপে জনপ্রিয়তা দিয়েছিল। জানা যায় লেখাটি পড়ে। এও জানা যায়, তিনি ‘মিছিল’, ‘ভোমা’, ‘হট্টমালার ওপারে’ ইত্যাদি নাটকের কাজ শুরু করেছিলেন নতুন নতুন ছেলেমেয়েদের নিয়ে। উঠে এসেছে ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ।
সুদেব সিংহের ‘যাত্রাপথের আনন্দগান’, আনন্দময় ভট্টাচার্যের ‘পেটিবুর্জোয়া রিবেল অথবা বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ থেকে ছিটকে পড়া এক বিষণ্ণ ফাউস্ত’, কাজি আবু জুম্মানের ‘ভারতীয় থার্ড থিয়েটারে বডি এবং আইডিয়া : নাট্যবৈজ্ঞানিক পর্যালোচনা’, মানবেন্দ্রনাথ সাহার ‘বাদল সরকারের থার্ড থিয়েটার : মারাঠি ও হিন্দি নাটকে তার প্রভাব’ রচনাগুলো সংখ্যাটিকে সমৃদ্ধ করেছে। শান্তা দত্ত, কৃষ্ণা ঘোষ, প্রীতি দত্ত স্মৃতিচারণ করেছেন বাদল সরকার ও ‘শতাব্দী’র উপর। শেষে বাদল সরকারের জীবনপঞ্জি ও গ্রন্থপঞ্জি সাজিয়ে দেওয়া হয়েছে। আছে কিছু দুষ্প্রাপ্য ছবি। সবমিলিয়ে অনবদ্য একটি সংখ্যা। সংগ্রহে রাখার মতো। কার্যনির্বাহী সম্পাদক সার্থক দাস। প্রচ্ছদ-গ্রন্থ নির্মাণে তন্ময় দাশগুপ্ত। দাম ৪০০ টাকা।