প্রতিবেদন : ‘‘ Failed states offer unparallelled economic opportunity, but only for a privileged few. Those… around the ruler or the ruling oligarchy grow richer while their less fortunate brethren starve.’’ ব্যর্থ রাষ্ট্র নির্বিকল্প অর্থনৈতিক সুযোগ এনে দেয়, তবে সে সুযোগ পায় হাতে গোনা কয়েকজন। যারা শাসক কিংবা শাসন ক্ষামতায় আসীন গোষ্ঠীর চারপাশে ঘুর ঘুর করে তারাই ফুলে-ফেঁপে ওঠে আর তাদের অপেক্ষাকৃত দুর্ভাগা ভাইয়েরা না-খেতে পেয়ে মরে।
কথাগুলো রবার্ট রটবার্গের। তাঁর লেখা বিখ্যাত গ্রন্থ ‘When States Fail : Causes and Consequences’ থেকে উদ্ধৃত। সত্যি কথা বলতে কী, এই ব্যর্থ রাষ্ট্রের চারিত্র-লক্ষণ এখন ভারতের গায়ে ফুটে উঠেছে। ‘দি ইকোনমিক্ট’-এর প্রতিবেদনে তা সুস্পষ্ট। ২০১৬ থেকে ২০২০-র মধ্যে আম্বানি-আদানির মতো বাণিজ্য-কুবেরদের সম্পদ ৩৫০ শতাংশ থেকে ৭০০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশের ধনীতম ১০ শতাংশের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়েছে মোট সম্পদের ৭৫ শতাংশ। অন্যদিকে, নিচের তলায় যারা আছে তাদের ৬০ শতাংশের হাতে আছে দেশের মোট সম্পদের কেবল ৫ শতাংশ। চূড়ান্ত ধন-বৈষম্যের ঢেউতে এ দেশ এখন টালমাটাল।
সিএমআইই বেকারত্ব-সংক্রান্ত যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে মে, ২০২১-এ গ্রামাঞ্চলে বেকারত্ব বাড়তে বাড়তে ১১.৩৪ শতাংশে পৌঁছেছে আর শহরে এই হার ১৪.৭১ শতাংশ। দিনমজুর, নির্মাণশ্রমিক, রাস্তার হকার, গৃহস্থবাড়ির পরিচারক, পরিচারিকা— এঁদের মতো মানুষজনের অবস্থা অতিমারির কারণে মারাত্মক অবস্থায় পৌঁছেছে। তাঁদের জন্য মোদি সরকারের তরফে কোনও আর্থিক-সহায়তা প্রকল্প নেওয়া হয়নি। বরং ক্রোনি ক্যাপিট্যালিস্টদের আরও শ্রীবৃদ্ধি ঘটানোর লক্ষ্যে তাবৎ নীতি কার্যকর করা হচ্ছে।
বিশ্ব খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি-সংক্রান্ত রিপোর্ট, ২০২০-তে দেখা যাচ্ছে দেশের ১৪ শতাংশ মানুষ অপুষ্টির শিকার। ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সি মহিলাদের ৫১.৪ শতাংশ রক্তাল্পতায় ভুগছেন। পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুদের মধ্যে ৩৪.৭ শতাংশের বাড়বৃদ্ধি ঠিকমতো হচ্ছে না। এরকম শিশুর ২০ শতাংশের ওজন উচ্চতার অনুপাতে কম। ফলে তারা সহজেই নিউমোনিয়া বা ম্যালেরিয়ার মতো অসুখে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুমুখে পড়তে পারে, এমন সম্ভাবনা সমধিক।
বিশ্বব্যাঙ্কের দেওয়া তথ্য ব্যবহার করে পিউ রিসার্চ সেন্টারের প্রতিবেদন দেখাচ্ছে, দৈনিক রোজগার মাত্র ১৫০ টাকা কিংবা তারও কম, এরকম হতদরিদ্র লোকের সংখ্যা গত এক বছরে দ্বিগুণের বেশি হয়েছে— ৬ কোটি থেকে বৃদ্ধি পেয়ে এক বছরের মধ্যে ১৩ কোটি ৪০ লক্ষে দাঁড়িয়েছে। আজ থেকে সাড়ে চার দশক আগে দেশটাকে ‘গণদারিদ্র্যের দেশ’ বলা হত। সেই অভিধা ফিরে আসতে চলেছে।
সংবিধানের চতুর্থ ভাগে রাষ্ট্র পরিচালনার নির্দেশমূলক নীতিতে ভারতকে একটি কল্যাণকর রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছে। কল্যাণকর রাষ্ট্রের নীতি হল আমজনতার হাতে যাতে রুটি-রুজি জোগানো যায়, সেটা নিশ্চিত করা। কিন্তু সেই জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্রের ধারণাকে আবর্জনার স্তূপে নিক্ষেপ করে মোদির ভারত হাঁটছে বাজারশাসিত অর্থনীতির চলনে। ফলত, মূলস্রোতের বাইরের দেশের ৬০ শতাংশ মানুষ আজ ক্রয়ক্ষমতা হারিয়ে দারিদ্র্যের সম্মুখীন। নোটবন্দির পঞ্চম বর্ষপূর্তির লগ্নে এই চিত্রটি আমাদের ভাবাচ্ছে, কাঁদাচ্ছে, আতঙ্কিত করছে।
মোদি-সরকার বলেছিল নোটবন্দির ফলে কালো টাকার পরিমাণ কমবে, কর সংগ্রহ বাড়বে, ভারত নগদহীন অর্থনীতির পথে হেঁটে কালোটাকামুক্ত দেশে পরিণত হবে।
আরও পড়ুন : Shrabanti Issue: শ্রাবন্তীর দল ছাড়া নিয়ে আর্থিক লেনদেনের নিয়ে প্রশ্ন তুললেন কুণাল ঘোষ
বাস্তবে কী দেখলাম? ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৬-তেই রিজার্ভ ব্যাঙ্ক জানিয়েছিল, ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোটের ৯৯ শতাংশই তাদের জিম্মায় ফিরে এসেছে। পরে জানা গেল, সেগুলো এসেছে বড় বড় বান্ডিলে। অর্থাৎ অতি-ধনীদের ঘর থেকেই রিজার্ভ ব্যাঙ্ক সিংহভাগ ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট পেয়েছে। সুতরাং হিসাব-বহির্ভূত অর্থ আটকানোর যে-কথা নোটবন্দির সময় বলা হয়েছিল তা যে পুরোটাই ভাঁওতা সেটা বোঝা গিয়েছিল।
পরবর্তীকালে আরও দেখা গেল, নমিনাল জিডিপি-র সঙ্গে নগদ অর্থের অনুপাত ২০১৬-’১৭-তে খানিকটা কমলেও তা অতিমারির প্রাক্কালে ঠিক প্রাক্ ২০১৬ পর্বের মতো শ্রীবৃদ্ধিলাভ করেছে। অর্থাৎ, নগদহীন অর্থনীতির স্বপ্ন ভেঙেচুরে একশা। কর সংগ্রহেও নোটবন্দি ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে, এমন রিপোর্ট কোথাও পাওয়া যায়নি। উল্টে নগদ অর্থের অভাবে মারা পড়েছেন অগণিত ছোট ব্যবসায়ী, চাহিদা হয়েছে নিম্নমুখী। অতিমারি এসে সেই অবস্থাটাকে আরও ভয়ানক করে তুলেছে।
রবার্ট রটবার্গ লিখেছিলেন, ব্যর্থ রাষ্ট্রে জাতি-রাষ্ট্র সবার কল্যাণের এবং ব্যক্তিগত শ্রীবৃদ্ধি ঘটানোর দায়িত্ব লক্ষ্যণীয়ভাবে পালন করে না। (‘‘The nation-state’s responsibility to maximize the well-being and personal prosperity of all citizens is conspicuously absent…’’) দেশের বর্তমান সরকার যে জাতি-রাষ্ট্রের এই প্রাথমিক দায়িত্বটি পালন না-করে ভারতকে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করেছেন— সে-কথা বলাই বাহুল্য। আয় বৈষম্যের নিরিখে ভারতের স্থান এখন তাই রাশিয়ার পরেই।
এই হল এই সরকারের ‘অচ্ছে দিন’!
এই সরকারকে বিদায় করতে না পারলে দেশ আবার অগ্রগতি ও উন্নয়নের পথে পা রাখতে পারবে বলে মনে হয় না।