গোয়েবেলসের আয়নায় স্তালিনকে দেখেছি

Must read

মিথ্যাচার আর বিরুদ্ধমত রুদ্ধ করতে অত্যাচার, এই দুটি বিষয়ে হিটলার, মুসোলিনি, ইদি আমিন, স্তালিন, কিম, এঁদের মধ্যে আদৌ কোনও প্রভেদ আছে কি? প্রকারান্তরে বাংলার বামেদের মতো ভারতের গেরুয়া শিবির কি এঁদেরই অর্চনা করছে না? প্রশ্ন তুলেছেন দেবাঞ্জন দাশ

আরও পড়ুন-“এবার আমার পাঠানো বর্ণপরিচয় ওনার কাজে আসবে”, দিলীপকে ফের খোঁচা বাবুলের

স্তালিন, হিটলার, মুসোলিনি, সবাই আজ এক আসনে। একথা শুনলে লাল ও গেরুয়া, উভয় শিবিরই রে রে করে তেড়ে আসবে, কিন্তু ইতিহাস ও বর্তমান সে কথাই বলছে।
বাম জমানায় বাংলা দেখছে, স্তালিনকে নিয়ে সি পি এম-এর কত অনুরাগ! শুধু পার্টি অফিসে বড় বড় ছবি নয়, তাঁকে মনীষী হিসেবে মান্যতা দিয়ে দলের ভেতরে গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার দোহাই দিয়ে আর দলের বাইরে, রাজ্য জুড়ে সুশাসনের অজুহাতে প্রতিবাদী কণ্ঠ রুদ্ধ করার সবরকম আয়োজন চলত। তাই তাঁরা এখন ‘শূন্য’।
গেরুয়া শিবির প্রকাশ্যে স্তালিনের নাম করে না। তাঁদের পূর্বজরা হিটলারের প্রতি প্রীতি পক্ষপাত দেখিয়েছিলেন। তাঁরা গোয়েবলসের কায়দাকানুন রপ্ত করে ভোট যুদ্ধে বাজিমাত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু স্তালিনে তাঁদের বড্ড অ্যালার্জি। অথচ, প্রতিবাদীর কণ্ঠ রুদ্ধ করতে তাঁরাও স্তালিনের রীতি নীতি, কায়দাকানুন, ভালই রপ্ত করেছেন। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে কেন্দ্রীয় এজেন্সি নামিয়ে ঠেকানোর চেষ্টা হোক বা সোনু সুদের বাড়িতে আয়কর অভিযান চালিয়ে তাঁকে কালিমালিপ্ত করার প্রয়াস হোক, সর্বত্রই সেই স্তালিনের ছায়া স্পষ্ট। যত দিন যাচ্ছে, যত রাজ্যে রাজ্যে জনপ্রিয়তা তলানিতে ঠেকছে, তত স্তালিনের আত্মা যেন আরও বেশি করে চেপে বসছে বিজেপির ঘাড়ে।
এক হাজারবার একটা জিনিসকে ‘সত্যি’ বললে সেটাই সত্যি হয়ে ওঠে। এটা অবশ্যই নাৎসি বাহিনীর ‘প্রপাগান্ডা’। বঙ্গসিপিএম চুপচাপ সেটা নিঞ্জা টেকনিকের মতো শিখে নিয়েছিল। ভারতীয় জুমলা পার্টিও এখন সে পথেই হাঁটছে। পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনের সময় থেকে এটা আরও বেপরোয়া রূপ নিয়েছে।

আরও পড়ুন-মমতায় আপ্লুত বাবুল, তৈরি মাঠে নামার জন্য

আমি বর্তমানে পোল্যান্ডের বাসিন্দা। এখানে আসলে, এখানকার মিজিয়ামে গেলে স্পষ্ট বোঝা যায় স্তালিনও হিটলারের মতোই স্বৈরাচারী, গণহত্যাকারী। হিটলারের হলোকাস্ট যতটা নিন্দনীয় এবং ন্যক্কারজনক, স্তালিনের হলডোমোর ততটাই ধিক্কারযোগ্য।
‘হলডোমোর’ কথাটার মানেই হল ‘অনাহার দ্বারা হত্যা’। ১৯৩২-১৯৩৩ সালে ভয়ঙ্কর খরা পরিস্থিতির সম্মুখীন হয় বর্তমান পূর্ব ইউরোপের বহু দেশ, যা তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ছিল। ফলে, ইউক্রেনেই মারা যান প্রায় ৪০ লক্ষ মানুষ। ইউক্রেন সহ ১৬টি দেশ হলডোমোরকে সম্পূর্ণভাবে গণহত্যা বলে অভিহিত করার সাহস দেখায় ২০০৫ সালে, সোভিয়েত পতনের প্রায় ১৭ বছর পর।
হলডোমোর খুব সুন্দরভাবে পরিকল্পিত হয় যাতে এক শ্রেণির মানুষকে স্রেফ মুছে ফেলা যায়। যখন ইউক্রেনের দুর্ভিক্ষ শুরু হয়ে তখন স্তালিন তা সামাল দেবার কোনও চেষ্টাই করেননি। তিনি প্রায় দুই মিলিয়ন টন খাদ্য ইউক্রেনের বাইরে রফতানি করেছিলেন। সেখানকার মানুষদের বিদেশে যাওয়ার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। তাদের কোন খাবার ছিল না, পালানোর কোনও উপায় ছিল না – অপেক্ষা এবং মরা ছাড়া কিছুই করার ছিল না। প্রত্যেক শহরের শহরে রেশনগুলি মারাত্মকভাবে সরবরাহ আটকে দেওয়া, উদ্দেশ্য একটাই যাতে না খেতে পেয়ে মারা যায়। এমনকি সমস্তরকম সাহায্য থেকেও বঞ্চিত করা দূর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষদের। সেসময় ইউক্রেনে কম করে হাজার দশেক মানুষ নরমাংস খেয়ে বেঁচে থাকতে বাধ্য হয়েছিলেন।

আরও পড়ুন-কাল আগরতলায় পদযাত্রা অভিষেকের, তুঙ্গে কৌতূহল

একই ছবি গুলাগেও। স্তালিন জমানায় প্রায় এক কোটি ৪০ লক্ষ লোককে গুলাগে বন্দি করা হয়। বেশির ভাগই রাজনৈতিক বন্দি কিংবা সাধারণ জনগণ যারা সোভিয়েত শাসন সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করেছেন। ঠিক যেভাবে ইউএপি আইনে বন্দি করাটা মোদি-শাহ জমানার রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছে, এটাও ছিল সেসব বন্দিদের অনেকেই নাকি খিদের দাপটে ইঁদুর কিংবা বন্য কুকুর খেতেও পিছপা হত না।
মলটোভ-রিবেনট্রপ, হিটলার ও স্তালিনের মধ্যে চুক্তির পর সোভিয়েত পোল্যান্ড আক্রমণ করে ১৭ইসেপ্টেম্বর। সোভিয়েত গুপ্ত পুলিশ সংস্থা এনকেভিডি কম করে ৩ লক্ষ মানুষকে ট্রেনে চাপিয়ে নিয়ে যায় বর্তমান রাশিয়ায়। ১৩ই এপ্রিল, ১৯৪৩ রেডিও বার্লিন জানায় জার্মান সেনাবাহিনী রাশিয়ার স্মোলেনস্কের কাছে ক্যাটনিয়ার জঙ্গলে কয়েক হাজার পোলিশ যুদ্ধবন্দির দেহাবশেষ এবং গণকবর আবিষ্কার করেছে। সেখানে উপস্থিত করা হয় জার্মানদের হাতে থাকা আমেরিকান যুদ্ধবন্দি ডোনাল্ড স্টুয়ার্ট এবং জন ভন ভ্লিট কে। তাঁদের দেওয়া রিপোর্ট বহু বছর পর ২০১৪ নাগাদ ফ্রান্সে প্রকাশিত হয়। সেসময় গণকবর থেকে পাওয়া কিছু জিনিস – যেমন সামরিক পোশাক, টুপি, জুতো, চিরুনি, চশমা, জামার বোতাম ইত্যাদি পরীক্ষা করে দেখা যায় যে ১৯৪০ এর মাঝামাঝি এই হত্যাকান্ড ঘটানো হয়েছে। কার্কভ, ক্যাটিনিয়া, বুকোভিনস্কা সহ বিভিন্ন ক্যাম্পে থাকা ১৪ হাজার ৭০০ জন পোলিশ যুদ্ধবন্দী সহ আরও ১৫হাজার যুদ্ধবন্দিকে গুলি করে হত্যার নির্দেশ দেন স্বয়ং জোসেফ স্তালিন। আজ কার্কভ, ক্যাটিনিয়া, বুকোভিনস্কাতে স্তালিন জমানায় গণহত্যায় মৃতদের স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি হয়েছে। ক্যাটিনিয়াতে পাওয়া অধিকাংশ জিনিসই আজ সংরক্ষিত আছে ওয়ারশা শহরের ক্যাটিনিয়া মিউজিয়ামে।
এই সবের পরে প্রশ্ন এসেই যায় হিটলার, মুসোলিনি, ইদি আমিন, স্তালিন কেন এক আসনে বসবেন না? কেন ৩৪ বছরে বাংলায় বাম জমানা আজকের ভারতে মোদি-শাহ জমানার সঙ্গে উপমিত হবে না? গোয়েবেলসের আয়নায় আমি তো স্তালিনকেই দেখে ফেলেছি।

Latest article