গিয়েছিলাম সকাল সাড়ে দশটায়। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অতি পরিচিত তিন নম্বর গেট দিয়ে ঢোকার সময় সচিত্র পোস্টার আর তির্যক আক্রমণাত্মক পোস্টারের ভাষায় প্রমাদ গনেছিলাম। পরমুহূর্তে মনে হল, কেনই বা? সেমিনারের বিষয় শিক্ষায় গৈরিকীকরণ আর তারপর WBCUPA-র পূর্ব ঘোষিত এবং অনুমোদিত বার্ষিক সভা বা এজিএম। নেহাতই নিরামিষ! কী বা হবে? হ্যাঁ, আসবেন বটে ওয়েবকুপা-র সভাপতি মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী অধ্যাপক ব্রাত্য বসু, শিক্ষামন্ত্রী। তায় আবার তিনি সমকালের শ্রেষ্ঠ নাটককার, প্রাবন্ধিক, কবি, অভিনেতা। আসছেন ‘সংস্কৃতি’র পীঠস্থান যাদবপুরে। এ আর এমন কী বরং গৌরবেরই। হ্যাঁ, ভুল ভেবেছিলাম। আটকে ছিলাম ১৯৮৪ থেকে ১৯৯৫-এর যৌবনস্মৃতিতে। আর প্রাক্তনীর আবেগে ভুলে গেছিলাম ডিসেম্বর ৩০, ১৯৭০-এ এই বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরেই খুন হয়েছিলেন তৎকালীন উপাচার্য গোপাল সেন।
কেমন ছিল আমার ১১ বছরের যাদবপুর যাপন? কলেজ জীবনে আমোদ, আহ্লাদ, সুমন, অঞ্জন, ‘সংস্কৃতি’, ‘সুচেতনা’র খোলা হাওয়া কখনও কখনও ভারী থেকে অতি ভারী হয়ে উঠত বাম-অতিবামের বাইরে অন্যস্বর যে কোনওভাবে অবরুদ্ধ করে দেওয়ার কঠোর আন্দোলনে। তখন আবার বামে-অতিবামে ভাই-ভাই। দুর্ভেদ্য গড় ছিল তখনও কিন্তু বধ্যভূমি হয়ে উঠতে দেখিনি। ১ মার্চ ২০২৫-এর কালা দিবসে কী দেখলাম? মঞ্চে উপবিষ্ট বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, বর্তমান এবং প্রাক্তন উপাচার্যরা। এজিএমের সংক্ষিপ্ত বক্তা হওয়ার সুবাদে সাড়ে এগারোটা থেকে মোটামুটি মঞ্চে ছিলাম। সাড়ে বারোটার খানিক পর থেকে OAT-র পিছনদিকে হাতে মোবাইল, পিঠে ব্যাগ জন কুড়ি ছাত্র-ছাত্রী এসে জুটল। ভিডিওরত এবং শরীরী ভাষায় প্রতীক্ষারত। তাহলে কি মাননীয় ওয়েবকুপা সভাপতি আসছেন? যাদবপুরে নানা কাজে নিয়মিত আসা-যাওয়ার সুবাদে ভঙ্গি দেখে স্বস্তি হল না। সূচি অনুযায়ী, মধ্যাহ্নভোজন ঘোষণা করা হল আর বেরতে গিয়ে মনে হল, ছাত্র সংখ্যা বেড়ে চল্লিশ তো বটেই। ভুল বানানের নতুন কিছু পোস্টারে শোভিত ততক্ষণে মুক্তমঞ্চের প্রবেশদ্বারের একদিকের মণ্ডপ। শিক্ষিকারা যেতে গিয়েও ফিরে এলেন অনেকে, কারণ মঞ্চ থেকে অনুরোধ করা হল মানববন্ধন করে দাঁড়ানোর জন্য। মন বলছে শিক্ষামন্ত্রীর খারাপ কিছু ঘটতে চলেছে। সু-মন তখনও ভাবতে চাইছে, সভাপতি এবং শিক্ষামন্ত্রীর সম্মাননা বা অভিবাদন জানানোর জন্য নির্ঘাত। সু-কুয়ের দ্বন্দ্বেও মনে হচ্ছে, ছাত্র আর শিক্ষক সম্পর্ক তো! ওয়েবকুপা সভাপতি নিজেও অধ্যাপক। কতটুকুই বা কী হতে পারে!
আমরা সত্যিই মূর্খ বড়। অধ্যাপক ব্রাত্য বসু মঞ্চে ওঠার পরেই অতি সক্রিয় হয়ে উঠল মুষ্টিমেয় ওই খান চল্লিশ ছাত্র। কী না হল! দ্রুত সচিত্র পোস্টারে শোভিত হল প্রবেশদ্বার। নিজেরাই ছিঁড়ল সেটি আর একদিকের লাঠি ছুঁড়ে দিল জ্যাভলিনের মতো অধ্যাপকদের দিকে। সেই শুরু! তারপর বোতল, চেয়ার। আর মঞ্চ থেকে ঘোষণা কোনও অধ্যাপক যেন কোনওভাবেই প্ররোচনায় পা না দেন। কোনও মন্তব্য যেন না করেন। সহনশীলতার চরমতম পরীক্ষা দিলেন সম্মিলিত অধ্যাপকেরা। চেয়ার, বোতল, লাঠির ঘায়ে আঘাত পেয়েও। ওয়েবকুপা সভাপতি এবং শিক্ষামন্ত্রী যখন বলতে উঠলেন, ছাত্রদল চিৎকারে মুখর। প্রশ্ন দু’টি? এক, সকলেই কি ছাত্র? ছাত্রই যদি হয় কোন রুচি থেকে তারা সমবেত শিক্ষক এবং মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীকে মধ্যমাঙ্গুলি দেখায়? দুই, সুস্থ অবস্থায় থাকা কোনও ছাত্র এটি করতে পারে? তখনও অবমাননার বেশি ভাবতে পারিনি। পরে অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বুঝতে হল, ছক ছিল হননের।
আরও পড়ুন-আরটিআই রিপোর্টে বেআব্রু মোদির রেল, বছরে ১ হাজার ২৪০টি দুর্নীতি
আপাতত বক্তৃতায় ফিরি? মাননীয় ওয়েবকুপা সভাপতির অতি বড় শত্রুও বলবেন, তিনি সুবক্তা। তিনি শান্ত, সংযতভাবে তাঁর বক্তব্য রাখলেন আর পিছনদিকের উন্মাদনা দেখে নিজেই বললেন, অনুষ্ঠান শেষে সূচির বাইরে গিয়েই ছাত্রদের সঙ্গে দেখা করবেন, তাঁদের বক্তব্য শুনবেন। ভাবুন, বসে আছি মঞ্চে, অত দূর থেকে শুনছি কদর্য বাক্যবাণের টুকরো। দেখছি কুৎসিত অঙ্গভঙ্গি। ষাট ছুঁতে চলা অধ্যাপক আমি, আমরা, যাদের মধ্যে অনেকেই যাদবপুরের প্রাক্তনী, তারা চিনি না এঁদের। তবে আঁচ পাই যাতায়াতের অভিজ্ঞতায়। ৩-৪ বছর এরা ক্যাম্পাসে সক্রিয়। তারপর বিদেশে বা দেশের বড় এমএনসি-তে এদের সুভদ্রায়ন। বক্তৃতা শেষের পর আয়োজকরা ঘোষণা করলেন প্রত্যেক আগ্রহী ছাত্রদল আসতে পারে, OAT-র ছোট্ট বিশ্রামকক্ষে চারজন করে। অনেক অধ্যাপক দূরবাসী। তাঁরা রওনা দিলেন ফেরার পথে আর আক্রান্ত হলেন নির্মমভাবে। সেই শুরু। তার মধ্যেই এল দু’দল ছাত্র। টিএমসিপি এবং এসএফআই। ডেপুটেশন দিয়ে গেল। সচিত্র প্রমাণ সমাজমাধ্যমে ইতিমধ্যেই বহু প্রচারিত। কিন্তু একটি অতিবাম দলের ছাত্ররা এল না। দাবি তাদের, তারা সবাই আসবে। চারে কথা চলে। চল্লিশে কলহ। তাই উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে আয়োজকরা এবং ওয়েবকুপা-র সভাপতি ব্রাত্য বসু চাইলেন না দেখা করতে। তিনি তো দায়বদ্ধ নন! এসেছেন অধ্যাপক সমাবেশে। অন্যায় আবদার নাকচ করে দিলেন।
এর পর ছাত্রদের যে উন্মত্ত রূপ দেখলাম তা চরমতম দুঃস্বপ্ন। অধ্যাপিকাদের শাড়ি ছিঁড়ছে, অধ্যাপক আয়োজক দলের সেলিম বক্স মণ্ডল, প্রদীপ্ত মুখোপাধ্যায়ের মতো অনেকেই মার খাচ্ছেন পরিস্থিতি সামলাতে গিয়ে। এমনকী প্রহৃত হতে দেখেছি বরিষ্ঠ প্রাক্তন উপাচার্য ওমপ্রকাশ মিশ্রকেও। না, কোনও স্লোগান শুনিনি। শুধু ‘ধর শালাকে, মার শালাকে’ আর হাতাহাতির মধ্যে ছুঁড়ে দেওয়া প্রশ্ন ‘ছাত্র নির্বাচন কেন হচ্ছে না? কবে হবে?’ ধস্তাধস্তির মধ্যে দাঁড়িয়েই যেন ঘোষণা করতে হবে। অবাক হয়ে দেখলাম একটু আগে যে এসএফআই ছাত্রটি শান্তিপূর্ণ ডেপুটেশনে গেছে, মারামারিতে হাত লাগাচ্ছে সেও! আইজাক অ্যাসইমভ তো বলেইছেন ‘violence is the last refuge of incompetent’.
আরও পড়ুন-নিষেধাজ্ঞা উঠল কুস্তি সংস্থার, ব্রিজভূষণ ঘনিষ্ঠের হাতেই সব ক্ষমতা
কালাদিবসের ক্লাইম্যাক্স তখনও বাকি। দূর থেকে দেখছিলাম শিক্ষামন্ত্রী অধ্যাপক ব্রাত্য বসুর গাড়ির উপর খান দশেক ছেলে-মেয়ে নাচছে, স্লোগান দিচ্ছে। সাইড গ্লাস, উইন্ডস্ক্রিন ভাঙা হচ্ছে। গাড়িতে ওঠার চেষ্টা করার সময় কাছ থেকে দেখেছি কানের পাশে ঘাড়ে ধাক্কা, মার এসে পড়ছে ভিড়ের মধ্যে। নিরাপত্তারক্ষীরা মার খাচ্ছেন। শিক্ষামন্ত্রীর ঘড়ির চামড়ার ব্যান্ড ছেঁড়া। অধ্যাপকরা বিহ্বল, দিশেহারা। অথচ সংখ্যায় ওই মেরে কেটে পঞ্চাশ। কোন মত্ততায় এই বিধ্বংসী আচরণ সম্ভব? ছুটির দিন, শনিবার অধ্যাপক সমাবেশে কেন এরা ক্যাম্পাসে এসেছিল? তাহলে কি ‘মাও-মার্কসবাদী’ ছাড়া কোনও স্বর আমাদের বহুস্বরী এই ভারতবর্ষের মধ্যে থেকেও এই যাদবপুরের ভূখণ্ডে ছাত্রদের দ্বারা নিষিদ্ধ? আবার কি একটা গোপাল সেনের রিপ্লে পরিকল্পিত হয়েছিল? গাড়িতে ওঠা যায়নি প্রথম প্রয়াসে। ভিড় ঠেলে কোনওমতে মন্ত্রী এসে বসলেন প্লাস্টিকের চেয়ারে। সৌজন্যবশত ভিড় ঠেলে, ধস্তাধস্তি পেরিয়ে এসে বসলেন উপাচার্য অধ্যাপক ভাস্কর গুপ্ত। পুলিশি হস্তক্ষেপের অনুরোধ করলেন এবং শিক্ষামন্ত্রী অধ্যাপক ব্রাত্য বসু অসম্মত হলেন। ওই অবস্থায় বাইটও দিলেন। প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে সেই সাক্ষাৎকার সমাজমাধ্যমেই মিলেছে। মিনিট পনেরো অপেক্ষার পরও যখন আঘাত-আক্রমণ অব্যাহত, মাননীয় মন্ত্রী এবং উপাচার্যের সুরক্ষার বিষয়ে বিচলিত হয়ে উঠেছিলাম আমরা উপস্থিত সকলেই। ধাক্কা সামলাতে আশপাশের সকলেই বিব্রত। আয়োজকেরা কোনওমতে নিজেরা আহত হতে হতে মন্ত্রীকে গাড়িতে তুললেন। গাড়ির সামনে তখনও দু-তিনটি ছেলে বনেট ধাক্কাচ্ছে। চোখের সামনে একটি ছেলে গাড়ি ছাড়তেই গড়িয়ে পড়ে গেল পাশে। পা ধরে চিৎকার করে উঠল। বাকিটা ভিড়ে ঝাপসা। নিশ্চয়ই আঘাত পেয়েছে ছেলেটি। সেলাই পড়েছে চোখের পাতায়। আমার পুত্রোপম। দ্রুত আরোগ্য লাভ করুক। কিন্তু ‘আঁখো দেখা সচ’ গাড়িটি দ্রুতিতে ছিল না। তবে থামেনি এবং থামবেই বা কেন? ন্যারেটিভ যেমন দ্রুত বদলাতে দেখেছি, দেখছি, তেমনই দ্রুত অবসিত হোক ছাত্রদের দ্রোহ পর্ব। মানসিক স্থিরতা পাক তারা। যা তাদের দাবি তারও বিধিবদ্ধ সমাধান হোক। মনে করিয়ে দিই, “গড়ে তোলবার কাজে তোমার সমস্ত শক্তি দাও অনাবশ্যক ভেঙে ফেলবার উত্তেজনায় তার সিকি পয়সা বাজে খরচ করতে নেই।”