স্বামীজি আর ঠাকুরের শ্রীমা

ঠাকুর জানতেন তাঁর সহধর্মিণী সারদা যে সে মেয়ে নয়, সে-ই হল সমগ্র জগতের চালিকাশক্তি আর স্বামীজির কাছে শ্রীমা ছিলেন সাক্ষাৎ জগদম্বা, বিশ্বজননীস্বরূপা। দুই মহাপুরুষের আরাধ্যা সারদা মা। লিখলেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী

Must read

ঠাকুরের ষোড়শী, সরস্বতী
মহাভারতে আছে ‘মৃদুনাং দারুণাং হন্তি মৃদুনা হন্তাদারুণম। নাস্যেবং মৃদুনা কিঞ্চিৎ তস্মাৎ তীক্ষ্মতরং মৃদুঃ।।’
অর্থাৎ মৃদুতার দ্বারা কঠোরকে জয় করা যায়। মৃদুতার দ্বারা অকঠোরের জিত হয়, মৃদুতার দ্বার অভিভূত হয় না এমন কিছু নেই। সুতরাং মৃদুতা অত্যন্ত তীক্ষ্ম অস্ত্র।
তিনি মা সারদা। যাঁর প্রতিবাদও উচ্চকিত ছিল না। অবগুণ্ঠনবতী এক গ্রাম্যনারী, শান্ত, ধীর অথচ কী বিশাল ব্যক্তিত্ব। সেই শ্রীমাকে শতরূপে দেখেছেন তাঁর কাছের মানুষেরা। যাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন স্বামী ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস দেব এবং স্বামী বিবেকানন্দ।

আরও পড়ুন-মেট্রো স্টেশনে ভাষাবিতর্ক সমাধানে প্রস্তাব মেয়রের

শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস তার স্ত্রী মা সারদা দেবীকে উদ্দেশ্য করে প্রায়ই বলতেন— ‘ও সারদা মানে সরস্বতী।’ তাঁর বিশ্বাস ছিল যে তাঁর স্ত্রীর মধ্যে কোনও পাপ বিরাজ করতে পারে না। ঠাকুরের ভোগ রান্না থেকে সংসারের সব কাজ একা হাতে করতেন সারদা। তেমনই একদিন দরজার দিকে পিছন ফিরে বসে একমনে মায়ের নাম জপ করছিলেন ঠাকুর। দুপুরের খাবার এল। তিনি পায়ের আওয়াজ শুনে মাথা না ঘুরিয়েই শ্রীরামকৃষ্ণ বললেন, ‘ওখানেই রেখে দে’। একবার তিনি যদুর মা ভেবে সারদা মাকে ‘তুই’ করে সম্বোধন করে ফেলেন। তারপরেই কী মনে হওয়ায় ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন খাবারের থালাটি রেখে একগলা ঘোমটা টেনে সারদা দেবী দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন। এবার যারপরনাই লজ্জিত হলেন ঠাকুর। তিনি তাঁর ভুল উপলব্ধি করে তৎক্ষণাৎ মা সারদার কাছে ক্ষমা চেয়ে বললেন— ‘তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও। আমি মহাপাপ করে ফেলেছি।’ আসলে তাঁর কাছে দক্ষিণেশ্বরের মূলমন্দিরে বিরাজিত মা কালী এবং মা সারদার মধ্যে কোনও প্রভেদ ছিল না। দু’জনেই তাঁর কাছে শক্তির আরেক রূপ।
তাঁদের সম্পর্ক স্বামী-স্ত্রীর ঊর্ধ্বে গুরু-শিষ্যার মতো ছিল এবং সেই সম্পর্কে উত্তীর্ণ হতে মা সারদার অবদান অনস্বীকার্য। তিনি চাইলেই মায়া বা অন্য ক্ষমতাবলে শ্রীরামকৃষ্ণের সাধনপথের বাধা হতে পারতেন। কিন্তু তিনি সেই পথ অবলম্বন করেননি। ১৮৭২ সালের জ্যৈষ্ঠ মাসের অমাবস্যা তিথিতে সারদা মাকে ষোড়শীরূপে পুজো করেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ। এই পুজো রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনে
‘ষোড়শী’ পুজো নামে পরিচিত। শ্রীরামকৃষ্ণ এই দিনেই তাঁর সমস্ত সাধনার ফল আর জপের মালা শ্রীমা সারদাকে অর্পণ করেছিলেন। জগৎকল্যাণের উদ্দেশ্যে দেবীরূপে তাঁকে পুজো করেছিলেন। নিজের মতো করে গড়েপিটে নিয়েছিলেন তাঁকে কারণ তিনি জানতেন সারদা কোনও সাধারণ মেয়ে নন। তিনিই ভবিষ্যতে তাঁর আদর্শ ও ভাবাধারাকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। সংঘজননী হয়ে একদিন এগিয়ে নিয়ে যাবেন, পথ দেখাবেন বিশ্বকে, তাঁরও চালিকাশক্তি হবেন সারদাই। অর্থাৎ ঠাকুরের আসল অন্তর্নিহিত শক্তি ছিলেন মা সারদা।

আরও পড়ুন-অভয়ার মঞ্চ ব্যবহারের রাজনীতি এসইউসিআইয়ের নিশানায় সিপিএম

স্বামীজির বিশ্বজননী স্বরূপা
১৯০১ সালে স্বামী বিবেকানন্দ বেলুড় মঠের দুর্গাপুজোর প্রবর্তন করেন। শতবর্ষ পার হয়ে গেছে সেই পুজোর। আজও আড়ম্বরে, আন্তরিকতায় উদযাপিত হয় এই পুজোটি। যদিও সন্ন্যাসীরা বৈদিক পুজো বা ক্রিয়াকাণ্ড করার অধিকারী নন, তবুও তাঁরা এ-পুজো করেছিলেন কেন এই কৌতূহল সবার। ১৮৯৩ সালে আমেরিকা থেকে স্বামীজি তাঁর প্রিয় গুরু ভাই স্বামী শিবানন্দজিকে একটি চিঠি লেখেন। বিশ্বধর্ম সভায় স্বামীজির তখন জয়জয়কার। এই সময়েই তিনি শ্রীরামকৃষ্ণ আন্দোলনকে বিশ্বব্যাপী বিস্তার করার মানসেই একটি স্থায়ী মঠ নির্মাণের গুরুত্ব উপলব্ধি করেন। শক্তিরূপিণী মা সারদামণি তাঁর এই প্রেরণার উৎস। তখনও বেলুড় মঠ প্রতিষ্ঠিত হয়নি। শক্তিরূপিণী মা সারদা সম্বন্ধে স্বামী শিবানন্দজিকে লিখিত তাঁর একটি চিঠি থেকে যা জানা যায় তা হল— ‘…আমাদের দেশ সকলের অধম কেন, শক্তিহীন কেন? শক্তির অবমাননা সেখানে বলে। মা-ঠাকুরাণী ভারতে পুনরায় সেই মহাশক্তি জাগাতে এসেছেন, তাঁকে অবলম্বন করে আবার সব গার্গী, মৈত্রেয়ী জগতে জন্মাবে।…এই জন্য তাঁর মঠ প্রথমে চাই।’ এ-জন্যই মঠের গুরুত্ব উপলব্ধি করেন স্বামীজি। মাতৃময়ী শক্তিরূপিণী মা সারদাকে স্বামীজি ভালভাবেই চিনেছিলেন। মা সারদা সবার প্রিয় মা। এই গদাধরের তথা শ্রীরামকৃষ্ণের যোগ্য সহধর্মিণী এই মা সারদা। স্বামীজি সেকথা বুঝেছিলেন বলেই মাকে শক্তিরূপে জেনেছিলেন। এমনকী এই শক্তিময়ী মাকে ‘জ্যান্ত দুর্গারূপে’ পুজোও করেছিলেন। দুর্গা হলেন মহাশক্তিরূপা। বেলুড় মঠ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সময় গোড়া থেকে নিষ্ঠাবান হিন্দুদের মধ্যে স্বামীজি সম্পর্কে এক বিরূপ মনোভাব ছিল। কারণ তাঁদের মতে, স্বামীজি বিদেশ-প্রত্যাগত, তাই সেই মঠে আচার নিষ্ঠা সম্বন্ধে অনেকেরই সন্দেহ ছিল। কিন্তু পরে স্বামীজীর ভক্তিভাবের পূজানুষ্ঠান তাঁদের সে-ধারণাকে পাল্টে দেয়। আবার এও শোনা যায়, স্বামীজি যখন বেলুড় মঠে দুর্গাপুজো করার বিষয়ে চিন্তা করছিলেন, সেসময় তাঁর জনৈক সন্ন্যাসী ভ্রাতার একটি অলৌকিক স্বপ্নদর্শনও হয়। তিনি দেখেন যে সাক্ষাৎ মা দশভুজা দক্ষিণেশ্বরের দিক থেকে গঙ্গার ওপর দিয়ে বেলুড় মঠের দিকে অগ্রসর হচ্ছেন। এ স্বপ্নবৃত্তান্ত শোনার পর স্বামীজি পুজোয় আরও উৎসাহী হয়ে ওঠেন। যথাসময়ে মায়ের অনুমতিও মিলল স্বামীজির। যথাসময়ে কুমোরটুলি থেকে প্রতিমা এসেছিল। পুজোর ক’দিন বেলুড় মঠে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। পুজোয় বোধনের আগের দিন থেকেই স্বামীজির জ্যান্ত দুর্গা শ্রীসারদামা বেলুড় মঠের পাশেই একটি ভাড়াটে বাড়িতে এসে ওঠেন। ষষ্ঠীর দিন থেকেই বেলুড় মঠে আনন্দ আর ধরে না। শ্রীরামকৃষ্ণদেবের শিষ্যরা তো নিমন্ত্রিত হয়েছিলেন। এ ছাড়া বেলুড়, বালি ও উত্তরপাড়ার নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণেরাও আমন্ত্রিত হয়েছিল। এরপর থেকে গোঁড়া হিন্দুদের বেলুড় মঠ সম্বন্ধে বিদ্বেষ কমতে শুরু করে।
জীবনের শেষদিকে স্বামীজি একদিন মাকে প্রণাম করে বলেছিলেন, ‘মা এইটুকু জানি, তোমার আশীর্বাদে আমার মতো তোমার অনেক নরেনের উদ্ভব হবে। শত শত বিবেকানন্দ উদ্ভূত হবে। কিন্তু সেই সঙ্গে আরও জানি তোমার মতো মা এই জগতে ঐ একটিই আর দ্বিতীয় নেই!’

আরও পড়ুন-রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট বিলি পর্ষদের

শ্রীরামকৃষ্ণদেবকে সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ করার আগে স্বামীজি কতশত পরীক্ষা করেছিলেন, কত ধরনের তর্কবিতর্ক করেছিলেন। ঠাকুরের সম্পূর্ণ মহিমা ধারণা করতে, ঠাকুরকে ধারণ করতে তাঁর কত সময় লেগেছিল কিন্তু মা সারদাকে অনুধ্যান করতে, মার স্বরূপটা অন্তর থেকে অনুধাবন করতে স্বামীজির একটুও সময় লাগেনি। ভাবতেও আশ্চর্য লাগে তাই। কারণ শ্রীমা ছিলেন একজন পল্লিবাসিনী, গ্রাম্য মহিলা। তাঁর কি কখনও ঠাকুরের মতো ভাবসমাধি হত? না তাঁর সে-সব হত না। তিনি ছিলেন অতি সাধারণ এক নারী। মা সবসময় এমনভাবে অবগুণ্ঠনের মধ্যে থাকতেন স্বামীজি শ্রীমার মুখটাও ভাল করে দেখেননি কখনও। আর তাঁর কথাবার্তা এত ধীরে ছিল যে, সামনের মানুষটাও শুনতে পেতেন না। ওঁর সর্বক্ষণের সঙ্গিনী সেবিকা ছিলেন গোলাপ মা, যোগিন মা। এঁরাই মায়ের সব কথা জোরে জোরে বলে দিতেন।
তাহলে মায়ের নিজমুখের কথাও স্বামীজি খুব কম শুনেছেন। মা পর্দার আড়ালেই থাকতেন। আড়াল থেকেই সব সামলাতেন। তা সত্ত্বেও মার স্বরূপ তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, তাঁর অন্তর্নিহিত মহিমার কথা ধারণা করতে, তাকে উপলব্ধি করতে স্বামীজির এতটুকু সময় লাগেনি। বলতে গেলে ঠাকুরের যাঁরা ঘনিষ্ঠ কাছের শিষ্যমণ্ডলী তাঁদের মধ্যে একমাত্র স্বামীজিই পরিপূর্ণভাবে শ্রীমাকে ধারণা করতে পেরেছিলেন। অন্যেরা পারেননি। স্বামীজি নিজমুখে স্বামী শিবানন্দকে বলেছিলেন যে, ‘তোমরা কেউ কিন্তু মাঠাকুরণ কী বস্তু তা বুঝতে পারোনি। এখনো পারো না। ক্রমে পারবে।’ স্বামী সারদানন্দজি, যোগানন্দজি, স্বামী ত্রিগুণাতীতনন্দজি মায়ের কত সেবা করেছেন কিন্তু শ্রীমার যথার্থ স্বরূপ বুঝতে পারেননি। শ্রীমা স্বামীজির কাছে ছিলেন সাক্ষাৎ জগদম্বা। স্বামীজি মাকে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করতেন। একবার কী হয়েছে, শ্রীমা বলরাম মন্দিরে রয়েছেন, সেখানে স্বামীজিও রয়েছেন।

আরও পড়ুন-আজ মাদ্রাসার ফল

স্বামী বিজ্ঞানানন্দজি শ্রীমার সামনে খুব কম যেতেন। প্রায় যেতেনই না বলা চলে। তিনি সেদিন স্বামীজির সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন কী একটা দরকারে। স্বামীজি তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন ‘‘পেসন মাকে প্রণাম করে এসছো তো? উনি বললেন ‘না যাওয়া হয়নি।’ তখন স্বামীজি তাঁকে বললেন ‘আগে যাও প্রণাম করে এসো।’ বিজ্ঞানানন্দজি মনে মনে ভাবলেন একবার যাব ঢিপ করে একটা প্রণাম ঠুকে চলে আসব। যা ভাবা তাই কাজ। কোনওমতে প্রণাম করেছেন কি করেননি স্বামীজি পিছন থেকে বলে উঠলেন, ‘কী পেসন মাকে এমনভাবে প্রণাম করতে হয়? সাষ্টাঙ্গ হয়ে প্রণাম করো। মা যে সাক্ষাৎ জগদম্বা।’ পরবর্তী সময়ে তিনি বলেছিলেন স্বামীজি যে তার পিছন পিছন এসেছেন তিনিই বুঝতেই পারেননি। স্বামীজি শ্রীমাকে কোনওদিন সাধারণ গুরুপত্নী বা সংঘজননী হিসেবে দেখেননি। তাঁকে দেখতেন বিশ্ব জননীরূপে। তাঁর কাছে তিনি বিশ্বজোড়া মা।

Latest article