এম ৮৩!
—কী ভাবছেন, কোনও আমেরিকান সিআইএ-র গোয়েন্দা? নাহ্, কোনও জেমস বন্ডও নন। এটা মেসিয়ার ৮৩, পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৫ মিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে আনুমানিক চল্লিশ হাজার আলোকবর্ষ চওড়া, মহাকাশের হাইড্রা (দ্য সি সারপেন্ট বা সামুদ্রিক বিছের মতো দেখতে তাই এই তারামণ্ডলের নাম হাইড্রা) তারামণ্ডলের দক্ষিণ-পূর্ব মাথায় অবস্থিত বৃহৎ, উজ্জ্বল এবং সুন্দর একটি স্পাইরাল গ্যালাক্সি বা সর্পিল ছায়াপথ।
আরও পড়ুন-এবার ইমরানের দল পিটিআই-কে নিষিদ্ধ করতে মাঠে নেমেছে পাক সরকার!
অ্যাস্ট্রোফোটোগ্রাফিক বিস্ময়
গত ৩ জুন আমেরিকার ন্যাশনাল অ্যারোনটিক্স অ্যান্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (নাসা)-এর পক্ষ থেকে এই সর্পিল ছায়াপথের একটি ছবি পোস্ট করে বৈজ্ঞানিক মহলে নতুন কৌতূহল সৃষ্টি করেছে— এই ছায়াপথের এক অংশে নাকি অসংখ্য অপত্য তারার সৃষ্টি হচ্ছে! ওই নির্দিষ্ট ছবিটি সংগ্রহ করেছেন অস্ট্রেলিয়ার একজন সুপরিচিত অ্যামেচার অ্যাস্ট্রোনোমার এবং অ্যাস্ট্রোফোটোগ্রাফার মাইকেল সিডোনিয়া, স্টারলাইটক্সপ্রেস অ্যান্ড ফিংগার লেকস ইনস্ট্রুমেন্টেশন সিসিডি ক্যামেরা ব্যবহার করে। তিনি তাঁর জ্যোতির্বিদ্যার গবেষণার সঙ্গে সঙ্গে অ্যাথলেটিক্সের সঙ্গেও গভীরভাবে যুক্ত এবং এজন্য তিনি বৈজ্ঞানিক মহলে ‘স্ট্রংম্যানমাইক’ নামে পরিচিত। তাঁর উল্লেখযোগ্য গবেষণাগুলোর মধ্যে অন্যতম হল, পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১১ মিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত একটি ছায়াপথের আবিষ্কার। তাঁর তোলা মহাকাশ চিত্রগুলো অস্ট্রেলিয়ার ক্যানবেরায় অবস্থিত ন্যাশনাল সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি সেন্টারে প্রদর্শিত হয়। তিনি বিখ্যাত টিনডেরি পর্বতে অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে উঁচু অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল অবজারভেটরি ‘দি ঈগলভিউ অবজারভেটরি’ প্রতিষ্ঠা করেন এবং সাম্প্রতিক এই ছবিটিও ঈগলভিউ পর্যবেক্ষিকা থেকেই তোলা হয়েছে।
আরও পড়ুন-রাজ্যসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারাল এবার বিজেপি
গ্যালাক্সি পরিচিতি
অসংখ্য তারামণ্ডিত এই সর্পিল ছায়াপথ; যেন ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টিতে ক্ষুদ্র গ্যালাক্সির বিশাল হাত! ১৭৫২ খ্রিস্টাব্দে ফরাসি অ্যাস্ট্রোনোমার নিকোলাস লুই ডে ল্যাকাইল এই ছায়াপথটি আবিষ্কার করেন, এই ছায়াপথটির আনুমানিক বিশালত্ব বা ম্যাগনিচুড হল ৭.৫। কয়েক দশক পরে অন্য একজন ফরাসি অ্যাস্ট্রোনমার এবং বিখ্যাত ধূমকেতু হান্টার বিজ্ঞানী চার্লস মেসিয়ার এই গ্যালাক্সিটিকে ‘ডিপ স্কাই অবজেক্ট’ হিসেবে পৃথিবী বিখ্যাত ক্যাটালগের অন্তর্ভুক্ত করেন। মেসিয়ার নামটি তাঁর নাম থেকেই এসেছে। মেসিয়ার ৮৩ হল রাতের আকাশে দৃশ্যমান সবচেয়ে বেশি উজ্জ্বল ছায়াপথগুলোর মধ্যে অন্যতম। প্রতি বছর মে মাস নাগাদ একজোড়া বাইনোকুলারের সাহায্যে খুব সহজেই একে চিহ্নিত করা যায় ওই নিসর্গের বুকে। এই ছায়াপথটি আমাদের ছায়াপথ মিল্কিওয়ের চেয়ে আনুমানিক আড়াই গুণ ছোট, তবে প্রায় সদৃশ। দ্য মিল্কিওয়ে এবং মেসিয়ার ৮৩-র কেন্দ্রস্থলে একইরকম নক্ষত্রের গোলাকার পিণ্ডাকৃতি অবস্থান লক্ষণীয়।
এই ছায়াপথটির মধ্যে কয়েকশো হাজার নক্ষত্র, কয়েক হাজার নক্ষত্র জটলা বা স্টার ক্লাস্টার, এবং শ’য়ে শ’য়ে মহাকাশ ঝঞ্ঝা সুপারনোভার দরুন সৃষ্ট ছিট-ছাট বা অবশিষ্টাংশ রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে প্রায় ৩০০টি সুপারনোভার ঘটনা এই গ্যালাক্সির মধ্যে আন্তঃনাক্ষত্রিক বাবলস বা বুদবুদ তৈরি করেছে, যা সেই সমস্ত নক্ষত্রের প্রকৃতি সম্পর্কে ধারণা দেয়, যে-সমস্ত নক্ষত্র সুপারনোভার কারণে বিষ্ফোটিত হয়। অতঃপর তাদের পারমাণবিক প্রক্রিয়াজাত রাসায়নিক উপাদানগুলোকে ছায়াপথের বুকে পুনরায় ছড়িয়ে দেয় এবং এখান থেকেই নতুন শিশু-তারার জন্ম হয়।
আরও পড়ুন-ফের রাজ্য পুলিশের ডিজি পদে রাজীব কুমার
বিশেষ বৈশিষ্ট্য
পৃথিবীর ছায়াপথ দ্যা মিল্কিওয়ের মতোই একই বৈশিষ্ট্যযুক্ত নতুন জেনারেশন নক্ষত্রের উদ্ভাবক ছায়াপথ দ্যা মেসিয়ার ৮৩-র বিস্তৃত সর্পিলবাহু রয়েছে। এইরকম বিশেষ সর্পিল আকৃতির জন্য একে ‘দক্ষিণান্তের পিনহুইল’ বলা হয়, এবং এই বাহুর শেষপ্রান্তে ঘন ধূলিময় গলিতেই রয়েছে ‘নিউলি স্টার ফর্মিং রিজিয়ন’। অতিবেগুনি রশ্মি এবং রেডিও তরঙ্গের মাধ্যমে সাম্প্রতিক সময়ে ছায়াপথটির এই বিশেষ অঞ্চল পর্যবেক্ষণের ফলে দেখা গেছে, ওই এলাকার কেন্দ্রস্থলে রয়েছে অপত্য নক্ষত্রের গর্ভবতী চাক এবং অসংখ্য ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বেবি স্টার। ওই অংশটি অত্যন্ত উষ্ণ গ্যাসের চাদরে মোড়া, যার আনুমানিক তাপমাত্রা ৭ মিলিয়ন ডিগ্রি সেলসিয়াস। এই বিশাল গ্যাসীয় চাদরটি উজ্জ্বল উত্তপ্ত হাইড্রোজেন গ্যাসে; এছাড়াও রয়েছে নতুন তারা থেকে নির্গত অতিবেগুনি রশ্মি, আয়নিত আলোকচ্ছটা, যা গ্যালাক্সির ওই অঞ্চলে অসংখ্য সহস্র নাক্ষত্রিক উজ্জ্বল চুনির মতো লাল রঙের আলোর ঝলকানি সৃষ্টি করে। এইজন্যই ওই অংশটিকে বলা হয় ‘এ থাউজ্যান্ড রুবিস গ্যালাক্সি’ বা সহস্র চুনির ছায়াপথ।
আরও পড়ুন-কোপা চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্তিনা, হারল কলম্বিয়া
বিশেষ আকর্ষণ
মেসিয়ার ৮৩ ছায়াপথটি হল ওই মহাশূন্যে সুপারনোভা সৃষ্টিকারী সবচেয়ে ঊর্বর ছায়াপথগুলোর মধ্যে অন্যতম। গত ১০০ বছরের মধ্যে যে গ্যালাক্সি দুটো কমপক্ষে ৬টি সুপারনোভা ঘটিয়েছে, তাদের মধ্যে এই ছায়াপথটি বৈজ্ঞানিক মহলে আলোড়ন ফেলে দিয়েছে; অন্যটি এসএন ১৯৫৭ডি গত ৩০ বছর ধরে পর্যবেক্ষণক্ষম ছিল। সহস্র চুনির ছায়াপথ বাদেও বিজ্ঞানীদের চোখে এই গ্যালাক্সিটির আরও একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে, তা হল ওই সর্পিল বাহু বরাবর উষ্ণ নাক্ষত্রিক আলোর প্রতিপ্রভা, যা বাহু বরাবর ঝাপসা ধূলিধুসরিত উজ্জ্বল নাক্ষত্রিক বেলোর্মি স্রোতের মতো বয়ে চলেছে। এই ঘটনাটি প্রথম লক্ষ্য এবং প্রকাশ করেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার অ্যাংলো-অস্ট্রেলিয়ান অবজারভেটরিতে কর্মরত বিজ্ঞানী ডেভিড মালিন এবং ইংল্যান্ডের এডিনবার্গে অবস্থিত রয়েল অবজারভেটরিতে কর্মরত বিজ্ঞানী ব্রায়ান হ্যাডলি। ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে তাঁরা অ্যাংলো-অস্ট্রেলিয়ান অপটিক্যাল অবজারভেটরির স্মিট টেলিস্কোপের সাহায্যে তোলা ছবি নিয়ে সেগুলো রয়েল অবজারভেটরিতে ডিপ অ্যাম্প্লিফায়েড ফোটোগ্রাফিক প্লেট আর্কাইভের সাহায্যে তাঁরা এই হালকা কোমল আলোকপ্রভা পর্যবেক্ষণ করেন। এটি আসলে অপত্য তারাদের উষ্ণ গ্যাসের মধ্যে দিয়ে প্রবাহের কারণে আয়নিত হওয়ার ফল।
বিস্ময়কর ব্রহ্মাণ্ড
মেসিয়ার ৮৩-র বুকে লক্ষণীয় উজ্জ্বল লাল রঙগুলো ইনফ্রারেড বা অবলোহিত বা লাল উজানি রশ্মি এবং নতুন সৃষ্ট তারাদের থেকে উৎপন্ন উজ্জ্বল হাইড্রোজেন গ্যাসের; নীল রঙ অক্সিজেনের দরুন এবং পুরাতন নক্ষত্র থেকে নিঃসৃত হয়ে যায় অতিবেগুনি রশ্মি। নতুন জন্ম নেওয়া নক্ষত্রগুলো ধীরে ধীরে ওই গ্যালাক্সির বাহু প্রান্তে ঘন জটলাকারে জমা হয়। বিজ্ঞানীদের ধারণা এই ছায়াপথটির মধ্যে অসংখ্য নতুন তারা জন্মানোর প্রক্রিয়া সতত এবং যে নক্ষত্রগুলো মেঘ আকারে ওই অঞ্চলে স্থিত সেগুলো খুব বেশি পুরাতন নয়। তাই তাদের থেকে অতিরিক্ত পরিমাণ অতিবেগুনি রশ্মি নির্গত হচ্ছে, এই আলোক রশ্মি ওই স্থানে মজুত গ্যাসীয় মেঘজটলা শোষণ করছে। ফলস্বরূপ চারদিক উজ্জ্বল লাল গোলাপি হাইড্রোজেন আলোয় ভরে উঠছে। সত্যিই কী বিচিত্র ওই ব্রহ্মাণ্ড!