হালখাতার উৎসমুখ…

খেরোর খাতা দিয়ে যা শুরু হয়েছিল হালখাতা হয়ে হালফিলে তা এসে পৌঁছেছে কমপিউটার অর্থাৎ ডিজিটাইজড মাধ্যমে। তবু বাংলা নববর্ষ অর্থাৎ পয়লা বৈশাখে বাঙালি তার সাবেকিয়ানা নিয়ে বড় নস্টালজিক হয়ে পড়ে। সেই নস্টালজিয়া উসকে দিতেই এই অতীতচারণা। হালখাতার ইতিহাস হাটকানো। লিখলেন প্রীতিকণা পালরায়

Must read

“জীবন খাতার প্রতি পাতায় যতই লেখো হিসাবনিকাশ কিছুই রবে না” এই দার্শনিকতা প্রিয় নায়কের লিপে রুপালি পর্দায় যতক্ষণ দেখা যায় ততক্ষণই মানে রাখে। কিন্তু কাঠখোট্টা বাস্তবে পুরোটাই ‘দেওয়া-নেওয়া’! আর এই দেওয়া-নেওয়ার হিসেবে কোনও দার্শনিকতা নেই। এক্কেবারে পাই-কড়া-গন্ডার চুলচেরা হিসেব। তার থেকে বাদ পড়ে না উৎসবও। বরং বলা যেতে পারে এই হিসেবের খাতাকে কেন্দ্রে রেখেই উৎসবের আয়োজন! ঠিক তাই। আনুষঙ্গিক আর যা-ই থাকুক ‘পহেলা’ বৈশাখে (Pahela Boisakh) নতুন বছর শুরু বা তার পরবর্তীতে এই ‘পয়লা’ বৈশাখকে কেন্দ্র করে ‘নববর্ষ’ উৎসব, সবের মূলে কিন্তু বিশুদ্ধ হিসাবনিকাশ। হালখাতার উৎস সন্ধানে গেলে তেমনটাই চোখে পড়বে।

অনেকেই মনে করেন ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট আকবর নতুন সন প্রবর্তনের পর থেকেই হালখাতার প্রচলন হয় এদেশে। কৃষিপ্রধান দেশ ভারতবর্ষ । নির্দিষ্ট সময়ে আঞ্চলিক নবাব ও জমিদারদের থেকে সম্রাটের রাজস্ব আদায়ের জন্য ও কৃষকদের জমি থেকে ফসল তুলে জমিদারদের নিকট বকেয়া খাজনা মেটানোর সময়ের মধ্যে ভারসাম্য আনতেই এই সর্বভারতীয় নতুন ইলাহি সনের প্রবর্তন। বাংলায় প্রথমে এটি ‘ফসলি সন’ হিসেবে পরিচিত ছিল— পরে যা বঙ্গাব্দ বা বাংলা নববর্ষ হিসাবে পরিচিতি পায়। এই হিসাবমতো চৈত্র মাসের শেষ দিন অর্থাৎ সংক্রান্তির দিনে জমিদারের সেরেস্তার প্রজাদের কাছ থেকে কৃষি ও রাজস্ব কর বা খাজনা আদায় করত। আর পয়লা বৈশাখের দিন হত ‘পুণ্যাহ’ অনুষ্ঠান। পরবর্তীতে এই ‘পুণ্যাহ’ অনুষ্ঠানই ‘নববর্ষ’ উৎসবে বদলে যায়। এদিন প্রজারা খাজনা মেটানোর পর মিষ্টিমুখ করতে আসত সেই সঙ্গে নতুন বছরের হিসাবনিকাশ নতুন করে শুরু হত। আর এই কাজেই লাগত ‘হালখাতা’। আজকের দিনে বসে মনে হতে পারে হিসাবনিকাশটা কীসের। কারণ সে-জমিদারিও নেই সেই প্রজাও নেই। আসলে সাম্প্রতিক ‘হালখাতা’র অনুষ্ঠান পুরোটাই ব্যবসাকেন্দ্রিক হলেও আগে এটা সম্পূর্ণভাবে ছিল কৃষিভিত্তিক। দরিদ্র কৃষকদের হাতে নগদ টাকা খুব কম থাকত। জমির ধান-পাট-সহ নানান ফসল ছিল টাকার উৎস। তাই ফসলের মরশুমে ফসল ওঠার আগে অবধি প্রয়োজনীয় পণ্য তারা সম্বৎসর ধারেই কিনত কিংবা নগদ অর্থের দরকার পড়লে জমি বা জমির ফসল বন্ধক রেখে তা ধার হিসাবে নিত। এসব হিসেবপত্রই সেরেস্তারা নামে নামে সারা বছর লিখে রাখতেন হালখাতায়, বছর শেষে যা কড়ায়গন্ডায় উশুল করা হত। তবে সম্রাট আকবরের সঙ্গে পয়লা বৈশাখ (Pahela Boisakh) ও হালখাতার ইতিহাসের কথা সম্যকভাবে জড়িত থাকলেও সমাজতত্ত্ববিদদের মতে ‘হালখাতা’র প্রচলন তারও অনেক আগে। আদিম মানুষ যাযাবর বৃত্তিতে অভ্যস্ত ছিল। কিন্তু চাষ-আবাদ শুরু এবং সে-কাজে হাল বা লাঙলের ব্যবহার শেখার পর ধীরে ধীরে তারা গোষ্ঠীবদ্ধ হয় ও এক জায়গায় স্থায়ী বসবাস শুরু করে। জীবনধারণের প্রয়োজনে তখন থেকেই চাষ করা দ্রব্যের বিনিময় প্রথা শুরু হয়। এই লাঙল বা হালের দ্রব্যের বিনিময়ের হিসেব রাখা হত তৎকালীন বিশেষ কোনও খাতায়। সেই থেকেই ‘হালখাতা’ শব্দটির প্রচলন। ‘হাল’ শব্দটি সংস্কৃত ও ফারসি দুটি শব্দ থেকেই এসেছে বলে মনে করা হয়। সংস্কৃত হলে তার মানে লাঙল আর ফারসি হলে তার মানে নতুন। তাই দুটিই ‘হালখাতা’র উৎসবের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ। এই প্রাচীন হালখাতার অনুকরণেই আকবর তাঁর আমলে নতুন করে হালখাতার প্রচলন করেন। কিন্তু প্রথমদিকে অর্থাৎ প্রাচীন যুগে হালখাতা ব্যবহারের সময়ে এর সঙ্গে বৈশাখ মাসের পয়লা তারিখের কোনও সংযোগ ছিল না। কারণ প্রাচীন কালে বছরের গণনা শুরু হত হিম বা শরৎকাল থেকে। ঋতু হিসাবেও বছর গণনা করতে দেখা যেত। তাই হালখাতা ও পয়লা বৈশাখ যে সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে সেটা প্রচলিত হয়েছে সম্রাট আকবরের আমল থেকে।

আরও পড়ুন-বঙ্গাব্দ মানে বাদশাহি পাঞ্জা

‘হালখাতা’ বললেই যে চেহারাটা চোখে ভেসে ওঠে, মোটা লাল রংয়ের খাতা। কিন্তু ‘হালখাতা’র রূপও বিবর্তিত হয়েছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। আগে ব্যবহৃত হত ঢাউস আকৃতির খেরোর খাতা। চওড়ায় কম, লম্বাটে গড়নের। বর্তমানে লালরঙের খাতা ব্যবহৃত হলেও তা অনেক ক্ষেত্রেই আনুষ্ঠানিক। গ্রামের দিকে বা ছোট ব্যবসায়ীরা এখনও ‘হালখাতা’ ব্যবহার করলেও শহরাঞ্চলে বা বড় বড় ব্যবসায়ীরা হালখাতার বদলে হাল-কম্পিউটার ব্যবহারে বেশি স্বচ্ছন্দ। ব্যবহারিক জীবনে প্রযুক্তি পরম্পরার চিরকালীন দ্বন্দ্বে জয়ী হয় প্রযুক্তিই। তবে বাঙালিমাত্রেই ‘হালখাতা’র আনুষ্ঠানিকতা বজায় রাখতে চেষ্টা করেন। কারণ হালখাতা বিশেষভাবে বাঙালিয়ানার পরিচায়ক।

হালখাতা কিনে সরাসরি তা ব্যবহার করা হত না কোনও দিনই। প্রাচীন যুগ থেকে আজও পয়লা বৈশাখের ভোরে স্নান সেরে নতুন বস্ত্রে শোভিত হয়ে মন্দিরে পুজো করা হয় এই খাতা। তবে শুধু হালখাতা নয়, সঙ্গে থাকে লক্ষ্মী-গণেশের মূর্তিও। দেবী লক্ষ্মী ধন-সম্পদ, সমৃদ্ধি ও সৌভাগ্যের দেবী। আর ব্রাহ্মণ্য হিন্দু ধর্মের প্রধান পাঁচ দেবতার মধ্যে গণেশ একজন। ইনি ঘরে ঘরে সারা বছর পূজিত হন। পৌরাণিক কাহিনি মতে সর্ব দেব অগ্রে গণেশ পূজা করতে হয়, ইনি বিঘ্নবিনাশক হিসাবে পরিচিত। এই দুই কারণে হালখাতার পুজোর সঙ্গে লক্ষ্মী-গণেশ পুজোর ওতপ্রোত যোগ। সুদূর অতীতে হালখাতা অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ জানানো হত তালপাতায় পত্র লিখে। কাগজের ব্যবহার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তালপাতা বিদায় নিয়েছিল। কিন্তু কাগজে হাতে লিখে আমন্ত্রণ জানানো হত হালখাতা অনুষ্ঠানের জন্য। পোস্টকার্ডের চলও ছিল। পরবর্তীতে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ে। তাই মুদ্রিত আমন্ত্রণপত্রের চলই ইদানীং বেশি। আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তন হওয়ায় বর্তমান নগরভিত্তিক সমাজে হালখাতার ব্যবহারিক গুরুত্ব কমলেও, টেকনোলজিকে টেক্কা দিয়ে এই একটা দিন ‘হালখাতা’ তাই সগর্বে বাংলা ও বাঙালির প্রতীক হিসাবে আজও বিরাজমান।

Latest article