দিবাস্বপ্ন দেখাটা বন্ধ করুন, প্লিজ

দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়। সিপিএমের শাবকরা সেখানে ছাত্র ভোটে ভাল ফল করেছে। রুখেছে গেরুয়া বাহিনীকে। তার মানে কি, পশ্চিমবঙ্গেও প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রতিষেধক হিসেবে তাদের ওপরেই আস্থা রাখবেন বঙ্গবাসী? ফেসবুকের পোস্ট দেখলে এমন বিভ্রম হতেই পারে। কিন্তু আসল ছবিটা অন্য। লিখছেন পার্থসারথি গুহ

Must read

প্রয়াত সাংসদ তথা সিপিআই নেত্রী গীতা মুখোপাধ্যায়ের এক অবিস্মরণীয় উক্তি দিয়ে এই লেখার অবতারণা করছি। সিপিএমের (shame on CPIM) মতো ফেক নন। প্রকৃত বামপন্থায় বিশ্বাসী গীতা মুখোপাধ্যায় তৎকালীন রাজনীতিতে তোলপাড় ফেলে দেওয়া তরুণ তুর্কি সাংসদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বলেছিলেন, ‘‘মমতা তোর জায়গা তো এদিকে। তুই ওদিকে কেন?’’ সিপিএমের মতো ওপরচালাক ভণ্ড কমিউনিস্ট তো আর গীতা মুখোপাধ্যায়, ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত, গুরুদাস দাশগুপ্ত, ক্ষিতি গোস্বামী, যতীন চক্রবর্তীরা নন। তাঁরা সঠিক পন্থায় মার্কসবাদ-লেনিনবাদের অনুশীলন করতেন।

ঠান্ডা ঘরে নয়, প্রান্তিক মানুষের পাশে থাকতেন। সিপিএমের (shame on CPIM) মতো আমি খাব তুমি বাদ, মার্কসবাদ, লেনিনবাদে বিশ্বাস করতেন না তাঁরা। সেজন্যই গীতা মুখোপাধ্যায়ের জহুরির চোখ চিনতে পেরেছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধ্যেকার সমাজতান্ত্রিক, বামপন্থী সত্তাকে। বস্তুত, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু থেকে পণ্ডিত নেহরু, পরবর্তীতে ইন্দিরা গান্ধীর মধ্যেও সেই বামপন্থা বহাল তবিয়তে বিরাজমান থেকেছে। অথচ বামপন্থার নামে কলঙ্ক সিপিএম নেতাজিকে তোজোর কুকুর, ইন্দিরা গান্ধীকে ডাইনি এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ওপর চরম নির্যাতন, কুৎসা চালিয়ে বামপন্থার আদর্শ ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে। নকশাল আন্দোলনের পরিপূর্ণ ডিভিডেন্ড কুড়িয়ে ক্ষমতা দখল করা সিপিএম নামেই বাম। চরম দক্ষিণপন্থাকেও লজ্জা দিয়েছেন জ্যোতিবাবুরা।

বৃহত্তর একান্নবর্তী বামপন্থী পরিবার গড়ে তোলায় বরাবর তাদের আপত্তি। সেজন্য সিপিআইএমএল, এসইউসি(এস)-এর মতো বামপন্থী দলগুলোর ব্যাপারে প্রথম থেকেই নাক সিঁটকেছে সিপিএমের নামাবলি পরা মেকি কমিউনিস্টের আড়ালে থাকা এলিট-বুর্জোয়ারা। অথচ সেই সিপিএমই এখন গাড্ডায় পড়ে জওহরলাল নেহরু ইউনিভার্সিটিতে আইসা ও ডিএসএফের সঙ্গে জোট বেঁধে এবিভিপিকে হারিয়ে এমন ভান করছে যেন পশ্চিমবঙ্গে হারানো জমি ফিরে পেয়েছে।

সিপিএমের অতিউৎসাহী কমরেডরা যে শুধুই ফেসবুক, ট্যুইটার তথা সোশ্যাল মিডিয়ায় সুন্দর, ৩৪ বছরের অত্যাচার সহ্য করা বাংলার মানুষের কাছে বান্দর সেটা মনে হয় বুঝতে পারছে না। বা বুঝেও হ্যালুসিনিয়েট করে ওরা সেই বাম জমানার পৈশাচিক মধ্যযুগে ফিরে গিয়েছে। অন্ধ মমতা বিরোধিতার নামে সিপিএমের হিপোক্রেসির পরিপূর্ণ সুযোগ নিয়ে কমরেডদের ভোটে ভাগ বসিয়ে এই রাজ্যে বেড়ে উঠেছে বিজেপির মতো চরম সাম্প্রদায়িক একটি দল।

জেএনইউ-এর জয়ের খবরে পশ্চিমবঙ্গে সিপিএমের উল্লাস দেখে মনে হচ্ছে রাজ্যে ফের বুঝি অষ্টম বামফ্রন্ট সরকার গঠিত হতে চলেছে।
শূন্যের পুণ্যিপুকুরে স্নান করে, লাল বস্ত্র পরিধানে কমরেডকুল সুনীল আকাশে উড়িত বিহঙ্গের মতো পতপত করিয়া ডানা মেলিতেছেন।
এরপরেই যথারীতি দিবাস্বপ্নর অক্কাপ্রাপ্তি।
জাম্প কাটে স্বপ্নভঙ্গর দৃশ্যটা অনেকটা খাট ভেঙে কমরেড সুশান্তর হুড়মুড়িয়ে পড়ে যাওয়ার মতো। যাক গে যাক। স্বপ্ন তো স্বপ্নই। স্বপ্ন দেখতে তো আর মানা নেই। সামান্য অশ্লীল হলে সে না হয় সেন্সর করা যাবে। সিপিএম পশ্চিমবঙ্গের পরতে পরতে এতটাই দগদগে ক্ষত সৃষ্টি করে গিয়েছিল যে তাদের নিয়ে বাংলার সাধারণ মানুষ আর ভাবনাচিন্তাও করে না। চেতন-অবচেতন সবেতেই বিলীন সিপিএম। এতটাই অপ্রাসঙ্গিক রাজ্যের ৩৪ বছরের স্বৈরাচারী স্টালিনিস্ট শাসকরা।

আরও পড়ুন-বাংলা সেরা পারফর্মার: এসআইআর-এ রাজ্যের সাফল্যে সন্তুষ্ট নির্বাচন কমিশন

বিগত ১৪ বছরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আমলে বাংলা প্রত্যক্ষ করেছে প্রকৃত বামপন্থা কাকে বলে। সিপিএমের মতো মুখে মারিতং জগতং নয়। লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, কন্যাশ্রী, স্বাস্থ্যসাথী-সহ একগুচ্ছ প্রকল্প, ঝকতকে রাস্তাঘাট, সরকারি স্বাস্থ্য-শিক্ষা ব্যবস্থার ভোলবদলের মাধ্যমে কোটি কোটি প্রান্তিক মানুষের আশীর্বাদ কুড়িয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। লেনিনের জন্মদিনকে নিজের বলে চালানো সিপিএম নেতার মতো ৩৪ বছরের বুজরুকি বাংলার মানুষের কাছে এখন দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। আসনের অঙ্কে শূন্য, ভোট শতাংশে লবডঙ্কা হলে কী হবে, সিপিএমের একেকজন ‘বীরপুঙ্গব’-কে দেখলে বোঝাই যায় না, তাদের এতটাই হতশ্রী দশা। ফেসবুকে প্রতিক্ষণে তাদের জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব দেখলে মনে হবে সুলভে কমিউনিজমের পাঠশালা খুলেছেন সিপিএমের কমরেডরা। সেখানে নীতিকথার ফুলঝুরি ছুটছে। গীতাপাঠের মতো গঠনতন্ত্র ঘেঁটে তাত্ত্বিক সাজা। সন্ধে হলেই টিভি চ্যানেলেও তেনাদের দেখা যায়।

এই দেখুন, তেনারা বলাতে সিপিএমকে মোটেই ভূত বা প্রেতাত্মা ভাববেন না। একটু সম্মান দিয়ে লুপ্তপ্রায় ডায়নোসর বা সংরক্ষিত মমি বলাই যায়। যাদের গায়ে খোদিত রয়েছে ৩৪ বছরের নরসংহারের নানা ইতিহাস। মরিচঝাঁপি, আনন্দমার্গী, বানতলা, ধানতলা, সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম, নেতাই— কী নেই সেখানে! যুব কংগ্রেস সভানেত্রী থাকাকালীন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডাকা রাইটার্স অভিযানে কাপুরুষের মতো গুলি চালিয়ে কংগ্রেস কর্মীদের খুন করে সেই কবে চিনের তিয়েন-আন-মেন স্কোয়ারের স্টেজ রিহার্সাল সেরে রেখেছিল এই হার্মাদরা।
যদিও জওহরলাল নেহরু ইউনিভার্সিটিতে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী আরএসএস-এর ছাত্র শাখা অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদকে সিপিএমের ছাত্র সংগঠন এসএফআই কিন্তু একার জোরে হারাতে পারেনি। যাবতীয় ইগো সরিয়ে আইসা, ডিএসএফ ইত্যাদি অতি বাম এবং অন্য সংগঠনগুলোর সঙ্গে জোট বেঁধে তবেই জিতেছে এসএফআই। ওই দেখুন সিপিএম যে বড় বড় বুকনি দেয় আমরা নানা ছোটদলকে নিয়ে ৩৪ বছর রাজ্য চালিয়েছি। সিপিএমের সঙ্গে ঘর করা যে কী সাংঘাতিক অত্যাচার সহ্য করা তা সিপিআই, ফরওয়ার্ড ব্লক, আরএসপি, ডিএসপি-সহ বামফ্রন্টের একদা শরিক দলগুলো হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে। একটা সময়ে রাজ্যে বধূ নির্যাতনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলত ছোট শরিকের ওপর সিপিএমের (shame on CPIM) প্রভুত্ব স্থাপনের নামে চরম অরাজকতা স্থাপন। সিপিএমের বশংবদ হতে পারলে চাকরবাকরের মতো মাথা বিকিয়ে মন্ত্রিসভায় থাকতে হত। আলিমুদ্দিনের বেঁধে দেওয়া নির্দেশে জো হুজুর মার্কা ক্রীতদাসের মতো পরাধীন যাপন।

একটু অন্যথা হলে শরিক দল বলেও রক্ষে ছিল না। শুধু এসইউসি(এস)-র কমরেড নিধন নয়, আরএসপি-সিপিএম সংঘর্ষে প্রায়শই রক্তাক্ত হত বাসন্তী, গোসাবার মাটি। কোচবিহারে সিপিএমের পুলিশের গুলিতে ঝাঁঝরা হতে হয়েছিল ফরওয়ার্ড ব্লক কর্মীদের। প্রতিবাদ করলে কমল গুহ, যতীন চক্রবর্তীদের মতো বর্ষীয়ান নেতাকে অপমান-তিরস্কারে জর্জরিত করা হত। রাজ্য বামফ্রন্টের অন্যতম প্রবীণ নেতা ফরওয়ার্ড ব্লকের অশোক ঘোষও সিপিএমের আলিমুদ্দিনি বাবুদের বিষনজরে পড়েছেন। ক্ষিতি গোস্বামীর মতো আপাদমস্তক ভদ্রলোককেও এই সিপিএমের শ্যেন দৃষ্টিতে পড়তে হয়েছে। শুধু শরিক দলই বা বলি কেন, ‘‘চোরেদের মন্ত্রিসভায় আমি থাকব না।’’ কিংবা ‘‘আমি এমন একটা দল করি যারা কথায় কথায় সর্বনাশা ধর্মঘট ডাকে’’ বলার পর প্রয়াত বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে পর্যন্ত সেন্সর করেছে সিপিএম।
সৈফুদ্দিন চৌধুরীর মতো নেতাকে কংগ্রেস ঘনিষ্ঠতার অভিযোগে ছেঁটে ফেলে পরে সেই কংগ্রেস তথা গান্ধী পরিবারের পা ধরেছে সিপিএম। এতটাই দ্বিচারী তারা।

জেএনইউ-এর জয় নিয়ে যে এসএফআই জগঝম্প করছে তাদের র্যা গিংয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে স্বপ্নদীপের মতো একের পর এক তাজা প্রাণকে আমরা হারিয়েছি। জেইউতে সিসিটিভি লাগানোয় এই এসএফআইয়ের প্রবল আপত্তি। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাঙ্গণে অন্য মতালম্বী শিক্ষকদের পেটানো, শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু, বাবুল সুপ্রিয়র ওপর বর্বর প্রাণঘাতী আক্রমণ এসএফআইয়ের স্বভাবসিদ্ধ। পরিশেষে বলা যায়, সিপিএম আর এসএফআই ওই বাতেলা আর ফেরেববাজিতেই সিদ্ধহস্ত থাক। বাংলা থাকুক মমতাময়ী নেত্রীর স্নেহস্পর্শে।

Latest article