এসএসসি দুর্নীতি জনসমক্ষে আসতেই বামফ্রন্ট সদস্যদের এক সীমাহীন আনন্দ প্রকাশ পাচ্ছে। তারা মানুষকে ছলে বলে কৌশলে বোঝাতে চাইছেন যে তাদের আমলে এসএসসি নিয়োগ সোভিয়েতের ভোলগা নদীর জলের মতন স্বচ্ছ ছিল। তাই আজকে পশ্চিমবঙ্গে এসএসসির ইতিহাস নিয়ে কিছু তথ্য তুলে ধরছি :
১৯৯৭ সালে এসএসসি আইন করে চালু হওয়ার আগে প্রায় ৭-১০ বছর কোনও বিদ্যালয়ে কোনওপ্রকার নিয়োগ হয়নি। এই কথা স্বীকার করেছেন স্বয়ং বঙ্গেশ্বর জ্যোতিবাবু। তারপর চালু হয় এসএসসি। ১৯৯১ সালে নরসিংহ রাও-এর হাত ধরে উদার অর্থনীতি চালু হওয়ার পরে জ্যোতিবাবু বুঝেছিলেন আর বেশিদিন কমিউনিস্ট অর্থনীতির বুলি আওড়ে ক্ষমতা ধরে রাখা যাবে না। তাঁর আশঙ্কা সত্যি প্রমাণিত হয় ১৯৯৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে। সেবার কোনরকমে গদি বাঁচিয়ে নিলেও শতাংশের বিচারে কংগ্রেসের ভোট ১.৫ শতাংশ বেশি ছিল। তাই বামপন্থাকে সুদূরপ্রসারীভাবে টিকিয়ে রাখার পরিকল্পনা হিসেবে এসএসসি চালুর দায়ভার নিজের কাঁধে তুলে নেন কমঃ অনিল বিশ্বাস। তাই এই এসএসসিকে “শিক্ষায় অনিলায়ন” হিসেবেই বিবেচনা করা হয়।
আরও পড়ুন-প্লাস্টিকের ফাঁদে পৃথিবী
অনিলায়নের প্রথম সূত্র : ম্যানেজিং কমিটির মাধ্যমে বিদ্যালয়কে পার্টি অফিসের সঙ্গে সংযুক্তকরণ।
এসএসসি চালুর আগে এলাকার বিশিষ্ট মানুষজন বা গণ্যমান্য ব্যক্তিত্বদের দিয়ে ম্যানেজিং কমিটি চালানো হত। অনিলায়নের প্রথম সূত্র ধরে বোঝানো হল যে নির্বাচনের মাধ্যমে ম্যানেজিং কমিটি নির্বাচিত করার মধ্যেই স্বচ্ছতা বেশি। এসএসসি চালুর মধ্যে দিয়ে শুরু হয়েছিল ম্যানেজিং কমিটির মাধ্যমে বিদ্যালয়গুলিকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করা। এই ম্যানেজিং কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে এমন লোকদেরকেই বসানো হয়েছিল যারা প্রতিদিন সন্ধ্যেবেলা নিয়ম করে পার্টি অফিসে গণশক্তি পড়তেন এবং পড়াতেন।
অনিলায়নের দ্বিতীয় সূত্র : কমিউনিস্ট পার্টির আদর্শের প্রতি আনুগতদের প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ।
এই সূত্র অনুযায়ী সমস্ত ভাল বিদ্যালয়গুলিতে পার্টির অনুগত ক্যাডারদের প্রধান শিক্ষক হিসেবে উন্নীত করা হয়। অনেক যোগ্য এবং ভাল শিক্ষকদের বঞ্চনার শিকার হতে হয়েছিল শুধুমাত্র রাজনৈতিক ভাবে মাথা নিচু না করার জন্যে যারা অপেক্ষাকৃত নিম্নমানের বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে চলে যান। এইসব নিম্নমানের বিদ্যালয়গুলিতে ছাত্র ছাত্রী সংখ্যা কম থাকত এবং ভাল বিদ্যালয় থেকে একই শ্রেণিতে দুবার ফেল করা ছাত্রছাত্রীরা এইসমস্ত বিদ্যালয়গুলিতে পড়তে যেত। স্বাভাবিকভাবেই জনমানসে এইসব বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা সেভাবে ছিল না।
অনিলায়নের তৃতীয় সূত্র : নিয়ন্ত্রিত-দুর্নীতির মাধ্যমে শিক্ষক-শিক্ষিকা নিয়োগ করে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের প্রকাশ্য রাজনৈতিক সভায় নিয়ে এসে “বামপন্থী মানেই শিক্ষিত” এই বার্তা সমাজে ছড়িয়ে দেওয়া।
“বৈজ্ঞানিক রিগিং”কে মাথায় রেখেও বলছি অনিলায়নের সম্ভবত সর্বশ্রেষ্ঠ আবিষ্কার এই নিয়ন্ত্রিত-দুর্নীতির মাধ্যমে এসএসসিতে শিক্ষক নিয়োগ। মূলত তিনটি ধাপে সম্পন্ন হত এই নিয়ন্ত্রিত দুর্নীতি :
১। এসএসসির লিস্ট বেরোলেই লোকাল কমিটির কাছে সেই লিস্ট পৌঁছে দিয়ে লিস্টে থাকা ছেলে-মেয়েদের অ্যাকাডেমিক রেকর্ড বার করে নেওয়া। এরপর তাদের তিনটি গ্রুপে ভাগ করা হত। যেমন—
ক) ভাল পড়াশোনায় কিন্তু অরাজনৈতিক পরিবার : এক্ষেত্রে মেরিট লিস্টে থাকা ছেলে বা মেয়েটির বাবাকে রাস্তাতে বিভিন্নভাবে ভয় দেখানো যে এ সুযোগ গেলে পরে আসে না আবার। তাই তুমি চল আমরা পার্টিকে বলে ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।
খ) মোটামুটি পড়াশোনায় কিন্তু অরাজনৈতিক পরিবার : এক্ষেত্রেও প্রথমবারের মতোই বিষয়, শুধু সাথে ধার্য্য হত পরিবারের আর্থিক সামর্থ্য অনুযায়ী ৮০ হাজার থেকে ১.৫ লক্ষ টাকা অব্দি চাঁদা। তবে এইক্ষেত্রে চাঁদা দেওয়ার ব্যাপারটি দেখানো হত ভীষণ নিষিদ্ধ একটি ব্যাপার। মানে বলা হত চাঁদাটা বিভিন্ন জায়গায় আমরা সেটিং করার জন্যে নেব কিন্তু তুমি আমাদের অমুক দাদাকে ভুলেও বলবে না। জানোই তো, আমাদের পার্টিতে এসব চলে না কিন্তু তোমার মেয়েটা পড়াশোনায় এত ভাল আমরা এইটুকু না করতে পারলে নিজেদেরই খারাপ লাগবে।
আরও পড়ুন-বেআইনিভাবে বাংলার ২২ হাজার কোটি পেল বিজেপির তিন রাজ্য
উপরের দুই ক্ষেত্রেই যারা সুবিধে নিয়ে ঢুকত তাদের নিয়ম করে পার্টি অফিসে হাজিরা, কমরেডদের ছেলেমেয়েদের বাড়ি গিয়ে পড়ানো, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে চাঁদা দেওয়া ইত্যাদি বাধ্যতামূলক ছিল।
গ) প্রবল বাম-বিরোধী বা কংগ্রেসি পরিবারের কেউ মেরিট লিস্টে থাকলে তাকে মার্কড করে আলিমুদ্দিনে জানানো হত। এক্ষেত্রে অ্যাকাডেমিক রেকর্ড যত ভালই হোক না কেন আলিমুদ্দিন থেকে বিচার করা হত লিস্টে থাকা ব্যক্তির বাপ-ঠাকুরদার করা কাজের জন্যে কতটা শাস্তি দেওয়া হবে।
২। পার্টির মূল্যবান নেতাদের ছেলে-মেয়েদের চাকরির জন্যে নেওয়া হত এই পথ। পরীক্ষার মূল পেপার সেটার থাকত বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজে কর্মরত কোনও আদর্শবাদী কমিউনিস্ট প্রফেসর যিনি ফাইনাল প্রশ্নপত্রের প্রশ্নগুলি চিরকুটে লিখে এনে দিয়ে দিতেন। এই প্রশ্ন সাধারণ স্তরের কমরেডরা পেত না।
৩। ছাত্রসংগঠনে যুক্ত থাকা যুব কমরেডদের জন্যে থাকত রেকমেন্ডেশনের ব্যবস্থা। তাদের পারফরম্যান্স অনুযায়ী তারা হয় ২ নম্বর পদ্ধতিতে প্রশ্ন পেত নাহলে পরীক্ষায় পাশের পরে ইন্টারভিউতে বিশেষ ব্যবস্থা থাকত। এদের থেকে কোনও টাকা-পয়সা নেওয়া হত না। কনুই বা হাতের ব্যবহার কোনও নেতা করে থাকলে তার দায়ভার অবশ্যই পার্টিকে দেওয়া যায় না।
৪। যারা কোনওভাবেই পার্টির সাথে না এসে ইন্টারভিউ দিতে যেত তাদের জন্যে থাকত এই পথ। নিজেদের লোক ঢোকানোর পরে লোকসমাজে নিরপেক্ষ থাকার জন্যে ১০-১৫% জায়গা ছেড়ে দেওয়া হত। সমস্ত যোগ্য এবং প্রবল বাম শাসনের সামনে মাথা নিচু না করারা এই ১০-১৫% ফাঁকা পদের জন্যে লড়াই করতেন।
অনিলায়নের চতুর্থ সূত্র : এই সূত্রের মাধ্যমে বিদ্যালয় থেকে পার্টি ফান্ডের টাকা জোগাড় এবং শিক্ষকদের ব্রিগেডের পেশি শক্তি দেখানোর রসদ সংগ্রহ করা হত।
প্রধান শিক্ষক, ম্যানেজিং কমিটি কার্যত নিজেদের দখলে নিয়ে ছাত্র সংগঠনের লোকজন দ্বারা বিদ্যালয়গুলির প্রত্যেক ছাত্র-ছাত্রীর থেকে প্রতি মাসে এক টাকা করে চাঁদা নেওয়া বা স্টুডেন্টস হেলথ হোমের চাঁদা ইত্যাদি তোলা হত। ব্রিগেড সমাবেশ-সহ একাধিক সমাবেশে এই ছাত্রছাত্রীদের তুলে নিয়েও যাওয়া হত।
আরও পড়ুন-চেনাব রেল প্রকল্প: নাড্ডার মিথ্যাচার, কড়া জবাব কাকলির
আজকের লেখা শুধুমাত্র বিদ্যালয়ে অনিলায়নের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখছি। আপনাদের অনেকেই ভাববেন আমি সঠিক বলছি কিনা। আমি বিজ্ঞানী মানুষ, তথ্য ছাড়া কথা বলি না। আপনাদের কাছাকাছি সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত বিদ্যালয়গুলিতে গিয়ে জানুন ১৯৯৭-২০০৭ অব্দি ম্যানেজিং কমিটির চেয়ারম্যান কারা ছিল। তবে বামেদের আমলে একটা লোকদেখানো স্বচ্ছতা ছিল বলে কাউন্সিলর বা পঞ্চায়েত সদস্যদের একেবারেই উপায় না থাকলে তবেই ম্যানেজিং কমিটির চেয়ারম্যান বানানো হত। ২০০৯ সালে তৃণমূল কংগ্রেসের রাজনৈতিক উত্থানের ফলে বামফ্রন্ট শেষ দুই বছর অবশ্য অনিলায়নের সূত্রের ব্যতিক্রম ঘটে।
যাইহোক, কংগ্রেসের অধীরবাবু ২০০৬ সালে গ্রেফতারের সময় হুমকি দেন উনি কার কত কালো টাকা আছে সব ফাঁস করে দেবেন। এর কয়েকদিনের মধ্যেই কম— অনিল বিশ্বাস হঠাৎ মাথায় রক্ত জমে মার্ক্সলোকে গমন করেন। অনিলায়নের বিস্ময়কর আবিষ্কারের উপর তথ্যচিত্র বানানোর জন্যে শোনা যায় স্বয়ং রায়সাহেব “ব্রাহ্ম-লোক” থেকে মার্ক্সলোকে যাওয়ার আবেদন করেছিলেন।
সবশেষে একটাই কথা বলা যায়, এসএসসি পশ্চিমবঙ্গে ক্যাডার তৈরির একটি মেশিন হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। একথা অনস্বীকার্য।