হিংস্র বাঘের বিচরণক্ষেত্র
নদী-জঙ্গলে ঘেরা সুন্দরবন। বিশ্বের বৃহত্তম বদ্বীপ। ভয় এবং ভালবাসা দুটোই জড়িয়ে রয়েছে নামটির সঙ্গে। পশ্চিমবঙ্গের প্রধান বাঘ সংরক্ষণ অরণ্য এটা। হিংস্র বাঘের বিচরণক্ষেত্র। এখানকার আলোকালো পরিবেশে ছড়িয়ে রয়েছে গভীর রহস্য। বিভীষিকা। পেট চালাতে পুরুষদের যেতে হয় গভীর জঙ্গলে। মুখোমুখি হতে হয় রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের। কখনওসখনও ঘটে যায় মহাবিপদ। প্রাণহানিও। কম সাহসী নন মহিলারাও। নানা কাজে হাত লাগান পুরুষদের সঙ্গে। এই জাতীয় উদ্যান পরিচিত বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ইকোসিস্টেম হিসাবে। ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট ঘোষণা করেছে ইউনেস্কো। বাঘ ছাড়াও এখানে রয়েছে কুমির, হরিণ, মাছ, সাপ, নানা প্রজাতির পাখি।
আরও পড়ুন-ধরাশায়ী বিজেপি, খেজুরির দুই সমবায়ে বিপুল জয় তৃণমূলের
গাছের রানি সুন্দরী
সুন্দরবনের বর্তমান অবস্থানটি কমপক্ষে ৪০০ বছরের পুরনো। ঝড়, সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস, ভূমিকম্প, ভূমির অবনমন এবং বিদেশি দস্যুদের অবাধ লুণ্ঠন সুন্দরবনকে বহুবার ধ্বংস করেছে। তবে বনাঞ্চলটি আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ অব্দ থেকে ১২০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই অঞ্চলে সমৃদ্ধ জনপদ ছিল। তার প্রমাণ পাওয়া যায়। সুতরাং সেই সময় ওই অঞ্চলের নামও ছিল। খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ৫০০ অব্দে সংস্কৃত বৈয়াকরণ পানিনি পতঞ্জলি মহাভাষ্যে আর্যাবর্তের সীমানা উল্লেখ করার সময় লিখেছেন, পূর্বদিকে ছিল ‘কালকবন’। কিছু বিশেষজ্ঞের মতে, ‘কালকবন’ই হল সুন্দরবন। ৩০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ থেকে ৩০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে লেখা মহাভারত এবং প্রায় ২০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে লেখা রামায়ণে গঙ্গার মোহনায় ‘শাকদ্বীপ’-এর কথা উল্লেখ আছে। অন্যান্য পুরাণেও এই শাকদ্বীপের কথা লিপিবদ্ধ আছে। গুপ্ত যুগে খ্রিস্টীয় চতুর্থ থেকে ষষ্ঠ শতক, আন্দামানে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের দরুণ যে প্রবল ভূমিকম্প হয়, তার ফলে প্রবল সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে শাকদ্বীপ ধ্বংস হয়। ভূতাত্ত্বিকদের মতে, ওই সময় সুন্দরবনের নাম ছিল শাকদ্বীপ। কারও কারও মতে, ‘সমুদ্রবন’ শব্দ থেকে সুন্দরবন শব্দের উৎপত্তি। সুন্দরবনে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার যেমন প্রাণীদের রাজা, তেমনই গাছের রানি হল সুন্দরী।
বেড়েছে বাঘের সংখ্যা
একটা সময় সুন্দরবনে কমে গিয়েছিল বাঘের সংখ্যা। গত কয়েক বছরে বেড়েছে। এর পিছনে বড় ভূমিকা রয়েছে রাজ্য সরকারের। কমেছে চোরাশিকারিদের উপদ্রব। ২০১০ সালে সুন্দরবনের ভারতের অংশে বাঘের সংখ্যা ছিল ৭৪। ২০১৪ সালে তা বেড়ে হয় ৭৬। ২০১৮ সালে আরও বেড়ে হয় ৮৮টি। আর ২০২২ সালে সর্বশেষ হিসাবে বাঘের সংখ্যা আরও বেড়ে হয়েছে ১০১। ২০২১-’২২ সালে হয়েছিল সর্বশেষ অল ইন্ডিয়া টাইগার এস্টিমেশন। নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর এই এস্টিমেশনের কাজ করে দেশের সমস্ত ব্যাঘ্র প্রকল্প। মূলত জঙ্গলের বিভিন্ন প্রান্তে স্বয়ংক্রিয় ক্যামেরা বসিয়ে বাঘেদের ছবি তোলা হয়। ক্যামেরায় ওঠা বাঘেদের ছবি বিশ্লেষণ করে পাওয়া তথ্য প্রকাশ করে কেন্দ্র। ঠিক একই পদ্ধতিতে সুন্দরবন ব্যাঘ্র প্রকল্পও প্রতি বছর নিজেদের মতো করে তাঁদের এলাকায় বাঘেদের পরিসংখ্যান নিয়ে থাকে। নভেম্বর-ডিসেম্বরে তাঁদের শুমারে বাঘের সংখ্যা আরও বেশ খানিকটাই বেড়েছে বলে জানা গিয়েছে।
আরও পড়ুন-নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ২০টি গাড়িকে ধাক্কা কন্টেনারের, মৃত ১, আহত ১৮
সুফল পাচ্ছেন স্থানীয়রা
পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে দিনে দিনে আরও জনপ্রিয় হয়ে উঠছে সুন্দরবন। সুফল পাচ্ছেন স্থানীয়রা। বাড়ছে ব্যবসা। তৈরি হচ্ছে বিকল্প কর্মসংস্থান। উন্নত হচ্ছে জীবনযাত্রার মান। ট্রেন ছুটছে। সড়কপথে ছুটছে বাস, লরি, গাড়ি। ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ, জল। ছেলেমেয়েরা যাচ্ছে স্কুলে, কলেজে। গমগম করছে দোকান-বাজার। মুঠোয় সেলফোন। অরণ্য জীবনে লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। প্রসঙ্গত, সুন্দরবন টাইগার রিজার্ভে প্লাস্টিক ব্যবহারের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে। সমগ্র সুন্দরবনটাই দু-চোখ ভরে দেখার মতো।
ডিটেনশন ক্যাম্প হিসেবে আত্মপ্রকাশ
আরেকটি বাঘ সংরক্ষণ অরণ্য রয়েছে আলিপুরদুয়ার জেলার বক্সায়। ৭৬০-বর্গ-কিলোমিটার বা ২৯০ বর্গ-মাইল বিস্তৃত। একটা সময় বক্সার পরিচিতি ছিল দুর্গের জন্য। পূর্ব ভারতের সব থেকে প্রাচীন দুর্গ বলা যেতে পারে। ১৮৬৫ সালে এর দখল নেয় ব্রিটিশরা। বাঁশের কাঠামো বদলে তারা পাথরের স্থাপত্য গড়ে তোলে। ১৯৩০-এর দশকে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার মোড়কে জেলখানা এবং ডিটেনশন ক্যাম্প হিসেবে এই দুর্গ আত্মপ্রকাশ করে। অনেকে বললেন, দুর্গমতা এবং নির্যাতনের কথা ধরলে আন্দামানের কুখ্যাত সেলুলার জেলের পরেই আসত বক্সার নাম। অনুশীলন সমিতি, যুগান্তর দলের মতো বিপ্লবী সংগঠনের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বন্দি রাখা হত এখানে।
আশ্রয় নিতেন শরণার্থীরা
তবে এখন বক্সা আর দুর্গম নয়। নানা পথ ধরে সহজেই পৌঁছানো যায়। পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে গাছপালা-জীবজন্তুর বৈচিত্র্য। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৮৬৭ মিটার বা ২৮৪৪ ফুট উঁচুতে এই বাঘ সংরক্ষণ কেন্দ্রের মধ্যেই রয়েছে দুর্গটি। সবথেকে কাছের শহর আলিপুরদুয়ার। দূরত্ব মোটামুটি ৩০ কিলোমিটার।
জাতীয় উদ্যানের মর্যাদা
বক্সা বাঘ সংরক্ষণ কেন্দ্রকে ১৯৯৭ সালে জাতীয় উদ্যানের মর্যাদা দেওয়া হয়। এর দক্ষিণ সীমান্তে রয়েছে ভুটানের আন্তর্জাতিক সীমানা। তাই বক্সার খুব কাছেই ভুটানের ফিবসু অভয়ারণ্য। দক্ষিণ সীমানা ঘেঁষে চলে গিয়েছে জাতীয় সড়ক ৩১সি। পূর্বদিকে অসমের মানস জাতীয় উদ্যান। যার ফলে ভারত এবং ভুটানের মাঝখানে এশিয়ান হাতি চলাচলের আন্তর্জাতিক করিডর হয়ে উঠেছে বক্সা বাঘ সংরক্ষণ কেন্দ্র। বর্তমানে বাঘের সংখ্যা অনেকটাই কমে গেছে। বক্সার হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনতে বেশকিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যেমন, বাঘেদের পর্যাপ্ত খাবার জোগান দেওয়া, বনের ভিতর তাদের থাকার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করা, বাইরে থেকে বাঘ এই বনাঞ্চলে এলে তাকে পাকাপাকিভাবে এখানে রেখে দেওয়ার ব্যবস্থা করা এবং বাইরে থেকে বাঘ এনে এই বনাঞ্চলে ছাড়া। এই পদ্ধতিতে বক্সার পুরনো পরিবেশ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। মিলছে সুফল।
আরও পড়ুন-পর্যটকদের জন্য সিকিমে নয়া সাজে চো লা
ছবির মতো সুন্দর
বাঘ, হরিণ, লেপার্ড, হাতি ছাড়াও বক্সায় থাকে অসংখ্য প্রজাতির মাছ, সরীসৃপ, উভচর। ২০১৮ সালে প্রথম দাগওয়ালা এশিয়াটিক সোনালি বিড়ালের দেখা মেলে এখানে। আরও অনেক বিরল ও বিপন্ন প্রজাতির জীবজন্তু রয়েছে, যাদের দেখা সহজে পাওয়া যায় না। সবুজ অরণ্যের মোহময় সৌন্দর্য মন ভরিয়ে দেবে। আট রকমের বন আছে, যা উদ্ভিদবিদদের গবেষণার বিষয়। তাঁদের কাছে বক্সা জাতীয় উদ্যান স্বর্গের থেকে কম লোভনীয় নয়। পর্যটকদের আরেকটি আকর্ষণ রাজাভাতখাওয়া শকুন প্রজনন কেন্দ্র। জঙ্গল সাফারির অনেকগুলো রুট আছে বক্সায়।