বাংলা বিজ্ঞাপনের গান। অর্থাৎ ‘জিঙ্গল’। তার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে ছিলেন শ্রাবন্তী মজুমদার (Srabanti Majumder)। সাত ও আটের দশকে, বেতারে ভেসে আসত বেশকিছু বিজ্ঞাপনের গান। তার মধ্যে অন্যতম ‘সুরভিত অ্যান্টিসেপ্টিক ক্রিম বোরোলীন’। শ্রাবন্তী মজুমদারের গাওয়া। গানটি ছুঁয়ে গিয়েছিল শ্রোতাদের মন। আজও সেই গান অমলিন বাঙালির স্মৃতিতে। বোরোলিনের বিজ্ঞাপনের গান একবার হৈমন্তী শুক্লাকে দিয়ে গাওয়ানো হয়েছিল। যদিও সেটা সাফল্য পায়নি। পরে আবার ফিরিয়ে আনা হয় শ্রাবন্তী মজুমদারের (Srabanti Majumder) গানটিই। শ্রাবন্তী মজুমদারের কণ্ঠে শোনা গিয়েছিল ‘ওয়েসিস’-সহ আরও কিছু বিজ্ঞাপনের গানও। পরবর্তী সময়ে বাংলা সংগীতশিল্পী হিসেবেও তিনি খ্যাতি লাভ করেন। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে গাওয়া ‘আয় খুকু আয়’ গানের কলি বহু শ্রোতার পছন্দের তালিকায়— মুখে মুখে ফেরে। আরও বেশকিছু গান রেকর্ড হয়েছে তাঁর কণ্ঠে। প্রকাশিত হয়েছে অ্যালবাম। গেয়েছেন চলচ্চিত্রের গানও।
তিনি দীর্ঘদিন রয়েছেন দেশের বাইরে। সম্প্রতি কিছু দিনের জন্য এসেছেন শহর কলকাতায়। প্রায় এক দশক পর তাঁর নতুন আধুনিক বাংলা গান প্রকাশ পেল। ২৩ অক্টোবর, দক্ষিণ কলকাতার ‘ক্যাফে উইশডম ট্রি’ রেস্তোরাঁয় আয়োজিত ছিমছাম অনুষ্ঠানে। শ্রাবন্তীর গাওয়া নতুন বাংলা গানগুলি শ্রোতারা শোনার সুযোগ পাবেন তাঁর অফিশিয়াল ইউটিউব চ্যানেলে। গান তিনটি হল ‘কী সুন্দর এই পৃথিবী’, ‘তার পর ছুটি পাবো’, ‘দাদু নাতি আর একটি মাছের গল্প’। এরমধ্যে ‘কী সুন্দর এই পৃথিবী’ গানটি লুই আর্মস্ট্রংয়ের গাওয়া বিখ্যাত গান ‘হোয়াট আ ওয়ান্ডারফুল ওয়ার্ল্ড’-এর সুরের অনুসরণে তৈরি। এই গানে রয়েছে আশার কথা, আলোর কথা, স্বপ্ন দেখার কথা। বাকি দুটো গানও দেয় কানের আরাম, প্রাণের আরাম। গানগুলো শুধুমাত্র অনলাইনে প্রকাশ করতে চাননি শ্রাবন্তী মজুমদার। তাই অফ লাইন রিলিজ করার জন্য তিনি কলকাতায় ছুটে এসেছেন।
তিনটি গানই বেঁধেছেন সৌম্য দাশগুপ্ত। অনুষ্ঠানে ছিলেন তিনিও। এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন সুরকার দেবজ্যোতি মিশ্র, সৌমিত্র বসু প্রমুখ। দেবজ্যোতি মিশ্র বলেন, ‘শ্রাবন্তী মজুমদারের তুলনা তিনি নিজেই। ওঁর গায়কি, উচ্চারণ, স্বর সবকিছুই স্বতন্ত্র। আমার নিজের দিদির মতো। আমি তো বলব মেয়েরা যদি ন্যাকামি করতে চান, তাহলে তাঁদের মধ্যে যেন শ্রাবন্তদির স্টাইল থাকে।’
আরও পড়ুন- মিডিয়া মাফিয়ার খেলা চলছে
গান প্রকাশের পর কথা হল শ্রাবন্তী মজুমদারের (Srabanti Majumder) সঙ্গে। এখনও যে তিনি স্টাইল আইকন, সেটা তাঁকে দেখলেই বোঝা যায়। মাথায় ব্যান্ডানা, কমলকারি প্রিন্টের শাড়ি পরে হাজির হয়েছিলেন অনুষ্ঠানে। কেন গাইলেন এই তিনটি গান? এই প্রশ্নের উত্তরে শ্রাবন্তী মজুমদার জানালেন, মাঝে আমি রবীন্দ্রনাথের গান গেয়েছি। রেকর্ড করেছি। একটু অন্যভাবে। দুটো গান আমার ইউটিউব চ্যানেলে আছে। ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে’ এবং ‘ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে’। আমার স্বপ্ন, রবীন্দ্রনাথের গানকে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেব। এইভাবেই আমি গান গেয়ে যাচ্ছি। অনুষ্ঠান করছি। তবে অন্য ধরনের গান করার জন্য বেশ কিছুদিন ধরেই অস্থির হয়ে উঠছিলাম। খুঁজছিলাম নিজের মনের মতো গান। তখন এই তিনটি গান আমার কাছে আসে। সৌম্য দাশগুপ্ত আমাকে ফোনে জানান। গত বছর রেকর্ড করা হয়। এতদিনে মুক্তি পেল।’ তিনি আরও বলেন, ‘সাতের দশক এবং বর্তমান সময়ের মধ্যে অনেক বদল ঘটে গেছে। আমার নতুন গানে এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। আগে তো বাংলা গানের ভিডিওই হত না! এসব অনেক পরে এসেছে। আমি সব সময় চাই নতুন কাজ করতে।’
বর্তমান সময়ের বাংলা গান কেমন লাগে? জানতে চাইলাম। একটু থেমে তিনি বললেন, ‘আমি বাংলা গানের স্বর্ণযুগ দেখেছি। স্বর্ণযুগের শিল্পীদের সঙ্গে কাজ করেছি। অসাধারণ সব গান তৈরি হত তখন। নয়ের দশকের গানও ভাল লাগত। তবে দুঃখের বিষয়, এখনকার বাংলা গান আমার একেবারেই শুনতে ইচ্ছে করে না। মন ছোঁয় না। মনে রেখাপাত করে না বিজ্ঞাপনের গানও। ঘটনা হল, এখানে প্রতিভার অভাব নেই। কিন্তু সেইভাবে গান তৈরি হচ্ছে না। ভাল গীতিকার ও সুরকারের বড় অভাব। দু-চারজন আছেন, যাঁরা ভাল কাজ করার চেষ্টা করেন। তাঁদের মধ্যে একজন অবশ্যই দেবজ্যোতি মিশ্র। অসাধারণ কম্পোজার। আমার খুব প্রিয়। আমি ওঁর সঙ্গে কাজ করতে চাই। জনপ্রিয়তার জন্য নয়। আমি নিজের জন্য গান করতে ভালবাসি। আমার সঙ্গে জীবনের পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে গেছে। যতদিন পারব, ততদিন গাইব।’
সামনেই তাঁর একক অনুষ্ঠান। কলকাতার অবন মহলে। কথায় কথায় এই বিষয়ে তিনি জানালেন, ৯ নভেম্বর আমার একক অনুষ্ঠান। ওইদিন সন্ধ্যায় নানারকম গান গাইব। গানের পাশাপাশি থাকবে প্রচুর গল্প। আলাপচারিতায় থাকবেন নাট্যব্যক্তিত্ব সৌমিত্র বসু। প্রত্যেকটা গানের পিছনে রয়েছে বেশকিছু গল্প। মজার মজার গল্প। গান গাওয়ার মাঝে সেগুলো বলব। তার সঙ্গে রয়েছে আরও কিছু সারপ্রাইজ। আশা করি শ্রোতাদের ভাল লাগবে।
উত্তেজিত শ্রাবন্তী মজুমদার (Srabanti Majumder)। ভরা হেমন্ত-সন্ধ্যায় তাঁকে শোনার জন্য মুখিয়ে রয়েছেন শ্রোতারা। দীর্ঘদিন বিদেশে থাকলেও, তিনি তো আসলে বাংলার মেয়ে। আর এটা কারও অজানা নয় যে, বাংলা বরাবরই তার ঘরের মেয়েকে চায়।