মহাকাশকে সকলের কাছে সুগম করে তোলার লক্ষ্য নিয়ে খড়্গপুর আইআইটির এক প্রাক্তনী এবং ইসরোর একত্রিশ বছর বয়সি ইঞ্জিনিয়ার পবন চন্দনা ২০১৮ সালে একদিন দুম করে চাকরি ছেড়ে দিলেন। তিনি একা নন, তাঁর সঙ্গেই বেরিয়ে এলেন নাগা ভারতা ডাকা; আর তারপর দু-জনে মিলে খুলে বসলেন একটি স্টার্ট-আপ সংস্থা স্কাইরুট এরোস্পেস। যাদের কাজ আকাশে পাঠাবার মতো যন্ত্র তৈরি করা। আইআইটি খড়্গপুরের প্রাক্তনী পবন চন্দনার মূল লক্ষ্যই ছিল মহাকাশকে সকলের কাছে সুগম করে তোলা।
তারপর কেটে গিয়েছে তিন বছরেরও বেশি সময়কাল। হায়দরাবাদের ওই সংস্থাটি এবার নতুন করে খবরে এল আধুনিক এক রকেট (Rocket) বানিয়ে। ‘বিক্রম-ওয়ান’ নামে ওই রকেটটির মূল যে জ্বালানি-বহনকারী অংশ, সেটি একটানা একশো আট সেকেন্ড ধরে জ্বালানি দহন করে দেখাল যে এবার ওই রকেট আকাশে ওড়বার জন্য তৈরি। ভারতের শ্রেষ্ঠ এক মহাকাশবিজ্ঞানী বিক্রম সারাভাই-এর প্রতি এটাই সবচেয়ে বড় শ্রদ্ধার্ঘ্য।
পঞ্চাশ বছরের বেশি আগে মহাকাশে একচেটিয়া যাতায়াত করত আমেরিকা আর রাশিয়ার মহাকাশবিজ্ঞানীদের তৈরি মহাকাশযান। তারপর আস্তে আস্তে ইউরোপ, চিন, জাপান বা ভারত সেই দলে নাম লেখাল এবং এরাও কয়েক বছরের মধ্যে প্রথম সারিতেই চলে আসে। তখনও মহাকাশযাত্রার যাবতীয় সবকিছুই আয়োজিত হত সম্পূর্ণ সরকারি উদ্যোগেই। আশির দশকে আস্তে আস্তে এই উদ্যোগে শামিল হতে থাকে বেসরকারি সংস্থাও। প্রথমে যৌথভাবে, তারপর সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে এরা আকাশে পাঠাতে থাকে নিজেদের তৈরি মহাকাশযান। প্রথম যে কোম্পানিটি এই কাজে সফল হয়, সেই জার্মান কোম্পানির নাম অট্রাগ (OTRAG)।
একুশ শতকে এসে দেখি এরকম সংস্থা হুড়মুড়িয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। ভার্জিন, গ্যালাক্টিক, ব্লু অরিজিন এরকম বহু সংস্থাই আজ মহাকাশ-যাত্রার যাবতীয় কাজ নিজেরাই করে ফেলার মতো দক্ষতা অর্জন করেছে। সুতরাং বেসরকারি উদ্যোগে রকেট তৈরিও আজ নতুন কিছু ব্যাপার নয়। বেশ কিছু দেশেই এরকম বহু সংস্থা রকেট (Rocket) বা মহাকাশযান বানিয়ে আকাশে পাঠাচ্ছে, এমনকী সাধারণ মানুষকে মহাকাশে পাঠিয়ে ঘুরিয়ে দেখিয়ে আনবার দৃষ্টান্তও দেখা যাচ্ছে প্রায়ই। ব্যক্তিগতভাবে নিজেদের খরচে (স্বাভাবিকভাবেই সে খরচ ধনকুবের ছাড়া কারও পক্ষে বহন করা মোটেই সম্ভব নয়) বেশ কয়েকজন ব্যক্তি ইতিমধ্যে আকাশে ভ্রমণ সেরেও এসেছেন, খবরের শিরোনামে এসেছে সে ঘটনা। ‘স্পেস ট্যুরিজম’ নামে নতুন একটি শব্দবন্ধও তৈরি হয়েছে এই ধরনের ঘটনা আজকাল সহজলভ্য হয়ে যাওয়ার ফলে। ইলন মাস্ক নামে এক আমেরিকান ধনকুবের তৈরি করেছেন ‘স্পেস-এক্স’ নামে এক প্রাইভেট মহাকাশ-যান উৎক্ষেপণ কোম্পানি, যার মূল কাজ মহাকাশে মানুষ বা যান পাঠানো, এ খবরও জানা আছে অনেকের। তবে এর সবই বিদেশি উদাহরণ, ভারতের বুকে সম্পূর্ণ বেসরকারি উদ্যোগে রকেট তৈরির উদাহরণ এই প্রথম।
স্কাইরুট এরোস্পেস বছর দুয়েক আগে তৈরি করেছিল এইরকম রকেটের পুরনো এক রূপ, যা ছিল এখনকার চেয়ে কিছুটা কম শক্তিশালী, আকারেও কিছুটা ছোট। তবে এবারেরটি এখনও অবধি আকারে সবচেয়ে বড়। এবারের ওই রকেটটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘কালাম-ওয়ান’। আমাদের দেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি এ পি জে আবদুল কালামের নামে নামকরণ করা হয়েছে এই স্টেজ থ্রি রকেটটির। এই স্টেজ-থ্রি রকেট কথার অর্থ এটি আগের দুটি স্টেজ-রকেটের চেয়ে অনেক বেশি আধুনিক এবং শক্তিশালী। কার্বন ফাইবার দিয়ে তৈরি এই রকেটটিতে ভরা হয় কঠিন জ্বালানি, এবং এর শরীর তৈরি হয়েছে ইথিলিন-প্রোপিলিন-ডিয়েন টারপলিমার দিয়ে, যা একে প্রচণ্ড গরম অবস্থাতেও রক্ষা করে। রকেটটির (Rocket) জ্বালানি-দহনের সময়কালের একটি ভিডিওটি প্রকাশ্যে এসেছে, সেখানে দেখা যাচ্ছে পুরো একশো আট সেকেন্ড ধরে কী বিপুল পরিমাণে আগুন আর আলোর ঝলকানি তৈরি হচ্ছে যন্ত্রটির গা বেয়ে। ওই সংস্থার তরফে জানানো হয়েছে যে এই রকেটটির সাহায্যে প্রায় পাঁচশো কেজি বস্তু নিয়ে আকাশে পাঁচশো কিলোমিটার দুরত্ব অবধি পৌঁছে দিয়ে আসা যাবে। একটা কৃত্রিম উপগ্রহকে তার কক্ষপথে স্থাপন করে দিয়ে আসতে এই রকেটের কোনও সমস্যাই হবে না। স্কাইরুটের কর্তাব্যক্তিরা আশাবাদী, এবার সম্পূর্ণ রকেটটিকে আকাশে পাঠাবার পথে আর কোনও বাধা নেই, ওই কাজটি অদূর ভবিষ্যতেই ওঁরা সম্পন্ন করবেন।
আরও পড়ুন: জলে তলিয়ে গেল অস্থায়ী বালাসন সেতু
স্কাইরুট-এর ওয়েবসাইটে গেলে দেখা যাবে জ্বলজ্বল করছে তাদের মূল লক্ষ্য— ‘অ্যাফোর্ডেবল, অন-ডিম্যান্ড অ্যান্ড রিলায়াবল রাইড টু স্পেস।’ রাইড বলতে আমরা এতকাল নাগরদোলায় চেপে কয়েক পাক ঘুরে আসা বুঝতাম, আগামী দিনে টুক করে স্পেস-শ্যুট পরে মহাকাশে একচক্কর ঘুরে আসাই হয়ত আসল রাইড বলে গণ্য হতে চলেছে। স্কাইরুট সেই লক্ষ্যেই কাজ করে চলেছে। সাধে কি আর পবন চন্দনাকে আগামী দিনে ভারতের ইলন মাস্ক বলে ডাকা শুরু হয়েছে?